বৃষ্টি যখনই আসে তখনই আমার দেহটিকে চুপসে ভিজিয়ে দেয়। বৃষ্টির স্বভাবটাই এরকম। তার সামনে যেই পড়ুক তাকেই ভিজিয়ে দেবে। আবার বৃষ্টির অনেক গুণও আছে, সে গুণের একটি হচ্ছে পিতৃত্ব । বৃষ্টি যখন দীর্ঘদিন খরার পর ঝরঝরা ফকফকা শুকনা মাটিতে ঝরে পড়ে মাটিকে স্নেহের আদরে, ভালবাসায় সিক্ত করে দেয় তখন মাটি ফুঁটে বেরিয়ে আসে নানা রকম বৃক্ষরাজি, ফল-ফুলের চারা, সবুজ ঘাস। বৃষ্টি যেন জন্মদাতা, যেন প্রসূতি মায়ের ডেলিভারীর ইনজেকশন। লুকিয়ে থাকা মাটির গর্বে নানান রকমের বীজ বৃষ্টির ছোয়ায় জমিনের জরায়ুর জটর ভেদ করে মুক্ত আকাশে জন্ম নেয়। বলতে পারেন বৃষ্টির আবার লিঙ্গ আছে নাকি? আমি বলব আছে, বৃষ্টি হচ্ছে পুং লিঙ্গ। তবে বাংলাদেশে অনেক মেয়ের নাম বৃষ্টি দেখতে পাই। আজ পর্যন্ত কোন ছেলের নাম বৃষ্টি দেখিনি। এখানে কিছুটা কৌতুহল আছে বৈকি!
বৃষ্টির আর একটি গুণ হচ্ছে শৈল্পিক দক্ষতা। মাটি ছাড়িয়ে আকাশ পানে বাড়ন্ত পত্রহীন বৃক্ষে সবুজের সমাবেশ ঘটায় বৃষ্টি। বর্ষার বিকালে শান বাঁধানো ঘাটের চালায় ঝিঙে লতার হলুদাব ফুলগুলো যেন বকুল তলার মেলা তেকে কিনে আনা বাগান বধুর নোলক। ডোবায় কচুরিপানার গোলক পাতার উপর দিয়ে হেটে চলা ডাহুকগুলো যেন সে বধুর ঘোমটার আড়ালে উঁকি মারা কর্ণের ঝুমকা।
পথ-ঘাটে ধুলা-বালি, ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দেয় বৃষ্টি। আরো অনেক গুণ বৃষ্টির আছে বটে তবে তার বেশীর ভাগই মেয়েলী স্বভাবের গুণ হলেও যেহেতু বৃষ্টি নিজে জন্ম দিচ্ছে না, অন্যের মাধ্যমে জন্মানো হচ্ছে। তাই বৃষ্টিকে মেয়েলী নাকি পুরুষালী রূপায়নে সজ্জিত করে কবিতা লিখবেন সে সিদ্ধান্ত কবিরাই নিবেন। বৃষ্টির লিঙ্গ নির্ধারণ করা আমার কর্ম নয়। আমি লিখতে বসেছি বৃষ্টির সাথে কবি ও কবিতার সম্পর্ক নিয়ে। কবিরা কবিতা লিখার জন্য যে কয়েকটি হট আইটেমকে প্রত্যেক্ষভাবে ব্যবহার করেন তার একটি হচ্ছে বৃষ্টি। কবিতার আরো কয়েকটি কাঁচা মাল হচ্ছে কাঁশবন, নদী, কিশোরী, যুবতী, গাঁয়ের বধু, ফুল, আকাশ ইত্যাদি। কবিরা প্রেমিক হলে এসব উপাদানগুলো যেন প্রেমিকা। তাই এগুলোর রূপ সৌন্দর্য কবির কালির তুলিতে কবিতার প্রতিটা ছত্রে ছত্রে অংকিত হয়। নদী, বৃষ্টি, আকাশ, যুবতী এগুলো নিয়ে কবিতা লিখেননি এমন কবি আছে কিনা আমার জানা নেই।
আমি অবশ্য কবি নই, কবিতা লিখা আমার কাজও নয়। আসলে নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকার মতই আমার সাথে কবিতার সম্পর্ক। তবে কবিদেরকে আমি শ্রদ্ধা করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদ, কবি জসিম উদ্দীন, কবি আল মাহমুদসহ আরো অনেক কবি আছেন যাদের কবিতা পড়ে আমি এবং আমার মন আলোড়িত হয়, চিত্ত হয় সন্তুষ্ট। কবি জসিম উদ্দিনের ‘কবর’ কবিতা যেমন হৃদয় ছুঁয়ে যায় আবার যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কাজলা দিদি কবিতা পাঠ করতেও চোখের কোণা ভিজে উঠে।কয়েকটি মাত্র ছত্রে অতি অল্প কথায় গভীর ভাবার্থ কেবল কবিতাতেই সম্ভব। বৃষ্টির সাথে কবিতার একটি গভীর সম্পর্ক আছেই। কবিতা যেহেতু ভাবের বিষয় আর ভাব তো চাইলেই পাওয়া যায় না, এটা আসতে হয়। ভাব কখন, কিভাবে আসবে এটা কেউ বলতে পারে না। প্রসূতী মায়ের নির্ধারিত সময়ের আগে যেমন সন্তান প্রসব করা সম্ভব নয় তেমনি ভাব ছাড়া কবিতা লিখাও সম্ভব নয়। তবে যারা জাত কবি, যাদের আল্লাহর দান আছে তাদের কথা আলাদা। তাই আমি মাঝে মাঝে কবিতা লিখতে চেষ্টা করে কিছুই খুঁজে না পেয়ে কবিতার সন্ধানে কলম হাতে কাগজের সাদা মাঠে বেহুদা ঘুরে বেড়াই। এক সময় কবিতাকে খুঁজতে খুঁজতেই লিখি-
কবিতা, এই কবিতা!
তোমাকে নিয়ে করতে গবেষণা
হয়েছি আমি নিঃস্ব,
কোথা হতে সৃষ্টি তোমার
আদি-অন্ত-উৎপত্তি,
খুঁজে ফিরছি বিশ্ব।
হেড স্যার বলতেন- গদ্য হাটে,
পদ্য উঁড়ে আকাশে,
শুনে সে কথা মুখখানি আমার
হয়েছিল কেমন ফ্যাকাশে।
পদ্য যে উঁড়ে তা খুঁজতে
আকাশে হারিয়েছি দৃষ্টি,
পাইনি পদ্য, তবে পেয়েছি অনেক
নিত্য-নতুন সৃষ্টি।
হায়রে কবিতা
কারো মুখে তুমি খই ফোঁটাও,
পাঠকে দাও একাগ্রতা,
বোমা ফাঁটালেও আমার পেট থেকে
বের হতে চাওনা তুমি
এ তোমার কেমন রসিকতা!
অনেকে দেখি কাধে থলে ঝুলিয়ে
কাঁশবনে খুঁজে তোমায়,
আমিও খুঁজি দাওনা ঠিকানা
এসএমএস করে আমায়।
মাত্রা ছন্দের জটিল সমীকরণের মাঝে কবিতাকে আমি যতই খুঁজি, কবিতা আমার কাছে যতই দূর্বোধ্য, জটিল, কঠিন মনে হোক না কেন মাঝে মাঝে কবিতার ছদ্মবেশে কিছু কথা মালা নিজের অজান্তেই কলমের পিচ্ছিল পথ বেয়ে আঁচড়ে পড়ে কাগজের প্রসস্ত বুকে। আকাশের কান্না বৃষ্টির অশ্রু বিন্দু হয়ে যখন মাটির বিছানায় ঝর্ণা বয়ে চলে তখন বৃষ্টির অবিরাম ঝরঝর ছন্দে নিজের অজান্তেই লিখে ফেলি-
অঝর ধারায় ঝরছেই কেবল বৃষ্টি
কাদা-পানিতে চুপসাই যেন কৃষ্টি ।
ঝমঝমাঝম শব্দের মাঝে
কুয়াশা ভরা দৃষ্টি,
সুর মিলিয়ে ছন্দের তালে
কি অপরূপ সৃষ্টি ।
মন ভুলানো দৃশ্য
হাজার কৃষক নি:স্ব ।
কেউবা হয় ভাঙ্গনের স্বীকার
ইহাই বাংলাদেশের কালচার ।
উপরের কবিতায় হয়তো অতিবৃষ্টির চিত্র ফুটে উঠেছে। বৃষ্টি যখন কোমর বেঁধে নামে তখন যেন প্রিয় স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে স্বামীর ফেনায়িত কান্না হয়েই ঝরতে থাকে। যেন পৃথিবীটা উল্টে সাগর পানিসহ উঠে পড়ে আকাশে। তবে অনাবৃষ্টির সময় যখন বৃষ্টির জন্য হাহাকার পড়ে। যখন তৃষ্ণার্ত কাকের মত সবাই শূন্য আকাশ পানে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বৃষ্টির জন্য তখন তো আর তাকে না ডেকে পারা যায় না। তাইতো তাকে ডাক পাড়ি,
এসো হে বৃষ্টি
টুপ রিম ঝিম,
বাতাসের দোলাচলে
করে দাও হিম।
রোদ্রে পোড়ে যায় চাম
কঁচি থাকতে পেকে যায় আম।
তরমুজ খেতে লাগে
ভারী মিষ্টি,
এসো হে বৃষ্টি, এসো বৃষ্টি।
বৃষ্টির যেন ভালবাসার মন, ডাকে সাড়া না দিয়ে বেশী দিন তাকতে পারে না। ক’দিন লুকোচুরি খেলে যখন রাতের আধারে চুপি চুপি বৃষ্টি এসে দেহমন শীতল করে দিয়ে যায় তখন তৃপ্তির ঢেকুর উঠে কলমে। কলম এবার লিখতে থাকে কৃতজ্ঞতার চিঠি। দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে কলম লিখে-
সে এসেছিল গতরাতে
যার জন্য দু’দিন আগেও কবিতা লিখেছিলাম।
যার অপেক্ষায় ঘন্টার পর ঘন্টা তৃষ্ণার্থ হৃদয়ে
হাহাকার চিত্তে প্রহর গুনেছি।
যাকে কামনা করেছি প্রতিটি নি:শ্বাসে প্রশ্বাসে।
যার অনুপস্থিতিতে শরীর-মন-দেহে পানিশূন্যতা
বিরাজ করার দ্বারপ্রান্তে।
সে এসেছিল গতরাতে,
গভীর রাতে যখন আমি অঘুরে ঘুমাচ্ছিলাম।
তার নুপুরের রিমঝিম সুরেলা আওয়াজ আমার
কানে এসেছিল।
তার আচল দোলানো পত-পত শব্দ আমি শুনেছিলাম বটে।
সে আওয়াজে কোন কর্কশতা ছিলনা,
ছিল মায়াবী সুরেলা ঘুম পাড়ানী গানের
নেশাতুর তরঙ্গমালা।
আমি এমনিতে ঘুমকাতুরে মানুষ,
তার আগমনে আমার ঘুমের ঘনত্ব আরো বেড়েছিল।
সে আমাকে ঘুম থেকে জাগাতে পারেনি।
তার নাচনের শব্দ, সুরেলা কণ্ঠ, আচলের দোলাচল,
কর্ণের দুল, চুরির ঝন ঝন আওয়াজ,
নোলকের ঝলকানি চমক আমাকে যদি জাগাতে না পারে
সে কি আমার দোষ ?
দেখুন তো কি কান্ড! আমার লিখায়ও বৃষ্টিকে অংকিত করা হয়েছে ছায়াময় রূপসী হিসেবে। বৃষ্টি যেন মনের গহীনে ভালবাসার অন্দরমহলের অধিকারী স্বপ্নের প্রিয়সী। বৃষ্টির জন্য হাহাকার, বৃষ্টিকে আহবান, বৃষ্টির আগমনে নৃত্যের ছন্দে পুলকিত চিত্তে আনন্দের গান- এ যেন কবির সাথে প্রিয়সীর ভালবাসার কথোপকথন। বৃষ্টির পানিতে যেমন হাঁসেরা ভাসে, বৃষ্টিকে নিয়ে কবিদের লেখা কবিতাও হাসে। নীল আকাশের নীচে নদীর ধারে কাঁশবন।
বৃষ্টি শেষে মেঘের আড়ালে ঘোমটা সরিয়ে উঁকি মারে ক্লান্ত সূর্য।ক্ষণিকের রোদের ঝিলিক কবির মনকে করে রি-ফ্রেশ। কাব্যিক ছন্দে সৃষ্ট কবিতার সিরিয়াল আনলিমিটেড মেমোরীর কোণায় ঠায় করে নেয়।জন্ম নেয় নতুন প্রজন্মের জন্যে সাহিত্যের নিত্যনতুন খোরাক, দেশ মাতৃকার উন্নয়নের সূত্র।