ভাইয়েরা আমার,
আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী,রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পুর্ণভাবে আমাকে-আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খাঁন মার্শাল'ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬-দফা আন্দোলনের ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯সালের আন্দোলনে আয়ুব খাঁনের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব সরকার নিলেন- তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন-গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম।
তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁন সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম- ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেননা, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহের হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা এসেমব্লিতে বসবো। আমি বললাম, এসেমব্লির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশী হলেও একজন যদিও সে হয় তাঁর ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাঁদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন-বসুন আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমব্লি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমব্লি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেননা। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম , শান্তিপুর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লো, তারা শান্তিপুর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা, জামার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের মধ্যে- তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু-আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি- তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
তার সাথে আমার দেখা হয়, তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খাঁন সাহেব আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।
আমিতো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাঁদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘন্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার,
২৫তারিখ এসেমব্লি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০তারিখে এসে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেমব্লি কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে প্রথম সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখবো আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফইজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্টান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিস গুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবেনা- রিকসা-ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জর্জকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।
এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়- তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমারা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই , তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবেনা। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের ডুবাতে পারবে না।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাঁদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই ৭ দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছাইয়া দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয় , খাজনা - ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনেন , মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্বকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই , তাঁদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও -টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাঁদের মাইনা পত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন-টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেস্টা করা হয়- বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুল। এবং তোমাদের যা কিছু তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
মনে রাখবা, ''রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ''।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম''।জয় বাংলা।