স্থগিত হলো ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীদের অধিকাংশই আনন্দে আত্মহারা। অনেকের আবার মন ভীষণ খারাপ। তবে কোনো সমস্যা নেই যারা প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। কারণ তারা যা নেয়ার নিয়েছে। তবে ধিক্কারের জায়গাটি দখলে রয়েছে পিএসসি’র। কেননা লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন পিএসসি পরীক্ষা কমিটিতে যারা আছেন তারা ছাড়া আর কেউ জানার কথা না। প্রশ্ন ফাঁসে তাদের ব্যর্থতা শতভাগ। দুর্নামে ফেলেছে সরকারকে। ম্লান করে দিয়েছে সরকারের সাড়ে তিন বছরের শিক্ষাখাতে সফলতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো, ম্যাচ এবং বাসাবাড়িতে চলছিল বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্ত্ততি। পরীক্ষার্থীরা দারুণ উৎসাহ- উদ্দীপনায় চালিয়ে যাচ্ছিল পড়াশুনা। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই অপেক্ষার প্রহর গুনছিল। কবে আসবে রোববার। টেনশনও ছিল বেশ। তবে যারা ভালো প্রিপারেশন নিয়েছিল তারা ছিল আশাবাদী। এমন চিত্র ছিল সপ্তাহ খানেক আগে। কিন্তু হঠাৎ করে আশার সুন্দর আকাশে মেঘ জমাট বাঁধতে শুরু করল। শোনা গেল প্রশ্ন ফাঁসের কথা। প্রথম দিকে বিশ্বাস করেনি কেউই। যারা জড়িত ছিল তাদের কথা ভিন্ন। ধীরে ধীরে বিষয়টি পরিষ্কার হতে শুরু করল।
এদিকে কিছু শিক্ষার্থী যাদের বাবার কিছু টাকা আছে এবং যারা দুর্নীতির মাধ্যমে হলেও চাকরির প্রত্যাশা করে তাদের লাইন দীর্ঘ হতে শুরু হলো নির্দিষ্ট কিছু স্থানে। তবে লাইনে দাঁড়াতে হলে দিতে হবে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। কোনো সমস্যাই ছিল না তাদের জন্য। কারণ দাঁড়াতেই হবে লাইনে। প্রথম ক’জনের মধ্যে তার জায়গা হতে হবে। প্রশ্ন ফাঁসকারীরাও নিল ভিন্ন কৌশল। সরাসরি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্থানে তারা প্রশ্ন দিতে রাজি হয়নি। যেতে হবে তাদের ভাড়াকৃত বাড়িতে। সেখানে রয়েছে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত কেউই বের হতে পারবে না এমন কঠিন শর্ত দেয়া হলো। মেনেও নিল দুর্নীতিবাজ শিক্ষার্থীরা।
তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে চলে গেল ’ইনটেনসিভ কেয়ার’ নামক রুমে। কিন্তু বসে ছিল না তাদের বন্ধু-বান্ধব। তারা কারণটি জানার চেষ্টা করতে লাগল। প্রথম উপায় হিসেবে মোবাইলে ফোন। কিন্তু ওপার থেকে সরাসরি না অর্থাৎ মোবাইলটি বন্ধ। কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে অন্তত ২০ জন এমন সুযোগ গ্রহণের ভাগ্যবান ছিল। কোথাও যখন তাদের পাওয়া যাচ্ছিল না তখন বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা এবং সবশেষে সবাই বুঝতে পারল সত্যি সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এভাবেই আলাপ আলোচনা এবং সর্বশেষ সাংবাদিক, গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্যদের মাথাব্যথা।
তবে অনড় ছিল পিএসসি। পিএসসির চেয়ারম্যান গত কয়েকদিন ধরেই বলে আসছিলেন এটা নেহাতই গুজব। এমনকি পরীক্ষা বাতিলের ১০ মিনিট আগেও চেয়ারম্যান একে গুজব বলে উড়িয়ে দেন। তবে এক্ষেত্রে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের ধন্যবাদ জানাই। কারণ তারাই বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান এবং শেষে লেখালেখি করেছেন। বিরক্ত করেছেন পিএসসি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের। শেষ পর্যন্ত তারাই সফল হয়েছেন। ব্যর্থতা মাথা পেতে নেয়ার জন্য স্বাধুবাদ জানাই পিএসসিকে।
এদিকে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এজেন্ট নিয়োগ দেয় প্রশ্ন ফাঁসকারীরা। শুরু করে টাকার লীলাখেলা।
এবার প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রায় ২৯ হাজার পাশ করেছেন। অন্তত ২০ হাজারের মতো পড়াশুনায় মনোনিবেশ করে কোনো প্রকার দুর্নীতি ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। যতদূর জানা যায় বাকি ৯ হাজার যারা কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্ন কালেক্ট করেছেন। ৯ হাজার শিক্ষার্থী যদি ৫ লাখ টাকা করে ফাঁসকারীদের দেন তাহলে ৪৫০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে কোনো একটি পরীক্ষার প্রশ্নের জন্য এত টাকা বাণিজ্যের ঘটনা দেশে এই প্রথম। এখন প্রশ্ন হলো একটি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এত বড় বাণিজ্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এতদিন কেন উদঘাটন করতে পারল না। আর যদি তারা জেনে থাকেন তাহলে কেন ব্যবস্থা নেননি। প্রশ্নটি থেকে গেল।
এবার আসা যাক কারা এবং কিভাবে প্রশ্নগুলো ফাঁস হলো। আমরা জানি পিএসসি প্রতিটি পরীক্ষা পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যেখানে সাধারণ মানুষ প্রবেশের কোনো উপায় নেই। পিএসসির চেয়ারম্যান এবং যারা পরীক্ষা সম্পন্ন করার দায়িত্বে থাকেন তারাই কেবলমাত্র পরীক্ষা সংক্রান্ত রুমটিতে ঢুকতে পারেন। এখন কথা হলো তাহলে কি কম্পিউটার অপারেটরের দায়িত্বে যারা থাকেন তারাই এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু আমরা জানি যারা কম্পিউটার অপারেটরের দায়িত্বে থাকেন তাদের পাশে সার্বক্ষণিক পিএসসির পরীক্ষা কমিটির একজন সদস্য থাকেন। যার চোখ ফাঁকি দিয়ে কম্পিউটার অপারেটরদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাহলে কথা হলো যদি একজন পিএসসি মেম্বার অন্যদের তথা কম্পিউটার অপারেটরদের নিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করে থাকেন তাহলে পিএসসি কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে এতো দেরি করল কেন। যাদের মাধ্যমে তারা এ কাজটি করেছেন তারা নিশ্চয় কোনো ছোট চুনুপুটি হবেন না। তারা নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতাশালী। অভিযোগ ওঠেছে এর সঙ্গে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বড় বড় নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের টপ নেতারা জড়িত ছিলেন। যার ফলে সিদ্ধান্ত নিতে পিএসসির একটু দেরি হয়েছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়।
তবে যারাই এ কাণ্ড ঘটিয়েছে তারা ইতিহাসের নিকৃষ্ট কাজ করেছে। তাদের বিচার যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়া উচিত।
সে যাই হোক পরীক্ষা স্থগিত করে কাজ শেষ এমনটি মনে করা পিএসসি একই সঙ্গে সরকারের জন্য ভুল হবে। সরকারের উচিত হবে এ ঘটনার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে বিচারের মাধ্যমে জাতির সামনে দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। কেননা এসব মীরজাফরদের বিচার না করলে জাতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অন্যভাবে যদি বলি এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার না করা হলে আগামী দিনে সরকারের জন্য খুব সুখকর কিছু আশা করা মুশকিল। নিশ্চিতভাবে বলা যায় আগামী নির্বাচনে এটা সরকারের জন্য ভিন্ন ফল বয়ে আনবে। আর বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করা হবে জাতির শত্রু হিসেবে। বিষয়টি ভেবে দেখার আহবান রইল সরকারের প্রতি।
সবশেষে শনিবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান একটি প্রাইভেট টেলিভিশনে রামুর ঘটনা নিয়ে একটি কথা উল্লেখ করে শেষ করছি। তিনি বলেছেন রামুর ঘটনাকে কোনোভাবেই রাজনৈতিক ফ্লেভার দেয়া যাবে না। ঘটনাটির সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। তিনি একই কথা বলেছেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের দুর্নীতি সম্পর্কে।
একই কথা প্রযোজ্য বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের সম্পর্কে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হলে অবশ্যই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির মাধ্যমে করতে হবে। পিএসসি তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার পরিচয় দিয়েছে অদক্ষতার। উন্নত বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটলে পুরো সরকারকেই হয়তো পদত্যাগ করতে হতো। আর না হলে পিএসসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট এবং শিক্ষামন্ত্রীকে অবশ্যই পদ্যত্যাগ করতে হতো। সবকিছু বিবেচনা করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের বিকল্প নেই। না করলে ফল ভিন্ন হতে পারে। যেটি সরকার এবং জাতি কারো জন্যই সুখকর হবে না।
এম এম জসিম: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Click This Link