-ভাইয়া, আমি তো মারা যাবো তাইনা?
-না রে ব্যাটা। মরবি ক্যান। মরা এতো সোজা না।তুই সুস্থ হয়ে যাবি।
-সত্যি?
-হুম।
আমার মিথ্যা আশ্বাসে মোস্তফার চোখ চিকচিক করে।
-ভাইয়া আমি কি দুই বছর বাঁচবো?
-কি বলিস,দু'বছর ক্যান আরো অনেক বছর বাঁচবি।
-দু'বছর বাঁচতে চাস ক্যান?
মোস্তফা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে, ভাইয়া মাত্র ১০পারা শেষ করছি। অসুখের কারণে হাফেজখানায় যাইতে পারতেছিনা। ২০ পারা এখনো বাকী।
ঘাতক ক্যান্সার মোস্তফার হাফেজ হওয়ার অদম্য ইচ্ছাকে দমাতে পারেনা। প্রথম বার অসুখ ধরা পড়ার পরে কিছুদিন পর অবস্থার সামান্য উন্নতি হওয়ায় মোস্তফা আবারো হাফেজখানায় যাওয়া শুরু করে।বেশীদিন কন্টিনিউ করতে পারেনা।
নানান কমপ্লেইন নিয়ে মোস্তফা আমার কাছে আসে।আমি যে ছোট ডাক্তার সেই অক্ষমতা আমি ওর পরিবারকে বোঝাতে পারিনা।প্রতিবারই কুমিল্লা মেডিকেল এ যেতে বলি। হাসপাতালের গুমোট পরিবেশ মোস্তফার ভালো লাগেনা। বিকালে সে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার অফিসে চলে আসে।আমি চেয়ারে ঢুলতে ঢুলতে বলি, মোস্তফা ঐ গানটা শোনাতো?
-ভাইয়া কোন গানটা? মরলে নবীজী কে শোনাবো যে?
-হুম।
মোস্তফা দরাজ গলায় গান ধরে-
"ও মদিনার বুলবুলি
তোমার নামের ফুল তুলি
হৃদয় মাঝে যতন করে
একা একা নিরিবিলি............"
আমি বুদ হয়ে শুনি। মদিনার বুলবুলির সাথে দেখা করার অধীর আগ্রহ নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গোণা এক বালকের ক্যান্সার বয়ে নিয়ে হাফেজ হবার ব্যাগ্র ইচ্ছা অনুভব করি।
মোস্তফার পরিবারের পক্ষে কেমোথেরাপী কন্টিনিউ করতে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয় না।মোস্তফা আমার কাছে চলে আসে। আমার অক্ষমতা আমি বোঝাতে পারিনা। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কিছু করার যে ক্ষমতা আমার নাই!
সাইফুল ভাইয়ের মতো বড় মনের মানুষদের সাথে পাই। কিন্তু শুধু একজন সাইফুল ভাই যে যথেষ্ট না! আমাদের সমাজে এরকম অসংখ্য সাইফুল ভাই যদি থাকতো!
সরকার বাহাদুর এর সমাজ কল্যাণ নামের একটা ব্যাপার-স্যাপার নাকি আছে যারা রোগী মরে ভূত হয়ে গেলে রোগের চিকিৎসার সাহায্য পাঠায়।সমাজকল্যাণ অফিসে ধরণা দেই আমি আর আমার বস ইমাম ভাই। আমাদের আর কিছুই করার থাকেনা। আমরা বড় অক্ষম!
দু'টি বছর মোস্তফা আমার পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিল। ক্যান্সারে বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে আম গাছে উঠে আমার জন্য নিজ গাছের কাঁচা আম নিয়ে আসে মোস্তফা। লাজুক মুখ নিয়ে বলে, ভাইয়া একটা জিনিস আনছি।বাসায় নিয়া ভর্তা খায়েন। আমি ওর দুরন্তপনা দেখি। বার্সেলোনার স্ট্রাইপ জার্সি আর ট্রাউজার এ দুর্দান্ত দেখানো মোস্তফার ফুটবলপ্রিয়তার গল্প শুনি। আপাত অর্থহীন অথচ নির্মম অর্থবহ সেই গল্প। মোস্তফা আর কয়েকদিন পর বিকালের বিরতিতে মাদ্রাসা মাঠে ফুটবল নিয়ে সহপাঠিদের সাথে কসরত দেখাবেনা।
মোস্তফার সব লিম্প নোড ফুলে ওঠে। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। ঢাকায় বসে ফোনে মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ব্যাথার ওষুধ দেয়ার কথা বলা ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারিনা।
সকালে আম্মা ফোন করে বলে, বাবা তোর ঐ রোগীটা আজ রাতে মারা গেছে রে। রাতে ফোন দিছিল মোস্তফার মা।
জীবনে এই প্রথম কোন রোগীর মৃত্যুতে আমি হু'হু করে কাঁদি। মনে হয় আমারই আপন কেউ মারা গেছে। ছোট ডাক্তারের আবেগ সামলাতে পারিনা। মনের অজান্তে বিড়বিড় করে বলি-
"ও মদিনার বুলবুলি
তোমার নামের ফুল তুলি
যতন করে হৃদয় মাঝে
একা একা নিরিবিলি ।।
সেই ফুলেরই পাপড়িগুলো
ঝড়ে পরে না
মুগ্ধ করা সুবাস তাহার
কভু শেষ হয় না।।।।
ভালো থাকিস রে ব্যাটা। বেহেশতের ফেরেশতারা তোকে আগায়া নিতে আসছে। দ্যাখ। তোর মদিনার বুলবুলি ও তোর অপেক্ষায় আছে। তাঁর সাথে অবশ্যই তোর দেখা হবে।
সংগৃহিত