জনসভায় নেতা-নেত্রীরা মাইক ব্যবহার করে বক্তৃতা দেন। তবে ঢাকার জনসভায় এই মাইকের ব্যবহারে এক ঐতিহাসিক দলীয়করণ আছে!! ঢাকার রেসকোর্সে ৭ই মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিচ্ছেন আর তার সামনে মাইকে লেখা আছে “কল-রেডী” ...এই দৃশ্যটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় এই কল-রেডী মাইকের ব্যবহার কিন্তু আর বদলায়নি। তাজউদ্দীন ভাষণ দিয়েছেন কল-রেডীতে। এখন শেখ হাসিনাও ভাষণ দেন সেই একই কল-রেডী দিয়েই। আওয়ামী লীগের সাথে সাথে কমিউনিস্ট পার্টির জনসভাতেও দেখা যায় কল-রেডীর ব্যবহার। তবে বিএনপি কিংবা জামাত কিন্তু কল-রেডীর ধারে কাছে নেই। সেই সত্তরের দশকে বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে জেনারেল জিয়ার অন্যতম রাজনৈতিক কুশীলব যাদু মিয়া ভাষণ দিয়েছেন তাহের মাইক দিয়ে। জিয়ার জনসভার ভাষণেও ব্যবহৃত হয়েছে তাহের মাইক। একই ধারা চলছে এখনও। ঢাকাতে খালেদা জিয়া কিংবা ২০-দলের জনসভাতে এখনও সেই তাহের মাইক। জামাত-শিবিরের নিজস্ব সভাতেও দেখা যায় এই তাহের মাইকের ব্যবহার। ঢাকার বাইরের জনসভায় হয়তো অন্যান্য স্থানীয় মাইক ব্যবহার হয়। কিন্তু ঢাকার জনসভায় মাইকের ব্যবহারের রয়েছে এই সুস্পষ্ট দলীয়করণের ধারা।
কল-রেডী আর তাহের মাইক ছাড়াও ঐতিহাসিক ভাবে ঢাকাতে হাবিব মাইকের ব্যবহার দেখা যায়। ছবি ঘেঁটে আমি মাওলানা ভাসানীকে হাবিব মাইকে ভাষণ দিতে দেখেছি। ঢাকাতে ১৯৭২ সালে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছিলো, তখনও দেখা গেছে হাবিব মাইকের ব্যবহার। ঢাকার স্টেডিয়ামে জিয়ার এক জনসভাতেও ছিল হাবিব মাইক। ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেও প্রথম ভাষণ দিয়েছেন হাবিব মাইকে। জেনেছি সেই হাবিব মাইক এখনও ব্যবসায় টিকে আছে। তবে ইদানীংকালের প্রধান রাজনৈতিক দলের জনসভাতে হাবিব মাইকের ব্যবহার দেখিনি।
বিএনপি-জামাত ঘরানার বাইরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের তাহের মাইকের ব্যবহারের একটি দৃষ্টান্তই শুধু আমার চোখে পড়েছে। ১৯৭২ সালের ২২শে ডিসেম্বর মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা ঢাকাতে এসে ভাষণ দিয়েছিলেন তাহের মাইক ব্যবহার করে। সদ্য স্বাধীন দেশে ২২শে ডিসেম্বর মুজিব নগর সরকারের ফিরে আসার দিন তাহের মাইক এবং ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিন হাবিব মাইক...... বিশেষ পরিস্থিতিতে আয়োজিত এই দুটি সমাবেশ বাদে ঢাকাতে স্বাভাবিক সময়ে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সব জনসভায় দেখা যায় কল-রেডীকেই।
অনলাইনে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় কল-রেডী, তাহের, হাবিব এসব মাইক কোম্পানির প্রতিষ্ঠা সেই পঞ্চাশের দশকে। তবে স্বাধীনতার পরে রাজনৈতিক দলের মাইক ব্যবহারে এক সুস্পষ্ট পৃথক ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ মানেই কল-রেডী। জামাত-বিএনপি মানেই তাহের। এছাড়া ঢাকাতে আধুনিক সময়ে তাজ মাইক ও সহিদ মাইকের প্রচলন দেখা যায়। খালেদা জিয়ার কিছু ছবিতে তাজ মাইক দেখা যায়। এরশাদ সাহেবের ব্যান্ড হিসাবে মোটামুটি সহিদ মাইকই প্রচলিত। তবে কল-রেডী এবং তাহেরই মাইকের প্রধান ধারা। দেশের আর সকল ক্ষেত্রের রাজনৈতিক বিভাজনের মতো এই মাইকের ব্যবহারও দেখা যায় এক সুস্পষ্ট বিভাজন।