“ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া”--- কর্নেল তাহের
মহিউদ্দিন আহমেদের প্রকাশিতব্য বই “জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি” থেকে অংশবিশেষ প্রথম-আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। উপরের এই উক্তির প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে এভাবে: “১৭ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈম জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জে তাহেরের বাসায় যান পরিস্থিতি সম্পর্কে আঁচ করতে। ১৯৭১ সালে নঈম ১১ নম্বর সেক্টরে তাহেরের সহযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রায়ই তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতেন। তাহের আক্ষেপ করে নঈমকে বললেন, ওরা বড় রকমের একটা ভুল করেছে। শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া”।
কর্নেল তাহেরের এই উক্তি পড়ে আমি তীব্রভাবে হতাশ হয়েছি। পড়া মাত্র প্রথমেই আমার মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসিকতা ধারণ করে বাংলার মাটিতে কেউ বীর হতে পারে না।
মহিউদ্দিন আহমেদের দেয়া তথ্যের সত্যাসত্য যাচাইয়ের প্রশ্ন আছে। তবে তার বর্ণনা সামরিক ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের দেয়া জবানবন্দির সাথে অনেকাংশেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা সত্য যে কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পক্ষপাতী ছিলেন। সে কারণেই হয়তো তিনি ১৫ই আগস্টের পরপর তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। ফারুক-রশীদ-ডালিম-খন্দকার মোশতাকের খুনি চক্রের সাথে ১৫ই আগস্ট সকালেই তিনি রেডিও ভবনে বৈঠকে যোগ দেন। খন্দকার মোশতাকের শপথ অনুষ্ঠানেও কর্নেল তাহের উপস্থিত ছিলেন। এই খুনি চক্রের সাথে যোগাযোগের ফলশ্রুতিতেই হয়তো ১৫ আগস্টের পর “খুনি মুজিব খুন হয়েছে—অত্যাচারীর পতন অনিবার্য” শিরোনামে গণবাহিনীর পক্ষ থেকে লিফলেট প্রচার করা হয়।
কর্নেল তাহেরের আশা ছিল, খুনি চক্রকে দিয়ে দেশে সামরিক আইন জারি করে বাকশাল বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে সরকার গঠন করানো। মহিউদ্দিন আহমেদ তার বইয়ে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, “১৫ই আগস্ট সকালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত জাসদ গণ বাহিনীর এক সভায় আনোয়ার হোসেন উপস্থিত সবাইকে বলেন, ভাইজান (লে. কর্নেল আবু তাহের) সকালে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর ডালিমকে বকাঝকা করে বলেছেন, ‘...র মেজর হয়েছ, এখন পর্যন্ত একটা মার্শাল ল প্রক্লেমেশন ড্রাফট করতে পারলে না।”
বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের পক্ষে তার মনোভাব ও খুনিদের সাথে যোগাযোগের তথ্য কর্নেল তাহের নিজেই সামরিক ট্রাইব্যুনালে তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করে গেছেন। তার জবানবন্দি থেকেই সরাসরি উল্লেখ করছি: “১৬ই আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক শুধু আমার নামটাই ব্যবহার করছে, যাতে তাদের নেতৃত্বাধীন সিপাহীরা এই ধারণা পায় সে আমি তাদের সাথে রয়েছি। পরদিন ১৭ই আগস্ট এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে এর পেছনে খোন্দকার মোশতাকসহ আওয়ামী লীগের উপরের তলার একটা অংশও সরাসরি জড়িত। এই চক্র অনেক আগেই যে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল সেটাও আর গোপন রইল না। সেদিন থেকেই আমি বঙ্গভবনে যাওয়া বন্ধ করি ও এই চক্রের সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন করি।"
অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু হত্যার পিছনে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের নেপথ্য ভূমিকা এবং খোন্দকার মোশতাক পূর্ব-পরিকল্পনার বিষয় না থাকলে এবং সামরিক আইন জারি সহ বাকশাল বাদে বাকি সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনে রাজি হলে খুনি চক্রের সাথে কাজ করতে কর্নেল তাহেরের আপত্তি ছিল না। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে খুনের কোন ইচ্ছে তার ছিল না, কিন্তু খুন যখন হয়েই গেছে দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে খুনিদের সাথেই তিনি কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। তাই অন্য বাড়তি ঝামেলা এড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলার ব্যাপারে তার এই উক্তি খুব একটা অবাস্তব কিছু না।
কর্নেল তাহের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন সমর নায়ক হিসাবে তিনি যতটা সফল, রাজনীতিতে তিনি ততটাই ব্যর্থ । মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্ব দেখিয়েছেন ও সম্মুখ সমরের নিজের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। সামরিক বাহিনী থেকে অবসরের পর স্বাধীন দেশে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেশের ও জনগণের মঙ্গলের জন্য যে কোন ভূমিকা রাখতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজনীতিতে তার সব ভূমিকা দেশের মঙ্গলের চাইতে অমঙ্গলেরই কারণ হয়েছে। গণবাহিনীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারকে টালমাটাল করে দেয়া ও বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে অনুকূল ভূমিকা রাখা, বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের সাথে যোগসূত্র স্থাপন, খুনিদের বিতাড়িত করে ক্ষমতার দখল নেয়া খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করা এবং পরিশেষে জিয়ার হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া......বাংলাদেশে আজকের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে উত্থান তার সবকিছুর পেছনেই কর্নেল তাহেরের ব্যর্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। কর্নেল তাহের সৎ নিয়তে একের পর এক ভুল মানুষের পক্ষ নিয়েছেন।
জেনারেল জিয়া বিচারের নামে এক প্রহসনের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। আমার ধারণা কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক ভূমিকা পর্যালোচনার ক্ষেত্রে জিয়ার হাতে তাহেরের হত্যা আমাদের বিবেচনা বোধকে প্রভাবিত করে। জেনারেল জিয়া ও বিএনপি’র রাজনীতির বিরুদ্ধে কর্নেল তাহের এখন একটি অস্ত্র। কর্নেল তাহেরের রাজনৈতিক ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতি পর্যালোচনার চেয়ে জিয়ার হাতে তাহেরের ফাঁসির ঘটনাই প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
আসুন, একটি কল্পকাহিনী সাজাই। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল। কর্নেল তাহের প্রাথমিক পর্যায়ে খুনিদের সাথে কিছুদিন কাজ করলেন। এরপর নভেম্বরে খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা নিয়ে নিলেন। ধরা যাক, জেল হত্যার ঘটনা ঘটলো না। ৭ই নভেম্বর জিয়ার পক্ষ নিয়ে কর্নেল তাহেরের সৈনিক বিপ্লব ঘটালেন। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হল। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় টিকে গেলেন। এবং কালক্রমে মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়ক তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে সরকার হল। আমার তো ধারণা, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী ভূমিকা ও ৭ই নভেম্বরের সৈনিক বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের কারণে তাজউদ্দীনের সেই কল্পিত সরকারই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিত। সে হিসাবে কর্নেল তাহেরের সৌভাগ্য যে তার হত্যাকাণ্ড জিয়ার হাতে ঘটেছিলো।
বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় সদ্য স্বাধীন দেশে মানুষ অনেক অন্যায়-অবিচার ও অর্থনৈতিক দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কর্নেল তাহের যেমন তার কর্মকৌশল ঠিক করেছিলেন। সেই সময়েই তাজউদ্দীন, ভাসানী কিংবা মনি সিংহের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ছিলেন ও সেই প্রেক্ষাপটে নিজস্ব বিচার-বিবেচনা থেকে তারা তাদের করনীয় নির্ধারণ করেছিলেন। এবং তাদের চিন্তা ভাবনার সাথে কর্নেল তাহেরের চিন্তা ও কর্মকৌশলের রয়েছে যোজন যোজন ফারাক। আর তাই ১৯৭৫ এর প্রেক্ষাপটে আপনি যদি তাজউদ্দীন কিংবা মনি সিংহের বিচার-বিবেচনায় আস্থাশীল হন, তবে আপনি একই সাথে কর্নেল তাহেরের বিচার-বিবেচনায় আস্থাশীল হতে পারেন না। আর যাই হোক, তাজউদ্দীন কিংবা মনি সিংহের মত ব্যক্তিত্বেরা বঙ্গবন্ধুর লাশ বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলা তো দুরের কথা, শেখ মুজিবের রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে খুনিদের সাথে কোন আলোচনায় বসতেন না।