১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের দিনের শুরু হয়েছিলো রেডিওতে “আমি মেজর ডালিম বলছি” ঘোষণা শুনে। সেদিন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এই ঘোষণার কথা পত্রিকায় আর বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছি। আজ সুযোগ হল সেই রক্তস্নাত সকালে রেডিওতে প্রচারিত ঘোষণাগুলোর কিছু অংশ শুনে দেখবার।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সকালে বাংলাদেশ বেতারের ঘোষণা
অডিও ক্লিপটি জুড়ে ঘুরে ফিরে বেজে উঠছিল খুনি মেজর ডালিমের কণ্ঠ। তার দাম্ভিক কণ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তার সরকারকে উৎখাত করার ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে যাচ্ছিল: “বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর, ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইবোনেরা, আপনারা সবাই সেনাবাহিনীর সাথে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাদের চরমদন্ড দেয়া হইবে। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।” মেজর ডালিম জনগণকে আরও জানিয়ে চলেছিলেন: “আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কোন অসুবিধা নেই।”
ফারুক হোসেন নামের বাংলাদেশ বেতারের একজন ঘোষক ও সংবাদ সেদিনের ঘোষণাগুলো সঞ্চালন করছিলেন। তিনি একটু পরপর বুলেটিন পাঠ করে জানিয়ে যাচ্ছিলেন: “শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে।” জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো...“সারা বাংলাদেশে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করা হইয়াছে।”
মাঝে জাতীয় সংগীতের সুরে বাজিয়ে জানানো হয় “এখন বক্তব্য রাখবেন, আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ”। প্রেসিডেন্ট সাহেব জাতিকে “আসসালামাইকুম” জানিয়ে বলেন, “এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আজ দেশ এবং দেশবাসীর বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে পরম করুণাময় আল্লাহ-তায়ালা ও দেশবাসীর উপর নির্ভর করে” তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তিনি আরও জানান, “দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী বীরের মতো” তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে।
দিনভর বাংলাদেশ বেতারের সব বুলেটিন ও সংবাদ খন্দকার মোশতাকের সেই ভাষণের উপর ভিত্তি করে জানিয়ে চলে: “খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আজ ভোরে সামরিক বাহিনী দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। সব দেশপ্রেমিক নাগরিককে নতুন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। বিশেষকরে রক্ষীবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশ বাহিনীকে নিকটস্থ সামরিক কমান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। নতুন সরকার সারা বিশ্বের প্রতি তাকে স্বীকৃতি দানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।”
১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল-সন্ধ্যা কারফিউ জারী করে রেডিওতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যাতে কেউ পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়ী ঘর থেকে বের না হয়। তবে দুপুরের আগে আগে সংবাদে জানানো হয়, “জনগণ যাতে জুম্মার নামাজ আদায় করতে পারেন সেজন্য রাষ্ট্রপতি আজ দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।”
এর মাঝে রেডিওতে হুবহু একি বক্তব্য এক এক করে পাঠ করে সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, নৌ বাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান এবং বিমানবাহিনী প্রধান এয়ারভাইস মার্শাল একে খন্দকারসহ পুলিশ ও বিডিআর প্রধানেরা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাদের সবার দুই বাক্যের সেই ভাষণ ছিল এরকম: “দেশের নতুন সরকারের প্রতি আমরা আমাদের অবিচল আস্থা ও আনুগত্য জ্ঞাপন করছি। আমাদের সকল পর্যায়ের অফিসার ও জওয়ানদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খলভাবে নিজ নিজ কমান্ডারদের নির্দেশ অনুযায়ী স্ব স্ব দায়িত্বে নিযুক্ত থাকার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি।”
“শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে” ......এই নির্মম বাক্যটি কি অবলীলায় সবাই মিলে সেই জাতীয় প্রচার মাধ্যমে উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন!!
সূত্রঃ ব্যক্তিগত ব্লগে একযোগে প্রকাশিত