বাংলাদেশ জাতীয় দলের বোলিং কোচ কিছুদিন আগে একবার বাংলাদেশ দলের জন্য অকুন্ঠ সমর্থন প্রত্যাশা করে আমাদের সবার সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এবার আবার তিনি আরো একটি বার্তা প্রকাশ করেছেন- বাংলাক্রিকেট ফোরামে। তার সেই বার্তাটুকু ভাবানুবাদের দায়িত্ব আমি আবার তুলে নিলাম। মুল ইংরেজী বার্তাটুকু দেখা যাবে বাংলাক্রিকেট (banglacricket.com) ফোরামের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১ অংশের “হাউ টু ম্যানেজ ওয়ার্ল্ড কাপ এক্সপেক্টেশনস” শিরোনামের থ্রেডে।
আমরা- বোলিং কোচ আমি ইয়ান পন্ট এবং ফিল্ডিং কোচ জুলিয়ান ফাউন্টেইন- ইদানিং টিভি আর পত্রিকাতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের সম্ভাবনা আর প্রত্যাশা নিয়ে অনেক সাক্ষাতকার দিচ্ছি। একটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করেছি যে, সাক্ষাতকারের বেশীর ভাগ প্রশ্নই থাকে অতীতে বাংলাদেশ দলের নানা ব্যর্থতার ইতিহাস এবং আসন্ন বিশ্বকাপে সে সব ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা নিয়ে। আরো প্রশ্ন থাকে আমাদের দলের নানা দুর্বলতা নিয়ে কিংবা দল নির্বাচন সঠিক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে।এসব প্রশ্নের কারনে আমাদের বিরূপ কিছু মনে করিনা। কারন ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে যেমন ভয় পায়, তেমনি নানা দুর্বলতা বা হতাশার আশঙ্কা নিয়ে চিন্তিত থাকা আমাদের মানবিক প্রকৃতিরই একটা অংশ। তবে এটাও সত্য যে দলের খেলোয়াড়দের প্রেরণা ও সাহস জোগানো কোচ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব। আর এই দায়িত্বের একটা অবিচ্ছেদ্দ্য অংশই হলো সব আশঙ্কা ও নেতিবাচক চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে আগামী দিনের উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে খেলোয়াড়দের চোখের সামনে তুলে ধরা। দলের মাঝে একটা একটা ইতিবাচক দৃস্টিভঙ্গি গড়ে তোলাকে আমরা আমাদের কর্তব্য বলেই মনে করি।
এই লম্বা ভুমিকার ইতি টেনে আসুন প্রমানিত সত্যের দিকে দৃস্টি ফেরানো যাক। আমরা এখন ওডিআই র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বের আট নম্বর সেরা দল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এই প্রথম বারের মত আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে সামান্য ভগ্নাংশ ব্যবধানে এগিয়ে গেছি। তবে র্যাঙ্কিং-এ অষ্টম স্থান নিয়ে এত গর্বের কিছুও নেই। আর যাই হোক এটা সবে মাত্র অষ্টম স্থান! বিশ্বকাপে যদি সব কিছু এই র্যাঙ্কিং অনুসারে চলে, তার মানে এই যে আমাদের অন্ততঃ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা উচিত। আবার এই র্যাঙ্কিং অনুযায়ী সব চললে আমাদের কোয়ার্টার ফাইনালের চেয়ে আর এক পাও বেশী না এগিয়ে ঠিক অষ্টম স্থানটাই পাওয়া উচিত। তবে র্যাঙ্কিংই সব চেয়ে শেষ কথা নয়। এসব র্যাঙ্কিং ফ্যাঙ্কিং তিনটি গুরুত্বপুর্ন তথ্য হিসাবে আনতে ভুলে যায়ঃ
১) এটা বিশ্বকাপ। এখানে কোন দল যেমন দারুন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে, তেমনি কোন কোন দলকে এই অনাকাঙ্খিত অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হয়ে যেতে হতে পারে।
২) এবারের বিশ্বকাপ হচ্ছে বাংলাদেশের নিজের মাটিতে। বাংলাদেশ দল খেলবে নিজেদের আপন পরিবেশে এবং সাথে থাকবে স্টেডিয়ামে সমবেত বাংলাদেশের হাজারো মানুষের প্রানঢালা উচ্চকিত সমর্থন।
৩) পারফর্মেন্সের উন্নতি ও অগ্রগতির ধারা হিসাবে নিলে বাংলাদেশ দল এই বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগামী দল। র্যা ঙ্কিং পয়েন্ট হিসাবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ দল ৪৪ পয়েন্ট থেকে দ্রুত উঠে এসেছে ৬৬ পয়েন্টে। বিশ্বের আর কোন দলই এত কম সময়ে তাদের পারফর্মেন্সের এতখানি উন্নতি ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের ক্রিকেট সবার অগোচরেই অনেকখানি এগিয়ে গেছে দৃপ্ত পদক্ষপে।
আমি যে তিনটি বিষয় তুলে ধরলাম- তার প্রতিটি কথাই নিখাদ রগরগে সত্য। এখানে আবেগ বা বিলাসী কল্পনার কিছু নেই। তবে নিজের মাটিতে খেলার বিশাল সুবিধা যেমন আমাদের আছে, তেমনি আমরা নিজেরাও হয়ে যেতে পারি অন্যদলের ঘটানো অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার। বিশ্বকাপে নিচুসারীর যে কোন দলই তাদের চেয়ে উচুসারীর দলকে হারিয়ে দিয়ে চমক জন্ম দেয়ার চেষ্টায় থাকবে। আমরা নিজেরাই কেবল চমকের জন্ম দিবো, কিন্তু অন্য দলের চমকের শিকার হবো না- এটাই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা।
এতসব আলোচনা তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? সব চেয়ে শেষ কথা হলোঃ পারফর্মেন্সের বিচারে আমরা অনায়াসে আমাদের দলকে নিয়ে আশাবাদী হতে পারি। আমাদের সবার উচিত বাংলাদেশ দলকে নিয়ে আশাবাদী হওয়া এবং বিশ্বকাপে কাঙ্খিত সাফল্যের জন্য দলের প্রতি শুভকামনা রাখা। বিশ্বকাপে সামান্য অষ্টম স্থান পাবার লক্ষ্য নিয়ে আমরা খেলবো না। আমরা খেলবো এই দেশের মানুষের হাতে বিশ্বকাপ শিরোপা তুলে দেয়ার জন্য। তার মানে এই নয় যে, আমরা বিশ্বকাপ শিরোপা জিতবোই। বরং এর মানে এটাই, প্রতিটি খেলায় আমরা মাঠে নামবো এটুকু বিশ্বাস বুকে বেঁধে যে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা অন্য যে কোন দলের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা আমাদেরও আছে। অন্য দেশের মানুষ যদি বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারে, তবে সেই স্বপ্নের অধিকার এই বাংলাদেশের মানুষেরও আছে। শুধু একটি দেশই পারবে তাদের স্বপ্ন সত্যি করে তুলতে, আর বাকি সব দেশের মানুষের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যাবে। আমি শুধু দৃঢ়তার সাথে এটুকুই বলে দিতে চাইঃ আর সবার মতো বাংলাদেশও এই স্বপ্নের দাবীদার। বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখা কোন বোকামী, মুর্খতা বা অপেশাদারিত্বের পরিচয় নয়। এটা আমাদের বাস্তবতা বিবর্জিতও করে তোলে না। বরং এই স্বপ্ন আমাদের আবেগকে জাগিয়ে তোলে। আর প্রজ্ঞার সাথে যারা বুকে লালন করে তীব্র আবেগ, তারাই কেবল পারে বিশাল কিছু অর্জন করতে। আমি বিশ্বাস করি, আবেগ যেমন ভুল আমাদের পথে নিয়ে যেতে পারে, তেমনি হৃদয়ে তীব্র আবেগ ছাড়া কোন সফলতাই অর্জন করা যায়না।
সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী কোয়ার্টার ফাইনালে পৌছতে না পারলেই যে আমরা বাজে দল হিসাবে প্রমানিত হবো তা নয়। একই ভাবে আমরা যদি চমক দেখিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেও নেই, তার মানে এই নয় যে আমরা রাতারাতি বিশ্বের সেরা দল হয়ে গেলাম। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল একটা টুর্নামেন্ট জিতেই অর্জন করা যায় না, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হয় বছরের পর বছর সাফল্যের পথ ধরে।
সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা এটুকু হওয়া উচিত যে তাদের দল প্রতিটি খেলায় সামর্থ্যের শেষবিন্দু দিয়ে লড়বে। তারপর দেখা যাবে কি হয়। বিশ্বকাপ অনিশ্চয়তার খেলা। এই অনিশ্চয়তাই জন্ম দেয় বিশ্বকাপকে ঘিরে এতো উত্তাপ আর উত্তেজনা। যদি প্রশ্ন করেন, কোন একটি দিনে বিশ্বের যে কোন দলকে আমরা হারিয়ে দিতে পারে কিনা। আমার উত্তর হবেঃ জ্বী, এখন বিশ্বের যে কোন শক্তিশালী দলকেই আমরা হারিয়ে দিতে পারি। তার মানে এই নয় যে বিশ্বকাপে আমরা বিশ্বের যে কোন শক্তিশালী দলকেই হারিয়ে দিবো। আমারা এই কথার মানে কেবল এই যে – যে কাউকে হারিয়ে দেয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে।
আমাদের প্রধান কোচ জেমি সিডন্সের মুল মন্ত্রই হলে “শঙ্কাহীন চিত্তে খেলো”। বাংলাদেশে পা রাখার পর থেকেই আমি তাকে এই কথাটাই বারবার বলতে শুনেছি। জেমি দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে উদ্বুদ্ধ করে মাঠে নেমে সকল শঙ্কা ঝেড়ে ফেলে সাহসিকতার সাথে নিজের খেলাটা খেলতে। বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডে আমাদের সবচেয়ে বড় খেলাটাই হলো ভারতের সাথে। এবারে ভারতের শক্তিমত্তার কথা ভেবে আমাদের দল মোটেও চিন্তিত নয়। বরং আমাদের দল প্রথম দিনই মাঠে নামবে সাহসিকতার সাথে ভারতকে পরাজিত করতে, ঠিক যেমন আগেও আমরা তাদের করেছি। বিশ্বকাপে আমাদের খেলোয়াড়েরা ঠিক এই শঙ্কাহীন চিত্তের মন্ত্রেই উদ্দীপিত। সব শঙ্কা দূর করতে প্রথমেই প্রয়োজন নিজের উপর বিশ্বাস। বাংলাদেশ দল গড়ে উঠেছে আত্নবিশ্বাসে বলীয়ান একটি দল হিসাবে।
বিশ্বকাপ শুরুর প্রাক্কালে তাই আমার আর জুলিয়ান ফাউন্টেইন এর দায়িত্ব বিশ্বকাপে আমাদের দলের দারুন সম্ভাবনা বার্তা মানুষের কাছে পৌছে দেয়া। বাংলাদেশ দলের প্রতি আস্থা রাখুন। আমরা বিশ্বাস করি, আপনাদের এই দল এবার দেশের মানুষের আস্থার প্রতিদান দেয়ার সামর্থ্য রাখে। আবারো বলছি, বাংলাদেশ দলের পাশে থাকুন আর সমস্ত শক্তি দিয়ে তাদের উদ্দীপিত রাখুন। তারা মাঠে নেমে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের জন্য অনন্য সন্মান বয়ে আনবে।
পরিশেষে এটুকু মনে করিয়ে দিয়ে চাই, সমস্ত কিছুর ক্ষমতা মহান শক্তিমান একজনের যিনি উপরে বসে সারা বিশ্বের সবার নিয়তি নিয়ন্ত্রন করেন। সীমিত সামর্থ্যের মানুষ হিসেবে আমাদের করনীয় এটুকুই যে নিজের সেরা সামর্থ্য ঢেলে চেষ্টা করা এবং মহান শক্তিমানের আনুকুল্যের প্রত্যাশায় থাকা। এবারের বিশ্বকাপ হবে দারুন জমজমাট। আর জেনে রাখুন, শেষ ফলাফল যাই আসুক, আমাদের প্রতিজ্ঞা বিশ্বকে এবার দেখিয়ে দিবো বাংলাদেশ কি জিনিস!
বিনীত
ইয়ান পন্ট
বোলিং কোচ, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল