অতএব রাশিয়ার হাতে দুটো রাস্তা খোলা ছিল, দক্ষিন আমেরিকার কেপ হর্ন অথবা দক্ষিন আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ (আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়া ঘুরে যাওয়া!) । রুশ অ্যাডমিরালরা উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাবার পরিকল্পনা করলেন । রাশিয়া তখনো জাপানের নৌ শক্তি খাটো করে দেখছে! তাদের চোখে জাপানীরা ছিল এশীয় পশ্চাদপদ একটা দেশ । তাদের ঠাট্টা করে বলা হতো হলুদ বাঁদর! হলুদ বাঁদরেরা যে কতখানি এগিয়ে গেছে সেটা রুশরা ধারনাই করতে পারে নি । তৎকালীন রুশ নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন খোদ সম্রাটের চাচা গ্র্যান্ড ডিউক আলেক্সিস ।
ওদিকে পোর্ট আর্থারের অবস্থা ক্রমেই লেজে গোবরে হয়ে যাচ্ছিলো রুশদের জন্য । অ্যাডমিরাল তোগোর কমান্ডে ছিল হাতসুকে, শিকিশিমা, আসাহি, ফুজি আর ইয়াশিমা আর ফ্ল্যাগশিপ মিকাসা এই কটা ব্যাটলশিপ বা প্রথম ডিভিশান । সাথে আরো ছিল ইওয়াতে, আজুমা, ইজুও, ইয়াকুমো আর তোকিওয়া ক্রুইজারগুলো যেগুলো ছিল সেকেন্ড ডিভিশানের অন্তর্ভুক্ত ।
বিপরীত দিকে পোর্ট আর্থারের সুরক্ষিত পোতাশ্রয়ে ছিল পেত্রোপাভলস্ক, পোবেদা, সেভাস্তোপোল, পোল্তাভা, জারেভিচ আর রেতজিভান এই কটা ব্যাটলশিপ । এদের সাথে ছিল পাল্তাদা, দিয়ানা, নোভিক, আস্কোল্দ আর বয়ারিন এই কটা ক্রুইজার ।
আট তারিখ রাতের হামলায় জাপানী ট্রপেডো পালাদা আর রেতজিভানকে আঘাত হানবে । ব্যাটলশিপ রেতজিভান ছিল রুশদের সবচেয়ে শক্তিশালী জাহাজ এটাকে ঘায়েল করে জাপানীরা রুশদের শক্তি বলা যায় এক ধাক্কায় বেশ কমিয়ে দিয়েছিল ।
তবে রাত দুটোর দিকে রুশরা পুরো জেগে পাল্টা হামলা চালাতে শুরু করেছিল । আজব ব্যাপার হচ্ছে সে দিন বন্দরের আশপাশে কোন টহল রাখা হয় নি । এতো গুলি জাহাজ নিয়ে তোগো এতো কাছে চলে এলেন কারও তেমন চোখে পড়ল না !
পরসিন সকাল আটটার সময়ে অ্যাডমিরাল তোগো তাঁর সহকারী ভাইস অ্যাডমিরাল শিগেতো দেওয়াকে চারটে ডেস্ট্রয়ার সহ পাঠালেন পোর্ট আর্থারের ক্ষয় ক্ষতি নিজের চোখে দেখে আসার জন্য ।
দেওয়া, সকাল ন'টার দিকে বন্দরের কাছাকাছি এসে সকালের কুয়াশা ভেদ করে যাখলেন তাতে তাঁর মনে হলো যে বন্দরে প্রায় বারোটার মত বড় যুদ্ধজাহাজ আছে যার তিন চারটে খারাপ ভাবে উল্টে আছে আর বন্দরের বাইরে যেসব ছোট জাহাজগুলো আছে সেগুলোর খুবই বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে ।
দেখে দেওয়ার মনে হলো (স্বভাবসুলভ ভাবেই দেওয়ার চারটি জাহাজ রুশদের চোখে পড়েনি বা তারা বা তাদের চোখে পড়লেও তারা কোনো ব্যাবস্থা নেয় নি ) রুশ নৌবহর খুবই আঘাত পেয়েছে গত রাতের হামলায় এবং তিনি খুব দ্রুত জাপানী নৌবহরের দিকে ফিরে তোগোর কাছে রিপোর্ট করে বললেন এখনই আবার হামলা চালালে রুশ নৌবহরকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে । দেওবা যেটা জানতেন না যে রুশ নৌ বহর নিজেদের গুছিয়ে এনে পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরী হচ্ছে ।
দশটার দিকে আবারও পোর্ট আর্থারের দিকে এগিয়ে এল জাপানী নৌ বহরের প্রথম ডিভিশন । সাত হাজার গজ দূর থেকে রুশ জাহাজ বয়ারিন তোগোর জাহাজ মিকাসার দিকে গোলা বর্ষন করতেই তোগো বুঝলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে । বারো ইঞ্চি কামান গুলো সব মাটিতে বসানো কামানের ব্যাটারিগুলোর দিকে তাক করে বাকি ছয় আর আট ইঞ্চি কামানগুলো রুশ জাহাজের দিকে ফেরানোর হুকুম দিলেন তোগো ।
কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ বাদেই আরেকটা শেল এসে মিকাসার চিফ এঞ্জিনিয়ার সহ পাঁচজন ক্রুর মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ালো । বারোটা বিশের দিকে তোগো জাপানী নৌবহরকে ফিরে চলার হুকুম দিলেন । আঠারো ঘণ্টার লড়াইতে দেড়শো জন রুশ আর একশো বত্রিশ জন জাপানী নিহত হয়েছিল ।
মার্চের আট তারিখে রুশ অ্যাডমিরাল স্তেপান মাকারভ এসে আগের অ্যাডমিরাল স্তার্কের কাছ থেকে কমান্ডের ভার নিলেন । রুশরা যথেষ্ট উজ্জীবিত হয়েছিল নতুন রুশ নৌ সেনাপতিকে দেখে, মার্চের দশ তারিখে তিনি পাল্টা রুশ আক্রমনের নেতৃত্ব দিলেও ফলাফল সেই শুন্যই রয়ে গেল ।
কিন্তু বিধি বাম, পরের মাসেই মাকারভ তাঁর জাহাজ পেত্রোপাভলস্ক একটা মাইনের আঘাত পেলে সলিল সমাধি লাভ করলেন । রুশ পূর্বাঞ্চলীয় নৌ বহরে আবার হতাশা নেমে এল । অ্যাডমিরাল ভিলহেল্ম ভিটগেফ্ট ( রুশ সশস্ত্র বাহিনীর একটা উল্ল্যেখযোগ্য অংশ ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভুত রুশ) কমান্ডের দায়িত্ব নিলেন ।
অ্যাডমিরাল ভিটগেফ্ট এরও বরাত খারাপ, কারন এর পরের মাসেই জাহাজের ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে একটা জাপানী শেল এসে পড়ায় তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যায় । আবারো কান্ডারী বিহীণ হয়ে পড়ে রুশ প্রাচ্য অঞ্চলের নৌ বহর । তবে তোগো খুব একটা শান্তিতে ছিলেন না, তাঁর বহরের দুটো ব্যাটলশিপ ( যেগুলো সবচেয়ে ভারী ও শক্তিশালী জাহাজ, যেগুলোকে "ক্যাপিটাল শিপও বলা হতো) হারিয়েছেন ।
পোর্ট আর্থারে ঘাঁটি গেঁড়ে বসা রুশ নৌবহরকে বের করে এনে খোলা সাগরে লড়াই করে তাদের ঘায়েল করার পরিকল্পনা বাদ গেছে । এবং অবশ্য্গি তিনি জানতে পারছেন আরেকটা রুশ নৌবহর যত দেরীতেই হোক প্রশান্ত মহাসাগরে চেহারা দেখাবে এবং তাদের সাথেও লড়তে হবে তোগোর জাপানী নৌ বহরকে ।
ওদিকে, মাটিতে রুশ সেনা বাহিনীর ভাগ্য একই রকম নেতিবাচক ছিল । মে মাসেই জাপানী সেকেন্ড আর্মির জেনারেল ইয়াসুকাতা ওকু লিয়াওদং উপদ্বীপে সৈন্য অবতরণ করালেন ও নানশানে যুদ্ধে কিনচৌ দখল করে নিলেন । জেনারেল মারেসুকে নোগির থার্ড আর্মি কোরিয়াতে নামল আর জেনারেল মিচিতসুতা নোদজু, মাঞ্চুরিয়ান উপদ্বীপে সৈন্য চালনা করলেন । মে এর এক তারিখেই স্থল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তামেমোতো কুরোকি, ইয়ালু নদীর ওপাশে উইজি শহরের রুশদের প্রধান ঘাঁটির দখল নিলেন ।
ছবি ১: যুদ্ধের প্রথম দিকে
ছবি ২: জেনারেল কুরোকি দূরবীন দিয়ে ইয়ালুর নদীর অপরপার পর্যবেক্ষণ করছেন