এই অভ্যার্থনা স্মৃতি নিকোলাসের মনে ছিল এবং তা এক সময়ে ফ্রান্সের কাজে আসবে । এমন কী একবছরের ওলগাকে দেখেলেও মানুষ 'Vive la Bebe!' (বাচ্চা জিন্দাবাদ!) বলে চেঁচামেচি করত । নিকোলাস প্যারিসে তৃতীয় আলেকজান্ডার সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন । তারপরে ট্রেনে করে জার্মানির মধ্যে দিয়ে রাশিয়া ফিরলেন ।
দেশে ফিরে যে কাজটা তিনি জীবনে সবচেয়ে ভয় পেতেন সেটায় জড়িয়ে পড়লেন মানে শাসন কাজ এখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখা শুরু করলেন । প্রথমে তিনি মারিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতেন কিন্তু তারপরে নিজেকেই পুরো কাজের ভার নিতে হলো । এবং সে ব্যাপারে সমস্ত কাজ আবার নিজ দায়িত্বে করার পক্ষপাতী ছিলেন নিকোলাস ।
নিকোলাসের উপর কর্তৃত্ব খাটাতেন তাঁর দুই চাচা, আলেক্সিস আর ভ্লাদিমির । আলেক্সিস ছিলেন রুশ নৌবাহিনী গ্র্যান্ড অ্যাডমিরাল ও দ্বিতীয়জন একজন সিনিয়র গ্র্যান্ড ডিউক । অন্যসব লোকের উপস্থিতিতে তাঁরা সম্রাটকে মান্য করতেন । কিন্তু যেই নিকোলাসের স্টাডির দরজার বন্ধ হয়ে যেত অমনি ঠাস করে ডেস্কের উপরে বিকট চাপড় মেরে লেকচার শুরু করে দিতেন আলেক্সিস । এ দু'জনের সাথে একা থাকতে খুবই অস্বস্তি বোধ করতেন নিকোলাস ।
শুধু সাম্রাজ্য চালানোই নয়, নিকি আবার পদাধিকার বলে তাঁর বিশাল পরিবারের কর্তাও ছিলেন । ১৯১৪ সালের হিসাব যদি ঠিক হয় তবে তখনকার মুল্যমানে নিকোলাসের ব্যাক্তিগত সম্পদের পরিমান ছিল পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার বা তার কম বেশী কিছু, এর মধ্যে ছিল আবাদী জমি, ফলের বাগান, খনি, শিল্পের শেয়ার । আরো ছিল আশি মিলিয়ন ডলার মু্ল্যমানের মুল্যবান পাথর যা রোমানভরা তাদের তিনশৌ বছরের শাসনে জমিয়েছিল । ১৮৯৫ সালেই নিকোলাসের রোজগার বছরের প্রায় বারো মিলিয়ন ডলার । কিন্তু রাবণের বংশকে প্রতিপালন করার পরে দেখা যেত বছর শেষে সম্রাটের হাত খালি ।
সাতটা প্রাসাদ ও পনেরো হাজার চাকরবাকর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ । সম্রাটের নিজস্ব ট্রেন , ইয়াট, তিনটে থিয়েটার, অ্যাকাডেমি অভ আর্টস ও ব্যালে । প্রত্যেক গ্র্যান্ড ডিউক এক লাখ ডলারের পরিমান ভাতা পেতেন, সমস্ত গ্র্যান্ড ডাচেস বিয়ের সময় পাঁচ লাখ ডলার । এছাড়াও হাসপাতাল, অনাথ-আশ্রম আর ইস্কুলে যেত টাকা । (কেন এই তহবিল সরকারের অন্য কোনো দফতর দেখত না এক রহস্যের ব্যাপার) ।
এবারে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক । কেবল রাজ পরিবারের রকম-সকম নিয়ে থাকলে তো আর রুশ দেশের সব হাল-হকিকত জানা যাবে না ।
১৮৮৭ সালে জার আলেকজান্ডারকে মারতে গিয়ে 'নারোদনায়া ভলিয়া' এমনই পাল্টা মার খায় যে পুরো সংগঠনের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে । কয়েকশো সক্রিয় সমর্থক আর আর হাজার দুয়েক কর্মীর একটা বড় অংশ আটক হয় । যারা এই চিরুনি তল্লাশীর বাইরে থাকতে পেরেছিল তাদের আর সাংগঠনিক কাজ কর্ম চালিয়ে যাবার অভিরুচি বেশিদিন থাকেনি । তাঁরা সব নিজের গোছাতে থাকেন নয় তো নতুন একটা দল গঠনের পরিকল্পনা করতে থাকেন । নতুন দলের নাম হয় সোশ্যা রেভোল্যুশনারি পার্টি বা 'এসআর' (তাদেরকে আক্ষরিক অর্থেই 'এসার' বা 'নারোদনিকি' বলা হতো) । আগের মার-মার-কাট-কাট নীতি খানিকটা পরিবর্তন হয় ।
আসলে তখন রাশিয়াতে কোনো রাজনৈতিক দলই বৈধ ছিল না । নির্বাচন ছিল না (একবারে স্থানীয় পর্যায় 'জেমস্তভো' নির্বাচন হতো), ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না, প্রেসের স্বাধীনতা ছিল না । মানে ঊনিশ শতকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে (মুলতঃ পশ্চিম ইউরোপে) যেসব স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তার ছিঁটেফোটা রাশিয়াতে এসে পড়েছিল । সব দলই যদি আন্ডারগ্রাউন্ড হয় তাহলে সন্ত্রাসবাদ চর্চা করতে দোষ কী? পরিস্থিতি আরো বেশী খারাপ হতে তাঁরা অনেকেই দেশান্তরী হয়ে পড়েন ।
এসআর বা নারোদনিকদের গোড়া আসলে ১৮৬১ সালে । যখণ জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সার্ফদের মুক্ত করার প্রয়াস চালান । নারোদনিকদের মুল ধারাটা ছিল পপুলিস্ট ধাঁচের, জারের সংস্কারে তারা খুশি হতে পারেনি । তাদের ধারনা ছিল খুব কম স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তাদের এবং এতে ধনী কৃষক বা 'কুলাক'দের প্রাধান্য গেছে বেড়ে । তাই প্রান্তিক চাষীদের মুক্ত করার জন্য আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে । এরকম আন্দোলন নেতৃত্ব অবশ্যই দেবে শহুরে বুদ্ধিজীবিরা!
আরো একটি আন্দোলন ছিল এদের বিপক্ষে, সেটা ছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের । সেটাও অবশ্য জার্মান মডেলে ছিল । বিসমার্ক, জার্মান সাম্রাজ্যেকে একীভুত করার পরে সংসদীয় গনতন্ত্রের যে সীমিত চর্চা করেন তা থেকেই জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের আত্ব-প্রকাশ । নিখিল-ইউরোপীয় বামেরা জার্মানদের সঙ্গত কারনেই গুরু মানতেন ।
কার্ল মার্ক্স ১৮৬৭ সালে ডাস কাপিটাল প্রকাশ করেন । আজব ব্যাপার হচ্ছে রাশিয়ার মতো একটা ভয়ানক সেন্সরশিপআক্রান্ত দেশে সেটা অনুবাদ হয় ১৮৭২ এর দিকেই! (বইটা অর্থনীতির পাঠ্যবই হিসেবে দেখানো হয়েছিল!) । আর সেন্সর দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা স্কুরাতভের উক্তি 'খুব কম লোকই এটা পড়বে এবং আরো কম লোকে এটা বুঝবে (!?!)' এমন দুরূহ বিষয়ে, এমন কঠিন ভাষায় লেখা জাম্বো সাইজের কেতাব!
ভুল । তিন হাজার কপি এক বছরের মধ্যে বিক্রি হয়ে প্রমান করল এ বই পড়ার লোক আছে । ১৮৮০ সালের দিকে রাশিয়াতে সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়্যে বেশি সংখ্যক মানুষ 'পুঁজি' বইটা পড়ে ফেলেছে । একথা জানা দরকার যে প্রথম টিকা সমৃদ্ধ ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে ১৮৮৭ সালে, মার্ক্সের মৃত্যুর চার বছর পরে !
১৮৮৪ সালে কতিপয় বুদ্ধিজীবি 'জনগনের মুক্তি' নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনের চেষ্টা চালাতেই গ্রেফতা হয়ে যান । এই দলে ছিলেন গেওর্গি প্লেখানভ, পাভেল আক্সেলরোদ প্রমুখ জনহৈতিষী ব্যাক্তিবর্গ ছিলেন এতে । নিন্দুকেরা বলে সংখ্যাঅয় না কি তিন হালিও হবে না এই সংস্থার প্রাথমিক সদস্যদের সংখ্যা । তবে এদের মধ্যে থেকেই রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের জন্ম হবে । পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল । 'নারোদনিকি' দের সবচেয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, এদের আদর্শিক ভিত্তিতে মার্ক্সবাদ ক্রমেই বেশি বেশি করে স্থান পাবে ।
রাশিয়া সেসময়ের মান বিচারেও সাংঘাতিক রকমের জাতিগত বিদ্বেষপুর্ণ একটা দেশ । জাতিগত 'বিশুদ্ধতা' রক্ষার চেষ্টা তখন থেকই শুরু যেটা বিশ শতকের ফ্যাসিবাদকে উস্কে দেবে ।
মধ্য এশিয়া ও ককেশাসের বাসিন্দারা দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক, ইহুদিরা বেশিরভাগ অচ্ছ্যুত ও সংরক্ষিত অঞ্চলে আবদ্ধ । ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া এসব পুরোটাই রাশিয়ার অঙ্গীভুত, পোল্যান্ডে খানিকটাও ঢুকে গেছে রুশ দেশে । এবং এদের সবাই অন্তত ভাষাগতভাবে রুশ বানানোর চেষ্টা চলছে ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই ।
রুশ সাহিত্যের দুই প্রধান দিকপাল, দস্তয়েভস্কি আর তুর্গেনেভ গত হয়েছেন ১৮৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে । আন্তন চেখভ তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্য জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন । মামিন সিবিরিয়াক ও অন্যান্য উদীয়মান গল্পকার পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালাচ্ছেন । তলস্তয় ব্যাস্ত আধ্যাত্বিকতা নিয়ে । তবে ককেশাস থেকে একজন তরুন লেখকের নাম ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে । তার নাম আলেক্সান্দার পেশকভ, কিন্তু মাক্সিম গোর্কি ছদ্মনামেই তিনি লিখে থাকেন বেশিরভাগ সময়ে । এই প্রথম সমাজের নীচের তলার মানুষের ছবি কোনো রুশ লেখক অসংকোচে আঁকছেন বাস্তবের ক্যান্ভাসে । মানুষের সম্ভাব্যতা বা 'লিচনোস্ত' তাঁর লেখার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকছে ।