নিহত বিকেলের শোকমাতম করি। লালিমাকে মনে ধরেছিলো খুব। একা রুমে পোকাদের সহবাস। রাত বাড়ছে; এখনো যৌবনবতী হয়ে উঠেনি ঠিক। আরেকটু পরেই বৃদ্ধারাতের শেষকৃত্য করে চলে যাবে মহাকাল। শতাব্দীতে যোগ হবে অকালপ্রয়াত আরেকটি দিন। একা নই; সঙ্গ দেয় টিউবলাইটআলো, মৃতটেলিভিশন, বালিশের রাতজাগাআর্তনাদ, ল্যাপটপ, নোটবুক আর কলম। শুভ্রতার এমন অব্যবহারে মুগ্ধ নই। শুভ্রতা হবে আকাশ, আকাশের মেঘমরণ দৌড়াদৌড়ি; হোটেলকামরায় এমন শুভ্রতার নিকুচি করি। সাদাক্যডস ব্যঙ্গ করে তুমি শুভ্রতাপ্রিয় নও হে নিষ্ঠুর কলমবাজ। সঙ্গে শুভ্রটিশার্ট; শুভ্রতার নিত্যযাতায়াত। আছে সিগারেট পোড়াছাই, আছে হাতব্যাগ টাকা নাই। চিরুনি টুথব্রাশ, ওয়ারড্রবে সাদা সাদা হাহাকার। কালো আছে, আছে আলো, আলোর নিত্যআনাগোনা। আছে নির্ঝরদার ছোটকাগজ মুক্ত্যগদ্য, আছে বোধের অসীমে কিছু নাবোধের নিক্কননুপুর। গিলছি কাগজের কালি, গিলছি মুক্ত্যগদ্যের মুক্তচিন্তা, বুঝিনাই অসীমের জীবনাবসান, এমন কঠিন তুমি করিলে নির্মাণ। ভালোবাসিলাম এমন কঠিন জীবনেরে হায়! আছে কবি সুস্মিতা রেজা খানের সদ্যপ্রকাশিত কবিতার বই, মলাটের ভাজে মায়াবতীছায়াবতী আশ্রয়। পেজগি। পেজগি কি তবে আমাদের নিত্যদিনের খুনসুটি হবে! পেজগি যেনো কি। ওটা হলো কবিতার সরল বিন্যাসে গরলের অনুপস্থিতি। কিংবা আরো কিছু কিংবা কিছুই না এটা। কিংবা এটা সবকিছু, যা কিছু ভালোলাগা মন্দলাগা। হিরণ্ময় নীরবতা ভাঙছে পার্শ্ববর্তী ঘরের চৌকাঠ। আছে চৌকাঠের সীমানা ও সীমানাহীনতার যুগলবন্দী—চৌকাঠও। অনুগল্পের কাগজ। অকেজো টেলিফোনসেট, অকেজো মানে অব্যবহৃত। ব্যঙ্গ করে দাতালোদাঁত, গোলগোল চৌকোনা বাটন। সেলফোনে পড়ছি হারানোসময়, বন্ধুদের দরদমাখা এসএমএস। সকলকিছুই পালাচ্ছে দ্রুত। সবকিছু ভাঙছে নিয়মমত।
শূন্য চেয়ারে বসে আমার ছায়া। ড্রেসিং-আয়নায় রাতজাগা বিকৃত আমার মুখাবয়ব—বিশ্রী কদাকার। সাদা বিছানা উদ্ধত আমাকে টানেনি, পারেনি নিতে তার অমল বিন্যাসের ভাঁজে, মানেনি কলম আমার হারাতে এমনও রাতে। টেলিভিশনের জীবিতকাতরতা; জেগে উঠে অনিচ্ছের ঘারে ইচ্ছের ঘুড়ি; ঘূর্ণন। ছড়াচ্ছে কোটিবার দেখানো বিজ্ঞাপনের ঢামাঢোল। মানিব্যাগে স্তূপাকার এই জনমের সকল দেনাদরবার। একটা ভিজিটিং কার্ড ভুলে গেছে তার মালিকের নাম, আজ রাতে তাকে গর্দান দেবে মহামান্য মালিক। আর রাত বাড়ে; বাড়তে বাড়তে বৃদ্ধার হাতের লাঠি; অবলম্বন এক। দৌড়চ্ছে ক্রমশ। রিমোটের বাটনে একটাও আগুনবাটন নেই কেনো। আমার আগুন দরকার আজ। টেবিলে গড়ানো দেশলাই কাঠি আর্তনাদ করে উঠে—হে বন্ধু কেঁদো না এভাবে, কেঁদো না আর; আমরাতো আছি তোমার দহনসাথী, তোমার পোড়াকাল। কাঁদিনি; কেঁদেছিলো আমার কলম। কেঁদেছিলো দেয়ালে টাঙানো মৃত দেয়াল ঘড়িটাও। সময়ের চলে যাওয়া দেখি সেলফোনের স্ক্রিনে—দুই তিন চার ক্রমশই গাঢ়তর!
আজকে আমার লাল-আনন্দ চাই, একটা ও নাই। নাই টিভিতে যৌনাঙের দেমাগি প্রদর্শন, নেই হলুদফুলের খোঁপাওয়ালা তন্বীর ঘ্রাণ; মনোলোভা, মনোহরী। রাতটা বিশ্রী কাটছে কি; মনে হয় না। বরঙ আজকের রাতটা অন্যরকম, ভিন্নরকম। আজকে একুশে ফেব্রুয়ারি; আজকে বাঙালীর প্রাণে শোকের মাতম, আজকে তাহাদের প্রাণের মাতম। মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যের বেসাতি।
এশট্রেতে ছাই জমে, মনেতে বিষাদ; তৃষ্ণা চায় আমাকে ছুঁতে আমি অবিষাদ। বিষাদ দাও হে রাত্রির সহোদরা। বিষাদ দাও হে নগ্নতমা অন্ধকার। খুলে দেখি ক্লথস্ট্যণ্ডের গায়ে ঝুলে আছে বিষাদ রাশি রাশি। হে পবিত্র বিষাদ, হে অমৃত বিষাদ, তোমাকে অভিবাদন, অভিবাদন তোমাকে। রাত্রির যশোর, তোমার মধুমায়ায় মরেছি কি কোন জন্মান্ধ কবি; মরেনি নিশ্চয়। কিংবা জ্যোৎস্নার অমলধবল ঘ্রাণে মেতেছি কি কোন সুপুরুষ যুবা, না মাতে নাই। তোমার কিছু নাই, কিচ্ছুটি নাই। তোমাকে ফিরিয়ে দেবো রাত্রির এই গাঢ় প্রতিশোধ, বাংলাসিনেমার শেষদৃশ্যের আশ্রিত স্থিরচিত্র।
আণ্ডারয়ারে ছড়ানো ঘাম ঘরময়। যেনো যৌনতার প্রতিরোধ ভেঙে মাতাল হচ্ছে দেহাতীত কাম। কাম সেতো নির্জনতার নিঘুঢ়ছায়া। নির্জনতা আর কাম পরস্পর বন্ধু খুব।তবে কি মানুষ নগ্ননির্জনতার গায়ে আঁকে কলঙ্কের কালিমা। গামছাটি ঝুলছে তার সনাতন ঢঙে। ভাবি, বিবির কথা। বিবি রাসেল। আহা বিবি, তুমি কেনো গামছাকে মডেলের শরীরে জড়ালে মোহনমায়ায়। ও তো বস্তু এক, কাজে লাগে ক্লান্তিনাশে, শ্রান্তিনাশে। তবে কেনো পরালে তাহাতে মাদকতার নীলনীলবীষ, আহত মানুষমন। বুকের খাঁজের থেকে তুলে আনি লোবানের মনোহরী ঘ্রাণ—মানুষের সুগন্ধি জীবন।
মশারী ও মশা বন্দিজীবী বালকের দল—কাঁদাচ্ছে আমাকে আমার কলম। কে জানে এই শহরে কি আছে বিখ্যাত। আমি জানি, এইখানেও আছে রোদের করোটিতে ছায়াদের নিত্য আসা-যাওয়া, আছে বিছানার নরোম আরাম। আছে লক্ষ ধুতুরাফুলের বাগান। আর আছে সে; রাতজাগা আমাকে যে মন্ত্র দেয় না ঘুমানোর। গল্প লিখো হে বিষণ্ণ বালক, হে বিষণ্ণ যু্বা। আমার কোন গল্প নেই হে যশোরের রাত্রি। নেই বিমূর্ত কথকতার মাদকীয় নীল। রাতজাগা গল্পহীনতায় জেগে থাকে আমার আক্ষেপ, আমার প্রার্থনা। গল্প দাও হে যশোরের হোটেলকক্ষে আটকে থাকা বদ্ধসময়, বন্দীসময়। আমাকে দাও আমার প্রাণবায়ু। নিতান্ত দাও এক পেয়ালা ঘুমের সরাব, ক্লান্তিহীন ক্লান্তিতে আমাকে শ্রান্তি দাও কয়েক। কিংবা দাও ডানা এক পরিযায়ী পাখির । কিংবা ধরো দ্রাক্ষালতার দ্রাক্ষা গরল। ঘুম দাও হে ঘুমহরণী। নাশ দাও হে বিনাশের নগরী। বিনাশ দাও হে নগ্নতমা রাত। অন্ধকার দাও হে বিশাল আকাশ। জ্যোৎস্না ও জনকের সহবাস নেই ওখানে আজ। আছে কৃত্রিম কাঁচপোকাদের অবিশুদ্ধ বিশ্রী আলেয়া। আমি আজ ঘুমবো না হে নগরীর নর্তকী; আমকে সঙ্গ দাও, আমাকে রঙ্গ দাও পেয়ালা পেয়ালা।
মাঝরাতে নিজের ছায়াকে বিশ্রী বানরের মত লাগে কেনো। আয়না কি তবে ক্লান্ত হয়ে যায় সারাদিনের ফেরি করা দেখানোয়। হে আয়না, তোমার কাচ ভেঙে না হয় কাউকে পাঠিয়ে দাও অলৌকিক মানবী কোন কিংবা দাও জাদুবিদ্যার কুশ্রী দাঁতাল রমণী এক; হোক কিছুটা রমনলীলা। যে আমাকে আতঙ্ক দেবে ঘুমুনোর প্ররোচনায়। কিছুটাতো দাও, কিছুটাতো দাও। না হলে নিখাদ নিখাদ দাও ঘুম; ক্লান্তিহরী ঘুম, শ্রান্তিহরী ঘুম।
চোখের পাড়ে জমছে কালি ও কলম। কলম লিখছে তার নিত্য আসা যাওয়া। কালি ছেনে আমি ভাবি হয়েছি ঈশ্বর। মিরাকল খেলবো আজ নিজেরেই সনে। হে প্রেতাত্মা মানুষ, বেড়িয়ে আসো দেয়ালের অনুপরমানু থেকে—তোমাকে দেখাবো আজ আমার বিক্রম। পালঙ্কের নীচে শুয়ে থাকা হে পলাতক ঘুম; তোমাকে দেখাবো আজ আমার বীরত্ব।
আজ আমি ঘুমনাশী রাত, কাটছে আমাকে তাই ঘুমের করাত। কেটে কেটে ফালি ফালি করো হে নিদ্রাদেবী। নার্সিসাস দাও এনে হে মোহন বাগান। আজ আমি নার্সিসাস ফুলের ঘ্রাণে মাতাবো তন্ময়। পার্সিফোনির নিখোঁজ সংবাদ পড়ে পড়ে শিখেছি তোমার জাদুমন্ত্রকলা। আমাকে এনে দাও নার্সিসাস ঝাড়। আমি হারাবো আজ রাতের কৌলিন্যভাঙা অহমের ভিতর। গুটিসুটি লিখবো বিনাশের তন্ত্রমন্ত্রকথা। বিনাশ হোক পৃথিবীর নামুক আন্ধার। আন্ধার আমার নিয়তি তাই হাঁটছি ওপথে আবার। হে মহামান্য আন্ধার, তুমি বরণ করে নাও তোমার অতিথির ভার!