জামায়াতকে নিয়ে সরকারের আতঙ্কে কৌতুকবোধ করছি
বিশিষ্ট কলামিস্ট, নয়া কৃষি আন্দোলনের উদ্যোক্তা ফরহাদ মজহার বলেছেন, জামায়াত প্রশ্নে সরকারের বর্তমান অবস্থান নয়, বরং আতঙ্ক ও ভীতি দেখে কৌতুক বোধ করছি। নীতিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত দল ও সরকারের শূন্যগর্ভ আস্ফালন দেখছি। হাস্যকর। তামাশা ছাড়া আওয়ামী হুঙ্কার অধিক কোনো অর্থ বহন করে না। জামায়াত-শিবির ও সরকারের অবস্থান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ফরহাদ মজহার বলেন, ইসলামী ছাত্রশিবির এই সরকারকে ভিন্নভাবে মোকাবিলার কথা ভাবছে। আওয়ামী লীগ এত দিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়েছে, তারা পাল্টা এই সন্ত্রাস চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পাল্টা ক্ষমতার মুখোমুখিতে কে কতটা জিতবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
জামায়াত প্রশ্নে ফরহাদ মজহার বলেন, জামায়াত বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের অধীনে সংবিধানসম্মত ও আইনসিদ্ধ দল। নির্বাচন কমিশন জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র সম্পর্কে আপত্তি জানিয়ে তা বদলাতে হুকুম দিয়েছিল, জামায়াত তা অস্বীকার করেনি। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের যেসব ধারা-উপধারা সম্পর্কে আপত্তি তুলেছিল সেসব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিক থেকে খুবই ইন্টারেস্টিং। যেমন, আল্লাহ ছাড়া অপর কাউকে বাদশাহ্, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে মেনে না নেওয়া।
ফরহাদ মজহার বলেন, জামায়াত ও নির্বাচন কমিশন উভয়েরই ধারণা 'আল্লাহর সার্বভৌমত্ব' আর 'রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব' বুঝি সমার্থক। অতএব রাষ্ট্রকে আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা না করলে যেমন রাষ্ট্র 'সার্বভৌম' হয় না, তেমনি বুঝি আল্লাহকে রাষ্ট্রে স্থাপন না করলে সেখানে ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ইসলাম সম্পর্কে অনেক পণ্ডিত বলছেন, রাষ্ট্রমাত্রই একটি 'আধুনিক' ধারণা, ইসলামী রাজনীতির উদ্দেশ্য অতএব 'আধুনিক' রাষ্ট্র গড়া হতে পারে না, বরং ইসলামের নীতি ও আদর্শের জায়গা থেকে ভোগবাদী এবং আত্দকেন্দ্রিক সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। আসলে একটি ইসলামপ্রধান দেশে এ তর্কগুলোকে আমরা কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ক্রমাগত ইসলামের বিরুদ্ধে যে বিদ্বেষ, হিংসা ও কুৎসা প্রচার করে চলেছে তাতে বছরের পর বছর পার করে দিয়েছি আমরা, আগামী দিনে আরও মূল্য দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বিশিষ্ট এই কলামিস্ট বলেন, জামায়াতের গঠনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশন যেসব আপত্তি তুলেছিল তার মধ্যে রয়েছে- ১. ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষার প্রচেষ্টা চালানো ২. দায়িত্বশীল নাগরিক এবং চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠন ৩. সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস এবং গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা ৪. ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, ইত্যাদি। এর একটিও গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি বলেন, জামায়াত এসব প্রস্তাব অস্বীকার করেছে বলে আমি কোনো খবর দেখিনি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন মেনেই জামায়াত রাজনীতি করতে চায়। এ ক্ষেত্রে জামায়াতকে মোকাবিলা করার একমাত্র পথ হতে পারে আদর্শিক। তার ওপর জুলুম নয়।
ফরহাদ মজহার বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করা যে কোনো নাগরিকেরই সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার। কিন্তু সরকার জামায়াতসহ সব বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সহিংস হামলা ও নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে। ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধী দলকে রাস্তায় নামতে দেয়নি বললেই চলে। ফলে একটা লেজে-গোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কুৎসিত রূপ নিয়েছে। বিরোধী দলের সাংবিধানিক ও মানবিক অধিকার ক্ষুণ্ন করলে তা নিজের জন্য আত্দঘাতীই হয়। বিরোধী দলের জন্য কোনো আইনি স্পেস বা জায়গা দিতে আওয়ামী সরকার অস্বীকার করায় বিরোধী দলকে ভিন্নভাবে ভাবতে হয়েছে। মনে হয় সেটা জামায়াতে ইসলামীর ওপরের স্তরের নেতৃত্ব যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি তরুণরা- বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবির এ সরকারকে ভিন্নভাবে মোকাবিলার কথা ভাবছে। আওয়ামী লীগ এত দিন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়েছে, তারা পাল্টা এই সন্ত্রাস চ্যালেঞ্জ করছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আর পাল্টা ক্ষমতার মুখোমুখিতে কে কতটা জিতবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দুর্নীতি ও দুঃশাসন থেকে জনগণ মুক্তি চায়। আওয়ামী লীগের ভারতনীতির পক্ষে নয় অধিকাংশ মানুষ। খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক দিলি্ল সফরের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই দিক থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শরিয়া আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার উক্তি। সরকার এ ধারণাই দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে তারা বিচার নয়, যেভাবেই হোক অভিযুক্ত কয়েকজনকে ঝুলিয়ে দিতে চায়।
ছাত্রশিবিরের সহিংস হামলায় পুলিশের মধ্যে যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে তা আপনি কীভাবে দেখছেন- এ প্রশ্নে ফরহাদ মজহার বলেন, আগের প্রশ্নের উত্তরে রাজনৈতিক বাস্তবতার যে ছবিটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি সেদিকে নজর রাখলে এটা বোঝা কঠিন হবে না যে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের পক্ষে জনগণের একটা বড় অংশের সায় আছে। আমার মনে হয় না ছাত্রশিবিরের কর্মীরা পুলিশকে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। কিংবা পুলিশ খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ সরকারের সময় শেষ হয়ে গেছে, এটা বুঝতে পুলিশের খুব কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ফলে তারা এ সরকারের জন্য ব্যক্তিগত ক্ষতি করতে রাজি নয়। হয়তো বা ছাত্রশিবিরের মূল টার্গেট যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী। পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যখন তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে নামাতে বাধ্য হবে, তখন পুলিশকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। এটাই রাজনীতির নতুন উপাদান বলে আমার মনে হয়। এর ফল কী দাঁড়ায় এখনই বলা সম্ভব নয়। দলীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শিবিরের ভূমিকা কী, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বলা হচ্ছে পুলিশের মধ্যে 'আতঙ্ক' বিরাজ করছে। তাই কি? এত দিন এই পুলিশ যখন কাউকে ঘরে বসে মিটিং করতে চাইলেও দেয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড্রয়িংরুমে বসে লোকজনের সঙ্গে কথা বললেও পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, তখন আমরা কেউই উদ্বিগ্ন বোধ করিনি। আওয়ামী লীগের এই নীতিকে এরা সমর্থন করে গেছে। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে করেছি আমরা। এখন আসলে পুলিশের মধ্যে আতঙ্ক নাকি আমরা ভুয়া নীতিবিবর্জিত লিবারেল বা ভদ্রলোকেরা আতঙ্কিত?
জামায়াত বিষয়ে বর্তমানে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেন, এক কথায় বললে, সুবিধাবাদী। বিএনপি ধরে নিয়েছে ক্ষমতায় যাওয়া তার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলে সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। কিন্তু রাজনীতি সরল রেখায় চলে না। ভারতনীতির কারণে বিএনপির ভাবমূর্তির যে ক্ষয় হয়েছে তার ফল কী দাঁড়াবে, আমরা এখনো জানি না। কিন্তু ইতিবাচক হবে বলে আমি মনে করি না।
তিনি বলেন, বিএনপি যেটা করছে বা বিএনপির মধ্যে যেটা ঘটছে সেটা হলো বিএনপির আওয়ামীকরণ। তবে সমস্যাটা নিছক আওয়ামীকরণের নয়, ইন্ডিয়া যেভাবে ইসলাম প্রসঙ্গকে দেখে ও ডিল করে এবং আওয়ামী লীগকেও সাজায়, সেই নীতি ও কৌশল কাজ করছে না। চূড়ান্তভাবে এটা ইন্ডিয়ার জন্যই অকেজো প্রমাণিত হয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির আওয়ামীকরণ রাজনৈতিক মশকরাতে পর্যবসিত হবে। তা ছাড়া অন্য দিকে দেখুন, জামায়াতের রাজনৈতিক পদক্ষেপের দায় এবং সব ক্রেডিট জামায়াতেরই, বিএনপির নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এটা যখন প্রকাশ্যে বিএনপি বলার দরকার বোধ করে তখন বিএনপি নিজের ক্ষতি করে, কারণ জামায়াতের পক্ষে জনগণের একটা অংশকে ঠেলে দেয়। অনেকে আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন। আপনি কী মনে করেন- এ প্রশ্নে ফরহাদ মজহার বলেন, এখন পরিস্থিতি আলাদা, ফলে ওয়ান-ইলেভেনের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা এখনকার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝব না। যদি এই কথা বলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না সেই ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন, তাহলে সেটা হতেই পারে। কিন্তু মনে হয় সেটা সুশীল সমাজের সমর্থিত সেনাবাহিনী হবে না। কোনো একজন সেনাপ্রধানের কমান্ডের গুণে বা অধীনে সাধারণ সৈনিকেরা দেশের ক্ষমতা নিয়ে নেবে, সেই পরিস্থিতি সেনাবাহিনীতে আছে কি না সন্দেহ। বিডিআর বিদ্রোহ ও আরও নানা কারণে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। এই জটিলতা মতাদর্শিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ছাড়া শুধু সেনাশৃঙ্খলা দিয়ে অপসারণ করা যাবে না। তা ছাড়া 'আরব বসন্ত' নামক যেসব রাজনৈতিক বদলের ঘটনা এ দেশের তরুণরা তিউনিসিয়া, মিসর থেকে শিখেছে তার প্রভাবও আগামী দিনের রাজনীতিতে থাকবে।
ফরহাদ মজহার বলেন, শিবিরের তরুণদের মধ্যে আরব স্প্রিং, আমেরিকান সহায়তায় মুরসি ধরনের ক্ষমতা গড়ার ঝোঁক আছে। প্রোগ্রাম আমেরিকার রযন্ড প্রজেক্টটা এটাই; ইয়ুথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম এরই অংশ। এগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন উপাদান। শিবিরের এখনকার ভূমিকায় আমেরিকার সমর্থন থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকরা জামায়াতে ইসলামীকে যতই সন্ত্রাসী বলুক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে সেভাবে দেখে না। আওয়ামী প্রচারণা কাজ করে না। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪.১১.২০১২