২য় পর্ব
আমি মিসরের জনগণকে অভিনন্দন জানাই। আমার অভিনন্দন এই যুবকদের প্রতি, যারা বিপ্লবকে সফল করেছে। কারণ তারাই আমাদের মাথাকে সমুন্নত করেছে তাদের গৌরবদীপ্ত কাজের মাধ্যমে। এই যুবকরাই বিশ্ববাসীর সামনে তৈরি করেছে একটি অসাধারণ উদাহরণ। আমি এই যুবকদের বিবেচনা করি সহায়তাকারী হিসেবে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র গ্রন্থে বলেছেন, ‘ওদের দাবিকে অগ্রগণ্য করে নিজেদের ওপর, যদিও নিজেরা উপবাসী’। সূরা হাশর, আয়াত ৯)।
যারা সমাজে সাহায্যকারী হিসেবে আবিভূêত হয় তারা নানাভাবেই মানুষের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করে। এদের কেউ কেউ নিজেরা না খেয়ে তার আরেক ভাইকে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়। এদের কেউ কেউ নিজেরা কঠোর পরিশ্রম করে যাতে তাদের আরেক ভাই একটু বিশ্রাম নিতে পারে। এদের কেউ কেউ সারা রাত জেগে থাকে যাতে তার আরেক ভাই একটু ঘুমাতে পারে। মিসরের এবারের এই বিপ্লবে যুবকেরা এ ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এরাই মিসরের সম্পদ, মিসরের গর্ব।
আমি মিসরের এই যুবকদের প্রতি আহ্বান জানাই, তাদের সেই চেতনা ধরে রাখার জন্য। কারণ বিপ্লব এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বিপ্লবের সুফল পাওয়া কেবল শুরু হয়েছে। কখনো ভেবো না যে বিপ্লব শেষ হয়েছে। মনে রাখবে বিপ্লব চলছে। কারণ আমরা নতুন এক মিসর বিনির্মাণে অংশগ্রহণ করব, যে মিসর এই বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছে। এই বিপ্লব নিয়ে তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং এটাকে লালন করতে হবে। সতর্ক থাকবে যাতে কেউ এটাকে তোমাদের কাছ থেকে চুরি করে বা ছিনিয়ে নিতে না পারে। এই বিপ্লবকে সতর্ক পাহারায় রাখো। সতর্ক থাকো সেই ভণ্ডদের বিরুদ্ধে যারা নতুন মুখোশ পরে, নতুন বুলি নিয়ে প্রতিদিন তোমাদের সামনে হাজির হবে। তোমাদের কাছে নতুন নতুন কথা বলবে। ‘ওরা বিশ্বাসীদের কাছে এলে বলে, আমরা ঈমান এনেছি, আর নিভৃতে পাণ্ডা দলে ভিড়লে বলে, আমরা তোমাদের দলের, ওদের সাথে মজা করি মাত্র’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৪)। গতকাল তারা ছিল বিপ্লবের বিরুদ্ধে, আজ তারা বিপ্লবের পক্ষে। এই লোকদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থাকো। যুবকদের আমি বলি¬ তোমরা তোমাদের বিপ্লবকে সুরক্ষা দাও, এ ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকো এবং এই বিপ্লবকে রক্ষা করতে আত্মনিয়োগ করো। আমি আমার সন্তানদের ও এই বিপ্লবী যুবকদের কাছে এটাই দাবি করি। তোমরা তোমাদের ঐক্য ধরে রাখো। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, যারা এই বিপ্লবকে কলুষিত করবে। তোমাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করবে, তোমাদের চমৎকার সম্পর্ককে বিনষ্ট করবে। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো। যে ভ্রাতৃত্ববোধ এই তাহরির স্কোয়ারে তোমাদের এক সুতোয় গেঁথেছে তা যেন কখনো ছিঁড়ে না যায়, তা যেন তোমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখে এটাই আমার আহ্বান। বিপ্লবী যুবকদের প্রতি এটাই আমার শেষ কথা।
এখন আমি মিসরের জনগণের কথা সমগ্র মিসরবাসীর উদ্দেশে কিছু বলতে চাই, যে মিসরবাসীর কথা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, কুরআনে মাত্র দু’টি দেশ ছাড়া আর কোনো দেশকে নাম ধরে উল্লেখ করা হয়নি। এই দু’টি দেশের একটি হচ্ছে ব্যবিলন ও অন্যটি হচ্ছে মিসর। একটি আয়াতে ব্যাবিলনের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া পবিত্র কুরআনে মিসরের নাম পাঁচবার উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে একটি দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের কথাই একবারের বেশি উল্লেখ করা হয়নি। একাধিকবার উল্লেখ করা দেশটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় নিরাপদে মিসরে প্রবেশ করুন’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৯৯)। কিন্তু স্বৈরাচারী ও জালেমরা ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়া কোনো মানুষকে মিসরে প্রবেশ করতে দিতে চায় না। তারা মানুষের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে এবং সমাজকে তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে। ক্ষুধা ও আতঙ্ক এই দু’টি জিনিসই তারা মিসরের জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে তারা দিন দিন তাদের অবস্থান সংহত করতে চেয়েছে, মিসরের জনগণকে মুক্তির স্বাদ থেকে দূরে রাখতে, বঞ্চিত করতে সচেষ্ট থেকেছে। ওই স্বৈরশাসকেরা মিসরের সম্পদ লুটপাট করেছে, অন্য দিকে জনগণ ন্যায্য প্রাপ্য থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। স্বৈরশাসকেরা মিসরের জনগণের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করেছে। শোনা যাচ্ছে, এই লুটেরারা দীর্ঘ দিনে মিসরের জনগণের যে সম্পদ বিদেশে পাচার করেছ তার পরিমাণ তিন ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। যদি এই অর্থের পুরোটা বা তার অর্ধেক কিংবা এক-চতুর্থাংশও দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে সেটা দিয়ে মিসরের সব দেনা শোধ হয়ে যাবে এবং আগামীতে দেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
আমি মিসরের জনগণকে বলতে চাই, ‘আপনাদের অভিনন্দন’ হে জনগণ। এরা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং এই ধর্মের জন্য তারা অনেক জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। এরা বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। যদিও বাইজেন্টাইনরাও ছিল খ্রিষ্টান, কিন্তু নীতির প্রশ্নে তারা মিসরীয় খ্রিষ্টানরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। পরে তারা যখন ইসলাম গ্রহণ করেছে তখন তারা ইসলামের জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং তারা রাজা নবম লুইসকে মানসুরায় ইবনে লোকমানের ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। তাতারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও মিসরের সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মিসর ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ইসলামি বিজ্ঞান ও আরবি ভাষার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে।
প্রিয় ভাইয়েরা, এই বিপ্লবে বিজয় হয়েছে মিসরের এবং যাকে বলা হয় গোষ্ঠীবাদ তার ওপরও বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই গোষ্ঠীবাদ তারাই তৈরি করেছিল। কিন্তু আজ এই স্কোয়ারে মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন। আমার মনে পড়ছে, গতকাল যখন আমি কাতার থেকে ফিরছিলাম তখন একজন যুবক আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলল আমি অমুক, আমি ওমুকের ছেলে, আমার বাড়ি মিসরে। আমি একজন খ্রিষ্টান। আমি আলজাজিরায় আপনার ‘শরিয়া ও জীবন’ অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখি এবং কাতারে প্রতি শুক্রবার আপনার দেয়া খুতবা শুনি। আপনি মানুষের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছেন। আপনার জন্য একজন মিসরীয় হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করি। আমি তাকে বললাম, ‘সব প্রশংসাই আল্লাহর।’ তাহরির স্কোয়ারে মুসলমানেরা যখন নামাজ আদায় করেছেন তখন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য চার পাশে পাহারায় ছিল কপটিক খ্রিষ্টান ভাইয়েরা। আজ আমি তাদের প্রতি আহ্বান জানাব, মুসলমানদের সাথে তারাও যেন সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই তাহরির স্কোয়ারে অভিশপ্ত গোষ্ঠীবাদের বা গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাতের অবসান ঘটেছে। লেখক আহমেদ রাগাব গতকাল লিখেছেন যে, তিনি তাহরির স্কোয়ারে এসেছিলেন। সেখানে তিনি দেখতে পান একজন মুসলিম তরুণী আরেকজন মুসলমানকে নামাজের সময় অজুর পানি ঢেলে দিচ্ছেন। রাগাব বলেছেন, ‘বিপ্লব সফল হয়েছে।’ আমি নিজে দেখেছি আমার নাতনী তাহরির স্কোয়ার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ও বিভিন্ন ্লোগান লেখার কাজে এক দল তরুণ-তরুণীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের পাশ দিয়ে একজন যাজক হেঁটে যাওয়ার সময় তাদের বলল, ‘তোমাদের কি কোনো সাহায্য লাগবে? আমি তোমাদের সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।’ তখন তারা বলল, ‘হঁ্যা, দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।’ এ সময় তিনি মিসরীয় ১০০ পাউন্ডের একটি নোট বের করে তাদের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের জন্য এটাই হচ্ছে আমার সাহায্য।’ তখন ওই তরুণ-তরুণীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে উঠল এবং ওই অর্থ দিয়ে ব্রাশ, রঙতুলি ও অন্যান্য সামগ্রী কিনে আনল। এটাই হচ্ছে মিসরের চেতনা, যে চেতনা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আমি মিসরের জনগণের কাছে এটাই আশা করব যে, তারা তাদের এই ঐক্য ধরে রাখবেন। এখানে যেন কোনো বিভাজন, কোনো উগ্রতা স্থান না পায়। আমরা সবাই বিশ্বাসীদের দলে। আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে এবং আমাদের ঈমান আরো মজবুত করতে হবে। আমরা সবাই মিসরীয়। আমরা সবাই বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছি। সত্যের পক্ষে আজ আমরা সবাই ক্ষুব্ধ, রাগান্বিত। এই চেতনা অবশ্যই উজ্জীবিত রাখতে হবে। (চলবে)