ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তির কারন কি ? ( পার্ট ১)
ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তির কারন কি ? ( পার্ট ২)
সপ্তম শতাব্দীর আরেক পরিব্রাজক ইউয়ান চং বলেন বৌদ্ধবাদের নানা মতবাদীদের মধ্যে অবিরত বচসা লেগেই থাকত যেন তাদের একেকজনের বচসা বাণী সাগরের উত্তাল ঊর্মিমালা যেখানে ১৮টি গোত্রের প্রতিটিই নিজেদের মৌলিক বিশিষ্টতার দাবি করে। এই নানা উপদলের শত্রুতা জনমানসে সঞ্চিত বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা কালেক্রমে ম্রিয়মান করে তোলে। মহায়ন এবং বজ্রায়ন উপদলের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো সংস্কৃতে লেখা শুরু হলো যা কিনা ভারতীয় আমজনতার কাছে ছিল অবোধগম্য। এই ধারা দিনে দিনে বৌদ্ধ ধর্মকে সাধারণ জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল।ফলে মূলত ঈশ্বরহীন মর্মবাণীর এই ধর্ম ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের মনে হিন্দুত্ববাদের মত করে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হলো । যেখানে অসংখ্য দেবতারা সাধারণের জীবনে মধ্যস্থতা করতো যদি তারা সেভাবে পূজিত হত। বৌদ্ধদের এই নৈতিক অবক্ষয় ধর্মটিতে বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতা ডেকে আনে অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ তখন শক্তিশালী বুদ্ধিজীবিদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল।কয়েক শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ হওয়া বৌদ্ধবাদ তাই সংঘ পরিবারের দূষণ, উপদলীয় কোন্দল, আর শাসক শ্রেণীর আনুকুল্য পেতে ব্যর্থ হওয়ায় ধীরলয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে আর এর ফলে তা আর সংশোধিত না হয়ে হিন্দুত্ববাদের সাথে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। এভাবে একসময় পুরো ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। নানা উপঢৌকনে সংঘ পরিবার ধনী হতে থাকে আর বৌদ্ধ সন্তরা বিনয়ের দশম বিধি উপেক্ষা করে সোনা রূপার অনুদান নিতে থাকেন। কৃচ্ছতার মূল সুর থেকে সরে গিয়ে মহায়ন উপদল নানা ব্যয়বহুল আচারানুষ্ঠান চালু করেন।
দেখা যায় যে নিজেদের দোষেই বৌদ্ধবাদ অনেকাংশে অবলুপ্ত হয়। নতুন শক্তিতে উজ্জীবিত হিন্দুত্ববাদের সাথে এটি জনপ্রিয়তায় কোনোভাবেই টিকতে পারছিলনা। আদিশঙ্কর, মাধবাচার্য এবং রামানুজ প্রমুখ হিন্দু দার্শনিক ও ধর্মবেত্তাদের আবির্ভাবে হিন্দুত্বে নবপ্রাণ ফিরে আসে আর সেইসাথে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদ দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে।শঙ্করাচার্য এবং রামানুজ প্রান্তিক লোকদের কাছে পরিচিত বৈদিক সাহিত্যের আলোকে হিন্দু দর্শনকে পরিশীলিত করেন আর সেইসাথে এই নব মতবাদ প্রচার এবং প্রসারে গড়ে তোলেন অসংখ্য মন্দির আর পাঠশালা। অন্যদিকে নানা পথ ও মতের সমন্বয়ের চেষ্টায় রত হিন্দুত্বের সর্বদেবতার আলয়ে গৌতম বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে আত্মস্থ করে নেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মের মধ্যে থেকেই তাই একজন ভক্ত বুদ্ধকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতে পারত। এটাই ছিল বুদ্ধের জন্মস্থানেই বৌদ্ধ ধর্মের কফিনে মারা শেষ পেরেক। হিন্দুধর্ম তাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো নানা মতের বিশ্বাসীদের জন্যে আস্থা এবং সন্তুষ্টির কেন্দ্র।
ব্যক্তিগত ঈশ্বরের স্থান করে দেওয়া ছাড়াও তখন আবেগী ভক্তিমূলক গানের উত্থান শুরু হলো যা আগে দেখা যেতনা।
বৌদ্ধ ধর্মবিশারদদের মতে একাদশ শতকের আগে সাধারণ বৌদ্ধ জনতার ধর্মরীতি কিংবা আচরণবিধি তৈরী করা হয়নি। কিছু বৌদ্ধ ধর্ম গবেষক বৌদ্ধ ধর্ম ক্ষয়িষ্ণু এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ার পেছনে কিছু ভিক্ষুর সহজিয়া ও অলস পথাবলম্বনকে দায়ী করেছেন যা কিনা স্বয়ং বুদ্ধের অপরিগ্রহ কিংবা অনধিকার রীতির বিপরীত। বৌদ্ধ মন্দিরগুলো অনেকক্ষেত্রেই অঢেল সম্পদের ভাণ্ডার হিসেবে দেখা হয়। বাঁচার জন্যে ভিক্ষাবৃত্তি করা এসব বৌদ্ধ সন্তানদের অনেক সময়ই দেখা গেছে সাধারণ জনগনের পরিবর্তে নিপীড়ক শাসকদের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে। আর এই প্রবণতা এমনকি আজও বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতে দেখা যায়।হিন্দু আর বৌদ্ধদের এই সহস্রাব্দী ধরে চলতে থাকা শত্রুতাতে সাধারণ লোকজন বিরক্ত হয়ে পড়েন আর তাতে করে অবশ্য সুফী সাধক এবং মুসলিম অগ্রদূতদের প্রচেষ্টায় ইসলাম বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। সুন্দর নৈতিক শিক্ষা বর্ণবাদ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহজবোধ্য ও সহজসাধ্য বিশ্বাস ও আচারিক ব্যবস্থার কল্যানে ইসলাম এত অঞ্চলে জনপ্রিয় হওয়াতই প্রশ্নটা কেবল ছিল ?
তাছাড়াও বৌদ্ধ ও হিন্দু শাসনামলের চাইতে ত্রয়োদশ শতক থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিশাল অংশে মুসলিম শাসকদের আমলে জনগণের উপর আরোপিত শুল্কহার কমে আসে যা প্রান্তিক এবং বঞ্চিত ভারতীয়দের ইসলামের প্রতি অনুকুল মনোভাব তৈরীতে সহায়তা করে। পরে অবশ্য নিজেদের অবস্থান আরো সুসংহত করতে শাসক শ্রেণীর অনেকেও ইসলাম গ্রহণ করে নেন। আর এসব ঘটনা রাতারাতি হয়ে উঠেনি বরং শতাব্দী ধরে এই ধারা চলাতে ইসলাম ভারতবর্ষের অনেক অঞ্চলে প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।
প্রচলিত উপকথা এবং জনশ্রুতির বিপরীতে এখানে বলে রাখা ভালো যে নালন্দার বৌদ্ধ বিহার বখতিয়ারের অভিযানের সময় মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নালন্দার ক্ষয় ক্ষতিগুলো সবই প্রাক ইসলামিক। তিব্বতীয় অনুবাদক চাগ লোতসাওয়া ধর্মস্বামী যখন ১২৩৫ সালে ভারত সফর করেন তিনি নালন্দাকে অনেকখানি লোকশূন্য অবস্থায় পান তথাপিও তিনি সেখানে ৭০ জন ছাত্রসহ চালু অবস্থায় দেখতে পান। এটা কীভাবে সম্ভব যদি বখতিয়ারের সৈন্যদল আসলেই প্রায় তিন দশক আগে এটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে থাকেন? এই বিষয়ে আরো দেখুন কিভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদ ইতিহাসকে বিকৃত করেছে How History Was Unmade At Nalanda! D N Jha
প্রশ্ন অন্যান্য জায়গাগুলোতে তাহলে কিভাবে বৌদ্ধ ধর্ম নির্মূল হয়েছে? পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মত উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের বিশাল অঞ্চল ও মধ্য এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্ম ষষ্ঠ শতকে শ্বেতাঙ্গ হুনদের দখল অভিযানে নির্মূল হয়ে যায়। বৌদ্ধবাদের বদলে সেখানে প্রচলিত হয় তান্গেরী এবং মানিষেবাদ। রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধবাদকে দমন করেন। তিনি এমনকি হালের এলাহবাদ থাকা বৌদ্ধ মন্দিরগুলোও ধ্বংস করেন। নোটঃশ্বেতাঙ্গ হুনেরা পরে ব্রাহ্মণদের কল্যানে রাজপূত হিন্দুত্ব গ্রহণ করে আর বৌদ্ধবাদের প্রতি বিরূপ বা বৈরী হয়ে পড়েন। আর এইসব বৌদ্ধমঠগুলোর ধ্বংস ঘটে এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশের বহুকাল আগেই।
দশম শতাব্দীর গজনীর সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের সময় বৌদ্ধ ধর্ম বলতে গেলে ভারত থেকে মুছেই গেছিল আর হিন্দু এবং অন্যান্য অ বৌদ্ধ রাজারাই সেজন্যে মূলত দায়ী। আর যখন হুলাগু খানের পৌত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন মধ্য এশিয়ার বিশাল জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মকে মেনে নেন। গজনীর রাজারা সগদিয়া, বাকত্রিয়া কিংবা কাবুলের বৌদ্ধদের উপর কোনো অত্যাচার করেনি। ৯৮২ সালেও নব বিহারের চিত্রপটগুলো দৃশ্যমান ছিল আর মধ্য আফগানিস্থানের বামিয়ানে খাড়া পাহাড়ে খোদাই করা বিশালাকায় বুদ্ধের মুর্তিগুলোও ছিল অক্ষত। প্রথম সহস্রাব্দির সংলগ্নে সগদিয়ায় দক্ষিণ সীমান্তে অনেক বৌদ্ধ মঠ তখনও চালু ছিল বলে আল বিরুনি জানিয়েছেন। গজনীর রাজারা বৌদ্ধ ধর্মকে বাঁধা দেননি এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বলতে গেলে তারা একে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন বিশেষত এর সাহিত্য এবং শিল্পকর্মকে।
১০২৮ সাল থেকে শুরু করে ১১০১ সালের শেষ হবার আগ পর্যন্ত কাশ্মীরের প্রথম লোহারা সাম্রাজ্যের সময় বৌদ্ধধর্ম অর্থনৈতিকভাবে ধীরলয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। কালক্রমে বৌদ্ধ মঠগুলো অত্যল্প আর্থিক সাহায্যের জন্যে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে গজনীর শাসনাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় মধ্য ভারতের ভিক্ষু বিহারের তুলনায় কাশ্মীরি মঠগুলোর মান ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে।লোহারা সাম্রাজ্যের শেষ হিন্দু রাজা হর্ষ আরেকটি ধর্মীয় নিবর্তনমূলক নিয়ম চালু করেন। তিনি একাধারে হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ মঠগুলো ধ্বংস করা শুরু করেন। দ্বিতীয় লোহারা সাম্রাজ্যের সময় অবশ্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুইটি ধর্মই পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পরন্তু The Decline and Fall of Buddhismবইতে ডক্টর কে. জামানদাস জানিয়েছেন যে দুটো বুদ্ধের মূর্তি হর্ষের ধ্বংসাভিযানের হাত থেকে বেঁচে যায় তা রাজা জয়সিংহের আমলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়াও শ্রীনগরের কাছে আরিগোনের বৌদ্ধ বিহার আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এছাড়াও সার্বিক অর্থেই সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি দিনে দিনে কমে আসতেও থাকে। ওইদিকে এর পরে আবার আসে হিন্দু রাজাদের আমল। তবে যদিও আর্থিকভাবে দিনে দিনে বৌদ্ধ মঠগুলো ম্রিয়মান হতে থাকে তথাপি তিব্বত থেকে ক্ষণে ক্ষণে শিক্ষক এবং অনুবাদকদের আসা যাওয়া থাকায় বৌদ্ধিক ক্রিয়াকলাপ চতুর্দশ শতক পর্যন্ত চলতে থাকে।
যদিও হিন্দু রাজাদের অধীনে তিন শতকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মিরে রাজনৈতিক দুর্বলতা ছিল গজনীর সুলতান কিংবা ভারতে তাদের উত্তরসুরীরা ১৩৩৭সাল এর আগ পর্যন্ত কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করেনি। ডক্টর কে জামনদাস বলেছেন যে কাশ্মিরে ইসলাম এনেছেন সুফী সাধক ফকির বুলবুল শাহ আর সৈয়দ আলী হামদানী যিনি আমির কবির নামেও পরিচিত। আগ্রহী পাঠক কাশ্মিরে ইসলাম প্রবেশের ইতিহাস ডক্টর কে জামনদাসের বই থেকে পড়ে দেখতে পারেন।
আর দক্ষিণে শৈব আর বৈষ্ণবীয় হিন্দুত্বের বলিষ্ঠ পূণর্জাগরণের ফলে বৌদ্ধ ধর্ম দ্রুতই ক্ষীণকায় হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ ধর্ম মূলত বৌদ্ধ মঠগুলোতেই বেঁচে ছিল ও আছে। অন্যান্য ধর্মের মত ধর্মসূত্র বা নৈতিক সংহিতার ঘাটতি এখানে সব সময়ই ছিল। তাই যখনই বৌদ্ধ মঠগুলো সাহায্যের অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো সাথে সাথে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্ম দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে লাগলো।
উপসংহারঃ
কিছু ঐতিহাসিকের মধ্যে পূর্ব এশিয়াতে বৌদ্ধবাদের ক্ষীণকায় হয়ে আসার কারণ সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। কিন্তু অকৃত্রিম এবং নির্মোহ ইতিহাসবিদরা এই বিষয়ে একমত যে ইসলামের আগমনের কারণে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের বিলোপ ঘটেনি বরং পুনরুজ্জীবিত হিন্দুত্বই এজন্যে মূলত দায়ী।
অষ্টম শতকের বিখ্যাত হিন্দু দার্শনিক শঙ্কর বুদ্ধকে জনতার শত্রু বলে আখ্যায়িত করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি নিজেই বৌদ্ধবাদের আদলেই আশ্রম বিধি জারি করেন আর বৌদ্ধ ধর্ম থেকে অনেক দর্শন ধার করেন। বৌদ্ধ সংঘের আদলে শঙ্কর যখন অষ্টম শতকে সন্যাস এবং আশ্রম বিধি জারি করেন ঠিক তখনই বৌদ্ধ বৈরী প্রচারণাও ছিল উত্তুঙ্গে। তাকে বৌদ্ধবাদের কড়া সমালোচক হিসেবে যেমনভাবে অভিনন্দিত করা হয় ঠিক তেমনিভাবে তাকেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের অবলুপ্তির প্রধান কারিগর হিসেবেও দেখা হয়। একই সময়ে তাকে ছদ্মবেশী বৌদ্ধ হিসেবেও দেখা হয়। এই আপাত বিপ্রতীপ মতবাদগুলো সম্পর্কে প্রাচীন ও আধুনিক উভয়কালের দার্শনিক ইতিহাসবিদ এবং বিশেষজ্ঞ লেখকেরা একমত। যদিও শঙ্করকে হিন্দু সাহিত্যে বৌদ্ধবাদের পরাজয়ের কারন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তথাপি তিনি মূলত বৌদ্ধবাদ কিয়দ অঞ্চল থেকে দীপ্তিহীন হয়ে যাবার পরেই বেশি সক্রিয় ছিলেন।
বিশ্বকোষে লেখা হয়েছে চাঁদেলার প্রাঙ্গনে ঘটা প্রভাবশালী সংস্কৃত নাটক প্রবোধচন্দ্রদায়ে বিষ্ণুর আরাধনা আর প্রতিকাশ্রয়ী ভাষায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পরাজয় যেভাবে দেখানো হয়েছে তাতে বোঝা যায় যে প্রাক একাদশ শতকে উত্তর ভারতে হিন্দুত্বের নব উচ্ছাস ফিরে আসে। উত্তর ভারতের জনগণ ততদিনে মূলত শৈব, বৈষ্ণব কিংবা শাক্ত হিন্দুত্বে ফিরে গেছেন।
দ্বাদশ শতকের মধ্যে বৌদ্ধবাদ বলতে গেলে মঠ এবং আশ্রম ভিত্তিক ধর্মে পরিণত হয় যদিওবা কৃষক শ্রেণীতে কিছু লোক তখনও বৌদ্ধ ছিলেন তাদেরকে ভিন্ন ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে পৃথক করা যেতোনা । আর যখন ভারতে মুসলিম শাসন অধিষ্ঠিত হলো তখন ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের কেবল ছিটেফোটা অবশিষ্ট ছিল। আর প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা তো বৌদ্ধদের হাত থেকে অনেক আগেই চলে গিয়েছে।
সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ শতকে যখন ইসলাম দক্ষিন এশিয়ায় আগমন করে তখন থেকেই এটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মকেই উদার ও বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে প্রতিস্থাপন করে ফেলে। আগে যেভাবে বলা হলো মধ্য ত্রয়োদশ শতকে বাগদাদে হুলাগু খানের গণহত্যা এবং ধ্বংসলীলার বদৌলতে অনেক মুসলিমই ঝামেলাবিহীন জায়গাগুলোতে আশ্রয় খুঁজছিল। অনেকেই ভারতবর্ষে স্থাপনা গাড়েন। সাথে নিয়ে এসেছিল উন্নততর নৈতিক শিক্ষা এবং তার প্রয়োগ ও এরসাথে সুফী শিক্ষা ভারতীয় জনগণকে ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণ করতে প্রনোদিত করে। সুফী সাধকদের প্রভাব, বর্ণপ্রথার চাপ, এবং সেইসাথে সামাজিক পরিবর্তনকে রুখে দেবার মত রাজনৈতিক শক্তির অভাবে বাংলাতে সবচাইতে বেশি লোক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়।
মোটকথা হচ্ছে গাঙ্গেয় সমতল, মধ্য ও উত্তর ভারত সহ হালের অন্ধ্র ও কর্নাটকে ইসলাম প্রোথিত হবার অনেক আগে থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম এতদ অঞ্চলে অবলুপ্তির নিদর্শন দেখাচ্ছিল। বলতে গেলে এর স্বাভাবিক মৃত্যুই ঘটেছে। যেভাবে জনৈক হিন্দু পণ্ডিত বলেছেন: পুরাতন বৌদ্ধবাদ যা কিনা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছে মানব জীবনের অমরত্বকে কোনো আশা দেখাতে পারেনি যেন জীবনটাই এক মর্মবেদনা, জীবনের মায়া যেন এক মহাপাপ, আর মৃত্যুই হচ্ছে সমস্ত কামনা, বাসনা থেকে পাওয়া নিষ্কৃতি। বৌদ্ধবাদ কুসংস্কার, স্বার্থহীনতা ও তদ্ভুত তুষ্টির দ্বারা নিজেই ছিল ভারাক্রান্ত মহায়ন অধিবিদ্যা এবং ধর্ম আদতে অদ্বৈত দর্শন ও বিশ্বাস সমার্থক।
অন্যদিকে বৈরাগ্য চরিত্রের হীনায়ন শেষমেষ শৈব ধর্মের একটি শাখায় পরিণত হয়। দেখা গেল বৌদ্ধ ধর্মের স্বতন্ত্র আর কোনো শিক্ষাই দেবার ছিলনা। যখন ব্রাহ্মণ্যবাদ ঈশ্বরের প্রতি সর্বজনীন ভক্তি আত্মস্থ করলো আর সেইসাথে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে ঘোষণা দেওয়া হলো তখনই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের কফিনে শেষ পেরেক খানি ঠোকা হয়ে গেল।
স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, তাই, জীবে দয়া প্রদর্শন করার আদেশ সত্ত্বেও, মহান নৈতিক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও, চিরায়ত আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব সম্পর্কিত আলোচনা থাকা সত্ত্বেও বৌদ্ধবাদের দালান ধ্বসে পড়েছে আর দালানের সেই ধ্বংসাবশেষ আসলেই কদাকার। মানব রচিত কিংবা পরিকল্পিত সবচাইতে কদর্য আচারাদি কিংবা অশ্লীল বই যা চিন্তা করা যায় তার সবই অধঃপতিত বৌদ্ধবাদের কল্যানে পাওয়া গেছে।
অন্য ধর্মের দিকে অঙ্গুলি প্রদর্শন না করে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নিজেদেরই ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়াতে নিজেদের অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে অন্তর্বীক্ষণে নামা উচিত। যদি তাই করা হয় তবে দেখা যাবে যে বৌদ্ধ ধর্মের মৃত্যুর জন্যে সে নিজেই দায়ী কোনো বাইরের শক্তি নয়। নিজেদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার দায় বৌদ্ধবাদ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারেনা। বিশ্বায়নের এই যুগে বৌদ্ধবাদ যদি টিকে থাকতে চায় তবে এর সংস্কার বড়ই জরুরি । পাছে এটি মানব আকাঙ্খার প্রতি বৈরী এবং অন্য দের প্রতি গণহত্যার আকাংখায় লালিত মৃতপ্রায় এক দর্শন হিসেবে বিবেচিত না হয়। এই সফরের জন্যে তাদের যত কম সম্ভব উইরাথু দের ও যত বেশি সম্ভব গম্বিরা দের প্রয়োজন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:২৯