ঈদ উল আজহা অর্থাত কোরবানি ঈদ নিয়ে উপমহাদেশের মুসলিমদের সমাজ জীবনে আছে নানান ঐতিহাসিক ঘটনা ৷ তবে সেটি উপমহাদেশের মুসলিমদের জনজীবনে খুব একটা ভালো অথবা সুখকর অভিজ্ঞতা নয় ৷ যার প্রমান পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখক ইতিহাসবিদের গবেষনা কর্ম ও রচনা এবং তখনকার সময় সমাজের রাজনৈতিবিদের জীবনি থেকে ৷ মধ্যযুগে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে বাংলার তৎকালিন শ্রীহট্টতে যা এখন সিলেট নামে পরিচিত, সেখানে আগমন ঘটে প্রখ্যাত ইসলাম প্রচারক হযরত শাহ্জালাল ইয়ামেনী রহমতউল্লাহ আলাইহির । ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন রচয়িত বাংলাদেশের উৎসব নামক বইয়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত লেখেছেন।তার বই অবলম্বনে এই পোষ্টে সংক্ষেপে উপনিবেশ শাসনের সময় গরু কোরবানী বিষয়ে সংক্ষিপ্ত কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।
আজকে আমরা ইদ উল আজাহায় অর্থাত কোরবানী ঈদে গরু কোরবানীর অনায়সে গরু কিনে এনে অনেক সহজেই কোরবানী দিয়ে থাকি। আশি একশো দুরে থাকুক এখন পঞ্চশ বা ষাঁট বছর আগেও তা তেমন সহজসাধ্য ছিল না ৷ আজকের প্রজন্ম হয়ত অবাক হবে যে এ নিয়ে সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর বিতর্ক চলেছে ৷এবং কোরবানী বিশেষ করে গরু কোরবানী দেওয়ার অধিকার আমাদের বাপ দাদাদের লড়াই করে আদায় করতে হয়েছে ৷উল্লেখিতঃ মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশের উৎসব, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠা ৩২
অর্থাত অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের এই উক্তি থেকেও আমরা বোঝতে পারি যে বাংলার পূর্ববতী মুসলিমদের জন্য গরু কোরবানি করা কতটা দূরসাধ্য ছিল । ইংরেজ শাসিত বাংলায় গরু কোরবানির পক্ষে বিপক্ষ নিয়ে অনেক আন্দোলনেরও উদাহরন রয়েছে। একাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বাংলার পুঁজিপতি সম্প্রদায় গুলো ।
১৮৮২ সালে দায়নন্দ সরস্বতী গো হত্যা নিবারনী সভা স্থাপন করলে শুরু হয় বিতর্ক ।গো হত্যা বা গরু কোরবানীর বিপক্ষে সে সভা থেকে ভারত জুড়ে হয়েছিল প্রবল প্রচার । ১৮৮৭ সালে রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায় কংগ্রেস মাদ্রাজ অধিবেশনে সে পরিপ্রেক্ষিতে উত্থাপন করেছিলেন প্রস্তাব । ফরিদপুর এবং বিভিন্ন অঞ্চলেও এই নিয়ে প্রচার শুরু হয়েছিল । তখন এর বিরোধিতা করতে মুসলিমদের বিভিন্ন সভা বা আঞ্জুমান সমূহ এগিয়ে এসেছিল । বিত্তবান হিন্দুদের সে প্রচারনার সমর্থনে এসেছিল স্থানীয় হিন্দু জমিদাররা । ওই সময়কার অবস্থার একটি বিবরন পাওয়া যাবে ইবনে মাযুদ্দিন আহমদের আত্মজীবনী আমার সংসার জীবন থেকে । তিনি লিখেছিলেনঃ
গোবিন্দপুর হরিশঙ্করপুর, সনাতন, গোপীনগর, আমলা, গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন প্রচন্ড প্রতাপান্বিত বড় হিন্দু জমিদারের জমিদারীভুক্তি,সেখানকার মুসলিমগন বহুকাল অবধি গরু কোরবানী করতে অথবা গরু জবেহ এবং উহার গোসত ভক্ষন করিতে পারিত না ৷ কেহ করিলে তার আর রক্ষা ছিল না ৷ জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগন কোরবানীদাতা এবং হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্রহার ও নানা অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট জরিমানা আদায় করিত ৷ সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ওই অঞ্চল হইতে গো কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল ৷ উল্লেখিতঃ মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩
গরু কোরবানীকারিরা সে কালে রাষ্ট্রীয় ভাবে জেল জরিমানার হাত থেকেও রক্ষা পেত না । ১৮৯৫ সালের দিকে জানা যায় ময়মনসিংহের অশ্বরিয়া ও মুক্তাগাছা এবং সন্তোষের জমিদার গরু কোরবানীর জন্য বেশ কিছু মুসলমানকে জরিমানা করেছিল । ১৯০৫ সালে চাঁদপুরে কয়েকজন ঈদুল আযাহ অর্থাত কোরবানী ঈদ উপলক্ষে গরু কোরবানী দিয়েছিল । আর তার কারনে জৈনক গোপাল চন্দ্র মজুমদার তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল । অভিযোগ ছিল মুসলমানরা প্রকাশ্য রাস্তায় গরু জবেহ করেছে এবং বদ্ধজলে গোসত ধুয়ে জল অপবিত্র করেছে । জেলা হাকিম ছিলেন জগদীশচন্দ্র সেন,সে তিনজন মুসলিমকে অভিযুক্ত করে একজনকে এক মাসের জেল এবং অপর দুজনকে যথাক্রমে পঞ্চাশ এবং পনের টাকা জরিমানা করেছিল। উল্লেখিতঃমুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা, ৩৪
গরু কোরবানি নিয়ে তৎকালিন সমাজে প্রথম সারির ব্যাক্তিদের বিভক্তিও ছিল। প্রখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিক মীর মোশারেফ হোসেন মুসলিম সম্প্রদায়কে হতাশ করে তিনিও গরু কোরবানীর বিরোধীতা করেন । গরু কোরবানীর বিরোধীতা করে গো জীবন নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন । তিনি সেক্ষেত্রে প্রতিবেশি হিন্দু সমাজের সমর্থনও লাভ করেন । তার গো জীবন গ্রন্থের মুখবন্ধ লিখে এলাহাবাদের গো রক্ষীনী সভার শ্রী শ্রীমান স্বামী । গরু কুরবানীর বিরোধীতা করার জন্য টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত মাসিক আখবারে এসলামীয়া এর সম্পাদক মৌলবী নঈমুদ্দীন কর্তৃক এক জনসভায় মীর মোশারেফ হোসেনকে কাফেরও ঘোষনা করা হয়েছিল, তখন কবি মীর মোশারেফ হোসেনও তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে । সে সময় মৌলবী নঈমুদ্দীন এর পক্ষে এগিয়ে আসে ঢাকা কলেজ, মাদ্রাসা, পোগোজ, জুবিলী, জগন্নাথ, সার্ভে কলেজ, মেডিক্যাল এবং নর্মাল স্কুলের ছাত্ররা । তারা মৌলবী নঈমুদ্দীনের পক্ষে জনসভা আয়জোন করেন, পরে মৌলবী নঈমুদ্দীন এবং কবি মীর মোশারেফ হোসেনের মধ্যে আপসের মাধ্যমে মামলাটি প্রতাহার করা হয় ৷ উল্লেখিতঃ মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫ ।
তৎকালিন সংবাদপত্র গুলোও বিভক্ত হয়ে পক্ষে বিপক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করতে ছাড়েনি । ১৯০১ সালে মাওলানা আকরাম খাঁ তার সম্পাদিত মোহম্মদী পত্রিকায় কোরবানীর পক্ষে বলতে গিয়ে লিখেন যে মুসলিমরা যে রুপে কোরবানী পালন করে, হিন্দুরা এরুপ গো মেঘ যঞ্জ পালন করত । সঞ্জীবনী নামক পত্রিকায় তার এই উক্তির বিপক্ষে লেখা হয় যে । ওই সব প্রাচীন তত্ত্ব কেন প্রকাশ করা হইতেছে ? বিন্দুতে গো মাংস ভক্ষন করার জন্য এদেশে গো মাংস চলবে না ৷ উল্লেখিতঃ মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা, ৩৭
যা হোক কোরবানী নিয়ে আমাদের বাংলাদেশে তেমন কোন বির্তক না থাকলেও আজও ভারতে গরু ভিত্তিক নানা বির্তক রয়েছে । আর সে জন্যই এখন ভারতে গরু রাজনৈতিক দলগুলোর একটি রাজনৈতিক গুটিতে পরিনত হয়েছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৪৮