ভারতের মন্দির ধ্বংসের বিষয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে মুসলমান শাসকেরা এই মন্দির গুলো ভেঙ্গেছেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড এম ইটন জানাচ্ছেন ১২ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত পুরো মুসলিম শাসনে দক্ষিন এশিয়ায় মুসলমান শাসকদের হাতে মোট ৮০ টি মন্দির ভাঙা হয়েছিল। রিচার্ড ইটন কেন ভাঙা হয়েছিল সেটার কারন এবং অনুসন্ধান করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যেই সমস্ত রাজা শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং সেই বিদ্রোহে যদি কোন মন্দির বিদ্রোহী রাজার সাথে পলিটিক্যালি যুক্ত থাকতো সেই মন্দির মুসলমান শাসকেরা ধ্বংস করেছে। কারণটা পুরোপুরি রাজনৈতিক; ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়।সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কেও মন্দির ধংসের অপবাদ শোনা যায়। এখানেও বিস্ময়কর ভাবে কারণটা রাজনৈতিক। আওরঙ্গজেব রাজপুতদের মন্দির ভেঙ্গেছিলেন যেই রাজপুত মোঘলদের অনুগত ছিল কিন্তু আওরঙ্গজেবের আনুগত্য মানতে অস্বীকার করে বিদ্রোহ করেন। সেই বিদ্রোহ দমনের পরে মন্দির গুলো ভাঙা হয়। সবচেয়ে কৌতূহল উদ্দীপক তথ্য দিচ্ছেন ইটন বাংলা সম্পর্কে। তিনি জানিয়েছেন বাঙলায় সম্রাট আওরঙ্গজেব যে কোন মোঘল শাসকদের চেয়ে বেশী মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।আওরঙ্গজেবের অনেক দোষ থাকতে পারে কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষের দোষটা আরোপিত যেটা তার প্রাপ্য নয়।কিছু হিন্দু রাজার বিরুদ্ধেও বৌদ্ধ ও জৈনদের উৎপীড়ন এবং তাদের ধর্মস্থান ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে।সুলতান মহমুদ এবং মোহাম্মদ ঘোরির মধ্যবর্তী সময়ের মানুষ কাশ্মীররাজ হর্ষ । ১০৮৯ সাল থেকে ১১০১ সাল পযন্ত তার রাজত্বকাল ছিল । শুধু যে সুদর্শন এবং শৌখিন মানুষ ছিলেন তা ই না তার আরো অনেক গুণও ছিল । সঙ্গীত এবং শিল্পরসিক, স্বয়ং কবি এবং বহুভাষাবিদ। শুরুতে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই রাজত্ব চালিয়েছেন । কিন্তু তারপর নানা বিতর্ক ও ভুলভ্রান্তি সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । তার পরিণতিও খুব করুণ ।লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে হর্ষ সম্পর্কে উইলিয়াম ডালরিমপল-এর মন্তব্য,, "শুধু এই কাশ্মীরি রাজা একাই অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পুণ্যস্থান ধবংস করার জন্য দম্ভ করতেন।"
কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহনের পিতা চম্পক ছিলেন হর্ষের মন্ত্রী । কলহন তার ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপাদানসমৃদ্ধ বই রাজতরঙ্গিনী তে হর্ষ সম্পর্কে লিখেছেন শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় ইমারতই নয় কোনো গ্রাম নগর বা শহরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তুরস্ক রাজা হর্ষ দ্বারা । মন্দির আক্রমণকারী বলেই হয়তো কলহন তাকে তুরস্ক আখ্যা দিয়েছিলেন।
তবে টাকার জন্যই যে তিনি মন্দির আক্রমন করতেন তা নয় বিগ্রহও উঠিয়ে নিয়ে যেতেন । এই ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ কর্মচারীও ছিল তার। পদটার নাম দিয়েছিলেন দেবোৎপাটননায়ক। তারা বিগ্রহ নিয়ে যেসব জঘন্য কান্ড করতেন তা কোন মুসলমান শাসক বা রাজকর্মচারীরা ভাবতেও পারেননি। কলহনই লিখে গিয়েছেন এসব।হর্ষ একা নন ধর্মস্থান লুট এবং ধ্বংস করার জন্য হিন্দু রাজাদের মধ্যে দায়ী আরও কেউ কেউ আছে। রাজপুত পারমার বংশের শাসক সুভাতবর্মন গুজরাট আক্রমনকালে দাভোই এবং ক্যাম্বে র বহু জৈন মন্দির লুট করেছেন। শৈবদের হাতেও বহু বৌদ্ধ এবং জৈন মন্দিরের ক্ষতি হয় বা সেগুলি পরে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে।১০ এবং ১১ শতকের চোল বংশের শৈব সম্রাট প্রথম রাজা চোল এবং তার পুত্র রাজাধিরাজ চোল এর বিরুদ্ধেও ইতিহাসে অভিযোগ চালুক্য রাজ্যের জৈন মন্দির লুণ্ঠন এবং ধ্বংসের। ৬ শতকের আর এক শৈব শাসক মিহিরকুল বৌদ্ধ বিহার এবং স্তুপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
'তথ্য সুত্র'=
Vinay lal in Religion und Gewalt: Conflicte, Rituale, Deutungen (English version) Ed. Kaspar von Greyerz und Kim Siebenhuner, Vandenhoeck & Ruprecht, Germany, 2006, p 70-71
Abraham Eraly, The First Srping: The Golden Age of India, Penguin Books India, New Delhi, 2011, p. 735
বাঙলায় মুসলমানদের ইতিহাস আদিযুগ, জাহিরুল ইসলাম, পুর্বা প্রকাশনী ২০১৫, পৃষ্ঠা ১২৮-১২৯
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১০