ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অবলুপ্তির কারন কি ? ( পার্ট ১)
কুশিনগর অথবা হার্রাম্বাতে গৌতম বুদ্ধ মারা যান বিধায় এটি বৌদ্ধদের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। এই নামকরা শহরের চাকচিক্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে ব্রাহ্মণরা এই কুৎসা রটায় যে এই শহরে কারো মৃত্যু হলে সে সরাসরি নরকে চলে যাবে বা পরেরজন্মে গাধা হয়ে জন্মাবে কিন্তু ব্রাহ্মণীয় পবিত্র নগর কাশিতে মৃত্যু হলে সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। এই উদ্ভট ধর্মতত্ত্ব এমনই পরিব্যপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে যখন মুসলিম সুফী সাধক কবির ১৫১৮ সালে কুশিনগরের কাছে মঘরে মারা যান তখন তার হিন্দু ভক্তকুল কোনো স্থানীয় স্মৃতি স্থাপনা বানাতে অস্বীকৃতি জানায়। তারাই আবার কাশিতে গিয়ে তার নামে একটি স্মৃতি স্থাপনা গড়ে তোলেন। কবিরের মুসলিম ভক্তরা এদিক থেকে কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। তারা মঘরেই তার মাজার গড়ে তোলেন।
তারপরে নরেশ কুমার বলেন ( বুদ্ধের নাম কলুষিত করার পাশাপাশি এহেন ব্রাহ্মণ্য পুনর্জাগরণবাদীরা নিরপরাধ বৌদ্ধদের নিপীড়ন কিংবা এমনকি মেরে ফেলারও তাগিদ হিন্দু রাজাদের দিতে থাকেন। বাংলার শৈব ব্রাহ্মণরাজা শশাঙ্ক শেষ বৌদ্ধ সম্রাট হর্ষবর্ধনের বড় ভাই রাজ্যবর্ধনকে ৬০৫ সালে হত্যা করেন। তারপরে শশাঙ্ক বোধি গয়াতে গিয়ে বোধি বৃক্ষকে উপড়ে ফেলেন যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধি প্রাপ্ত হন। পাশের বৌদ্ধ বিহারে থাকা বৌদ্ধের প্রতিকৃতি তিনি সরিয়ে ফেলে তার জায়গাতে শিবের প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বা ঝুলিয়ে দেন। তারপরে বলা হয়ে থাকে যে শশাঙ্ক কুশিনগরের সব বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নির্বিচারে হত্যা করেন। আরেক শৈব হিন্দু রাজা মিহিরকুল ১৫০০ বৌদ্ধ তীর্থস্থান সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। শৈব রাজা তরামন কৌসম্বিতে থাকা বৌদ্ধ মঠ ঘষিতরাম ধ্বংস করেন বলে জানা যায়।
ব্রাহ্মণদের দ্বারা বৌদ্ধ স্থাপনাগুলোর ধ্বংস এবং ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধবাদের নির্মূল হয়। বোধগয়ার মহাবোধি বিহারকে জোর করে শিব মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে বাদানুবাদ আজও চলছে। কুশিনগরের বুদ্ধের স্তুপ প্যাগোডাকে রমহর ভবানী নামের এক অখ্যাত হিন্দু দেবতার মন্দিরে পরিবর্তিত করা হয়। জানা যায় যে আদি শঙ্কর অধিকৃত বৌদ্ধ আশ্রমের জায়গাতে হিন্দু শ্রীঙ্গেরী মঠ বানিয়েছিলেন। অযোধ্যার অনেক হিন্দু তীর্থস্থান যেমনঃ সবরীমালা, বদ্রীনাথ কিংবা পুরীর মত প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ্য মন্দির আদতে একসময় বৌদ্ধ মন্দির ছিল।
ইতিহাসবিদ এস আর গোয়েলের মতে A History of Indian Buddhism পুরোহিত বর্ণের ব্রাহ্মণদের শত্রুতার জন্যেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধবাদের অবলুপ্তি ঘটেছে। গৌড়ের শাসক হিন্দু শৈব রাজা শশাঙ্ক ৫৯০সাল থেকে ৬২৬ ভিতরে বোধি বৃক্ষ ধ্বংস করেন যার নিচে বসে ধ্যান করে গৌতম বোধিপ্রাপ্ত হন। পুস্যমিত্র শুঙ্গ ১৮৫ সাল থেকে ১৫১ সালের আগে বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সূত্র লেখনিগুলোসহ বৌদ্ধ প্রার্থনালয় জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়াও অসংখ্য বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করেছেন।
এককালে উদগ্র গরু মাংস ভক্ষক ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধদের দেখাদেখি নিরামিষাশী হয়ে যান। তারা বুদ্ধের প্রতি প্রচলিত ভালবাসার আদলেই নতুন করে রাম আর কৃষ্ণ বন্দনা শুরু করে দেন। বৌদ্ধদের অবলোপনের ঊষালগ্নের এই সময়কালেই মহাভারত রচিত হয় যাতে করে নিম্নবর্ণের বৌদ্ধদের আবার শুদ্র হিসেবে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা যায়। ব্রাহ্মণরা অবশ্য তার পরেও বেদ গ্রন্থ শুদ্রদের পড়বার জন্যে উন্মুক্ত করেননি আর এই বৈষম্য সামাল দিয়ে ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ শুদ্রদের শান্ত রাখতেই খুব সম্ভবত মহাভারত রচিত হয়েছিল।
প্রথম সহস্রাব্দীর দ্বিতীয় অংশে বৌদ্ধদের অবস্থা সম্পর্কে আমরা যা জানি তা মূলত এসেছে সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক বৌদ্ধ পদব্রাজক হিউয়েন সাং ভ্রমনবৃত্তান্ত থেকে। যদিও কিছু জায়গাতে বৌদ্ধদের সমৃদ্ধ হতে দেখেছেন তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি বৌদ্ধবাদকে দেখেছেন জৈন এবং ব্রাহ্মণ শক্তির কাছে পরাভূত মৃতপ্রায় সত্তা হিসেবে।
বিহারের কয়েকটি বিশেষ বৌদ্ধ স্থানে তিনি মারাত্মকভাবে ক্ষয়িষ্ণু হাতেগোনা কিছু ভক্ত দেখেছেন ওইদিকে আবার দেখেছেন হিন্দু ও জৈনদের রমরমা অবস্থা। বাংলা কামরূপ ও আসামেও তিনি অপেক্ষাকৃত স্বল্প সংখ্যক বৌদ্ধ দেখেছেন কন্যাধাতে কোনো বৌদ্ধ পাননি। আর তামিল, গুজরাট এবং রাজস্থানে দেখছেন গুটিকয়েক বৌদ্ধ। চালুক্যদের রাজত্বকালে হিউয়েন সাং লিখেছেন চালুক্যদের শাসনামলে অন্ধ্র আর পল্লব শাসকদের অনুকুল্যে গড়ে ওঠা অনেক বৌদ্ধ স্তুপ মন্দির পরিত্যাক্ত কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই অঞ্চলগুলো বৈষ্ণব পূর্ব চালুক্যদের শাসনাধীনে আসে যারা বৌদ্ধদের প্রতি বৈরী ছিলেন।
সাং এর বাংলা ভ্রমণকালে গোড়া হিন্দু শশাঙ্ক ছিলেন বাংলার শাসক। তিনি শশাঙ্ককে একজন বিষাক্ত গৌড় সাপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যিনি বাংলার বৌদ্ধ স্তুপ মন্দিরগুলো ধ্বংস করেন আর তার রাজ্যের একেক বৌদ্ধ সন্তদের মাথার জন্যে একশ স্বর্ণমুদ্রা করে পুরস্কার ঘোষণা করেন। হিউয়েন সাং সহ অনেক বৌদ্ধ সূত্রগুলোতে থানেসরের বৌদ্ধ রাজা রাজ্যবর্ধনের হত্যার জন্যে শশাঙ্ককে দায়ী করা হয়। হিউয়েন সাং লিখেছেন বোধ গোয়ার বোধি বৃক্ষ কাটা ছাড়াও ওখানকার বৌদ্ধ মূর্তিগুলোকে শিবলিঙ্গ দ্বারা প্রতিস্থাপন করেন।
এখানে বলে রাখা ভালো যে শশাঙ্ক বৌদ্ধ রাজা হর্ষবর্ধনের সাথে এক অমিমাংসিত যুদ্ধ করেন যেখানে শশাঙ্ক তার নিজের অঞ্চলগুলো ধরে রাখতে সমর্থ হন।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে কিছুকাল ধরে শাসনের অধিকার নিয়ে বাংলায় হিন্দু এবং বৌদ্ধদের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট চলে। পরে পাল রাজারা বাংলার অধিপতি হলে তারা মহায়নী বৌদ্ধবাদ ও শৈব হিন্দু উভয়েরই পৃষ্ঠপোষকতা করেন।পালদের পরে ত্রয়োদশ শতকের বখতিয়ার খিলজি বাংলার শাসন অধিগ্রহণের আগে হিন্দু সেন রাজারা ১০৯৭সাল থেকে১২০৩ সাল পযন্ত বাংলার অধিপতি ছিলেন। আর সেনদের সময়ে শৈব হিন্দুরা পায় শাসকদের আনুকুল্য আর অন্যদিকে বৌদ্ধদের তিব্বতের দিকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া হয়। পুরান গ্রন্থগুলো নিয়ে সামান্য গবেষণা করলেই দেখা যায় যে এই ব্রাহ্মণ্য আখ্যানগুলো কীভাবে বৌদ্ধদের প্রতি শ্লেষ আর অবর্ণনীয় ভাষিক বর্বরতায় ভরা যেখানে বৌদ্ধদের ক্ষতিকর আর ভয়ানক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
আসলে অশোকের পরে ভারতবর্ষের অধিকাংশ শাসকরাই হিন্দুত্বকে আনুকুল্য দেখানোর পাশাপাশি বৌদ্ধদের প্রতি ছিলেন বৈরী আর এই কারণেই ভারতবর্ষে বৌদ্ধদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। অনেক দিক থেকেই বৌদ্ধবাদ সার্বিক অর্থে ম্রিয়মান হয়ে আসছিল। জনৈক ঐতিহাসিক বলেন ( গুপ্ত সম্রাজ্যের পর থেকে ভারতীয় ধর্মগুলো দিনে দিনে জাদুমন্ত্র এবং যৌনতা কেন্দ্রিক আধ্যাত্মিক মর্মজ্ঞান লাভের মত সনাতনী চিন্তাধারা দিয়ে আবিষ্ট হতে থাকে আর বৌদ্ধ ধর্মও এই ধারাগুলো দিয়ে প্রভাবিত হতে থাকে।) আর এই অবস্থার ফলাফল হিসেবে বজ্রপাতের যান হিসেবে বজ্রায়নের আবির্ভাব ঘটে। নতুন এই গোষ্ঠী ধর্মীয় মতবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উন্মত্ততাকে আশির্বাদ দেয় সাথে সাথে কৌমার্য ব্রতের প্রতিও দেখা দিতে থাকে শৈথিল্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৫৩