মুসলিমদের উপমহাদেশে আবির্ভাবের আগ থেকেই বৌদ্ধরা ক্ষমতাশালী হিন্দুদের প্রতাপে ছিলেন একেবারে কোনঠাসা। এমনকি গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুস্থান বিহারের প্রতিবেশী বাংলাতেও হিন্দু ব্রাহ্মণ, শাসক এবং নেতারা সাধারণ জনগণকে বশীভূত করে পেরেছিলেন। আসলে ইসলাম না এলে বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দুদের দ্বারা ভারতবর্ষ থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্নই হয়ে যেত। অন্ধ বৌদ্ধবাদের সমর্থকদের উচিত উইরাথুদের মত উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসীদের বিক্রি করা বিষাক্ত ঘৃণার বড়ি না খেয়ে এ বিষয়ে নির্মোহ বিশ্লেষকদের লেখাগুলো পড়ে দেখা যদি তাতে অবিচক্ষণ মুর্খতা এবং ঘৃণ্য মুসলিম বিদ্বেষ কিছুটা হলেও তাদের মন থেকে কমে। এখনো প্রচলিত ইসলামবৈরী গল্পকথার বিপরীতে এটাই সত্য যে বখতিয়ারের অশ্বারোহীরা যখন হিন্দু রাজাদের পরাভূত করেন তখন স্থানীয় বৌদ্ধরা মুসলিমদেরকে বর্ণবাদী হিন্দুদের নিপীড়ন থেকে তাদের উদ্ধারকর্তা হিসেবেই দেখেছিলেন।যদিও গৌতম বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন তবু প্রাচীন ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞের পরে হিন্দু রাজা অশোকের ২৩৬ পূর্বাব্দে বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হবার আগ পর্যন্ত বৌদ্ধদের ভরতবর্ষের রাষ্ট্রযন্ত্রে কোনো রকম তেমন প্রভাব ছিলনা । অশোকের শাসনামলে বৌদ্ধ ধর্ম পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্বভাবতই এমন আনুকূল্য বেশিদিন টিকেনি আর শক্তিশালী গুপ্ত সাম্রাজ্যের আমল থেকে শাসনযন্ত্র ধীরলয়ে হিন্দুত্বের প্রভাবে ফিরে যায়। স্থানীয় রাজারা তখন থেকে বৌদ্ধ ধর্মের চেয়ে হিন্দু ধর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে আর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের চেয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণদের সাথে মিত্রতা গড়ে তোলার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে থাকেন। প্রান্তিক জনতার মধ্যে থেকে দলিত নিম্নবর্ণের লোকজন যারা আগে বৌদ্ধ ধর্মের জাতপ্রথার বিরুদ্ধ বাণীতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তারাও পরিবর্তিত ভূ রাজনৈতিক কারণে সনাতন ধর্মে ফিরে যেতে শুরু করেন।
পঞ্চম শতাব্দির চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক এবং তীর্থযাত্রী ফেক্সিয়ান ভারত সফরের সময় স্থানীয় মহায়ন বৌদ্ধ তত্ত্বে মৌলিক দুর্বলতা দেখতে পান। সেখানে অনেক ঈশ্বররূপী বুদ্ধ এবং বোধিসত্ত্বরা মহাবিশ্বের অগণিত স্তরগুলোতে বসবাসরত ওই বৌদ্ধ তত্ত্ব হিন্দু ধর্মের এতটাই কাছাকাছি ছিল যে কারনে অনেকেই এই দু’ধর্মের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পেতেন না।উঁচু বর্ণের ব্রাহ্মণরা ধর্ম বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন। তারা বুদ্ধের দার্শনিক ভাবশিক্ষার বিরুদ্ধে ততটা সোচ্চার ছিলেন না। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তিপ্রস্তর অর্থাৎ, প্রাচীন কাল থেকে রক্ষা করে আসা বেদে দেওয়া ব্রাহ্মণদের দৈবত্ব ও প্রভুত্ব এবং কর্তৃত্বকে যখন বৌদ্ধবাদে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো তখন তারা তার সর্বাঙ্গীন বিরোধিতা করলেন। বৌদ্ধ ধর্মের পতনের কারন নিয়ে গবেষণা করা শ্রী নরেশ কুমার মনে করেন যে বৌদ্ধবাদের বিরোধিতা এবং একইসাথে ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের পুনর্স্থাপনের জন্যে ব্রাহ্মণ পুনর্জাগরণীরা তিন ধাপের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন।
প্রথম ধাপে তারা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর অত্যাচারের অভিযান শুরু করেন। তারপরে তারা বৌদ্ধ ধর্মের ভালো দিকগুলো চিহ্ন করে নেন যাতে করে নীচু জাতের বৌদ্ধদের মন জয় করা যায়। কিন্তু বাছাইকৃত আত্মীকরণের এই ধাপে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্য যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ না হয় তা নিশ্চিত রাখা হয়। বৌদ্ধবাদ ধ্বংস প্রকল্পের শেষধাপে গৌতম বুদ্ধ হিন্দু বিধাতা বিষ্ণুর আরেকটি অবতার ছাড়া আর কিছুই নন এই ধারণা চালু করে তা চারিদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এভাবে বুদ্ধকে ব্রাহ্মণ্যবাদের সর্বদেবতার মন্দিরের অগুন্তি ঈশ্বরের সামান্য একটিমাত্র তে পরিণত করা হয়। অবশেষে বৌদ্ধরা মূলত শুদ্র আর অচ্ছুত হিসেবে জাতপ্রথায় আত্মীকৃত হলেন আর এভাবেই নিজ জন্মভূমিতেই বৌদ্ধরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে লাগলেন ।
নীলেশ কুমার বলেন বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে চলা এই নির্মূলাভিযানকে বৈধতা দিতে ব্রাহ্মণ্য লেখাগুলোতে বৌদ্ধদের প্রচণ্ডভাবে তিরস্কার করা হয়। মনুসংহিতায় মনু বলেন যদি কেউ বুদ্ধকে স্পর্শ করে তবে সে স্নান করে নিজেকে শুচি শুদ্ধ করে নেবে। অপরাকা তার গ্রন্থে একই ধরণের আদেশ দেন। ব্রাদ্ধ হরিত ঘোষণা করেন যে বৌদ্ধ মন্দিরে প্রবেশ করাই পাপ যা কেবল আচারিক স্নানের মাধ্যমে স্খলিত হতে পারে। এমনকি সাধারণ জনগণের জন্যে লেখা নাটিকা কিংবা পুথিগুলোতেও ব্রাহ্মণ পুরোহিতেরা বুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণার অর্গল ছড়িয়েছেন। প্রাচীন নাটিকা ‘মৃচ্ছাকথিকা’তে (পর্ব ৭), নায়ক চারুদত্ত এক বৌদ্ধ সন্তকে হেঁটে আসতে দেখে বন্ধু মৈত্রীয়কে ক্রোধক্তিতে বলেন আহ্! কী অশুভ দৃশ্য এক বৌদ্ধ সন্ত দেখছি আমাদের দিকেই আসছে।
কুমার বলেন অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের রচয়িতা ব্রাহ্মণ বর্ণের চাণক্য ঘোষণা করেন যদি কেউ শক্য বৌদ্ধ), অজিবিকাশ, শুদ্র বা নিষ্ক্রান্ত ব্যক্তিদের ঈশ্বর বা পূর্ব পুরুষদের পূণ্যার্থে উৎসর্গিত ভোজসভায় যোগদান করে তবে তার উপর একশ পানা অর্থদণ্ড আরোপিত হবে। ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুজ্জীবনের পুরোধা শঙ্করাচার্য বৌদ্ধবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড নিন্দামূলক কথার মাধ্যমে বৌদ্ধদের মনে সীমাহীন ভীতির সঞ্চার করেন ।পুরানের অনেক রচয়িতাও মিথ্যা কলঙ্ক, অপবাদ, চরিত্রহরণের মাধ্যমে ঘৃণার এই পরম্পরা অব্যাহত রাখেন। এমনকি বিপন্ন সময়েও কোনো বৌদ্ধের বাড়িতে প্রবেশ করাকে ব্রাহ্মণদের জন্যে মহাপাপ হিসেবে তাদের ধর্মগ্রন্থ নারদীয় পুরানে আজ্ঞায়িত করা হয়। বিষ্ণু পুরানে বৌদ্ধদের মহা মোহ হিসেবে উপাধিত করা হয়। তাতে বৌদ্ধদের সাথে কথা বলার পাপ কে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয় যারা এমনকি বৌদ্ধ সন্তানদের সাথে কথাও বলবে তাদের নরকে যেতে হবে।
"তথ্যসূত্র"-সদালাপ সহ আরো বেশ কয়েকটি সাইট থেকে নেয়া ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:৩৮