ফ্রেঞ্চ ভাষাটা আমি মোটা মোটি বুঝতে পারি ,কিন্তু বলতে সমস্যা হয়।আর এই বুঝতে পারাটই আমার জন্য তিক্ত কষ্টকর একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণ হয়ে দাড়াল ! রাগ, অভিমান, হাহাকার সব মিলিয়ে এ এক অদ্ভুত অনুভূতি।
দোকানের কর্মচারী যখন গরম ভাবে বললো,"কেসকো ভ্যূ ভ্যূলে ?" মানে , কি চাও ? তখনও বুঝিনি আরো অনেক কঠিনতম কথাই আমাকে হজম করতে হবে ।
পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র আইভরি কোস্ট । ১৯৬০ সালে ফরাসী উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে । এখানকার একমাত্র প্রধান ভাষা হিসাবে ফ্রেঞ্চটাই বেশী প্রচলিত। অনেকে জানেই না ফ্রেঞ্চ ছাড়া অন্য ভাষাতে উচ্চ শিক্ষা সম্ভব! একবার আমাকে একজন মধ্যম শিক্ষিত লোক জিজ্ঞেস করেছিলো "তুমি তো শিক্ষিত না , তা এই বড় পোস্টে চাকুরীটা ম্যানেজ করলা কিভাবে ?"
আমার একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী আছে ,তাও বিশ্বে প্রসিদ্ধ একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি থেকে ,তাই অবাক হলাম ,"আমি শিক্ষিত না! কে বললো তোমাকে! "
তার সরল মন্তব্য ,"তুমি তো ফ্রেঞ্চ পারো না, আর ফ্রেঞ্চ না জানলে কী উচ্চ শিক্ষা সম্ভব !"
আইভরি কোস্ট এর অনেক লোক ই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়।স্বৈরাশাসক ফেলিক্স হুফেট বোগনি এর শাসন , ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, ২০০০ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর অনুগত সরকারের বিতর্কিত আইন পাস , ২০১০ সালের নভেম্বর এর বিতর্কিত নির্বাচন, পরাজিত রাষ্ট্রপতি লরেন্ট জি বাগবো এর ক্ষমতা ধরে রাখার অপচেষ্টা ,তারপর রোমহর্ষক গণহত্যা , সব মিলিয়ে গত দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার দেশ টি ।
চাকুরীর প্রয়োজনেই এই দেশে আশা ! আশেপাশে অনেকেই একই কারণে এদেশে থাকছে । আমার থেকে সামান্য নীচে সাধারণ পোষ্টেও অনেক বাংলাদেশী আছে এখানে।তাদের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছিলাম কিছু কেনাকাটা করার জন্য দালওয়া শহরে - রাজধানীর মতো বড় না হলেও ,বড় শহরগুলোর একটি এটি ।
আমার মোবাইল ফোনটা খুব শখের , পুরান মডেল ,নোকিয়া 7610 ।
কভার টা কেমন করে যেনো ভেঙে গিয়েছে ।এইরকম একটা দেশ ! কভার পাবো কিনা সন্দেহ । বাংলাদেশে হলে এক শ' টাকায় ঠিক একটা সুন্দর কভার পাওয়া যেতো!
একটু খুজে পেতে মোবাইল এর একটা বড় দোকান পেলাম ।
আমি দোকানে ঢুকে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি , যদি চোখে পরে সঠিক কভারটা ।দোকানদার আমার দিকে সন্দেহ এর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ।একজন কর্মচারী একটু গরম ভাবে বললো,"কেসকো ভ্যূ ভ্যূলে ?" মানে, কি চাও?
আগেই বলেছি , ফ্রেঞ্চ ভাষাটা আমি মোটামোটি বুঝতে পারি ,কিন্তু বলতে সমস্যা হয়। বললাম , "জ্যু না পা পাস পার্লে ফ্রসে।" মানে, আমি ফ্রেঞ্চ বলতে পারি না ।
সে এবার পরাপুরি ক্ষেপে গেলো , চেঁচিয়ে উঠলো ,"গো গো , নো সেল ,নো সেল ।"
আমি অবাক ! এ কি ধরনের ব্যবহার ! কথা না বাড়িয়ে অন্য দোকানে চলে গেলাম ।
প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম। সূর্যটা ঠিক মাথার উপর । চারপাশে মানুষের অনেক ভীড় । নিন্ম শ্রেণীর লোকজন । আমাদের দেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভাব তাদের মধ্যে । দুই এক জন ছুটো ছেলেপোলে এসে আমাকে ঘিরে ধরলো ,সাহায্য চায়। আমার সাথে আমার অধ:স্তন একজন , সে তাদের তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে।
"স্যার! এদের নিয়ে আর পারা গেলো না ,ফকিরের জাত ।"
"ছি: এমন ভাবে বলতে হয় না।"
রাস্তায় গাড়ির ভীড় । টোয়োটা , মারসিডিজ , বিএমডাব্লিউ গাড়িই বেশী।ধনী , ভীষণ ধনী শ্রেণীর লোকেরও অভাব নেই এখানে। তাদের হাতে প্রচুর টাকা ।
আইভরি কোস্ট দেশটি বিশাল বনজ সম্পদের ভান্ডার। প্রচুর পরিমাণে কফি, মিষ্টি আলু, ভুট্টা , বাদাম,কোকা প্রভৃতি চাষ করা হয় । হীরা, স্বর্ণ, লৌহ প্রভৃতি খনিজ সম্পদ ভরপুর দেশটি । ৩,২২,৪৬২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিশাল দেশ এটি ।
ইস্ ! আমাদের দেশ টার যদি এতো কিছু থাকতো !
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস আর হাহাকার বেড়িয়ে অসলো নিজের অজান্তেই ।
এক দুই করে কয়েকটা দোকানে ঢুকলাম , পাবার আশা নাই বুঝে কিছু জিজ্ঞেস না করেই বের হয়ে আসলাম ! আমি বেড়িয়ে আসার সময় টের পেলাম ওরা কেমন তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে ।
কি ব্যাপার ! আমাকে দেখতে কি খুব বাজে লাগছে । আবার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ! আমি লম্বায় খুবই খাটো , ৫ ফিট ৬ ইঞ্চ । আমার তুলনায় ওরা একেকটা দৈত্য । নিজেকে সান্তনা দিলাম , থাক আমার যা আছে তার অনেক কিছুইতো ওদের নেই ।
একটা বড় দোকান দেখে আশা পেলাম । দোকানদার আমাকে দেখে পাত্তাই দিলো না । অন্য কাষ্টমার নিয়ে ব্যস্ত । একজন সেল্স মেন আমার দিকে এগিয়ে আসছিল । তাই দেখে মালিক শ্রেণীর লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো ,"ইল লে বংলাদেশি , ইল সন ট্রে প্যোভ্র " অল্প বিস্তর ফ্রেঞ্চ জানি বলে ধাক্কা মতো খেলাম , সে আরো যোগ করলো ," ইল ন্যূ ভ্যু রিয়ে আশিটে "
বলে কি লোকটা । আমি নির্বাক ! সে বলছিল ,"এরা বাংলাদেশী ,একদম ফকির " পরে যোগ করলো ,"তারা কিছুই কিনবে না "
আমি লজ্জায় ,কষ্টে ওখানে দাড়াতেই পারলাম না ।বের হয়ে আসলাম ।
রাগে দু:খে গা জ্বালা করছিল । অহেতুক এদিক সেদিক ঘুরলাম । আমার সাথে আরেকজন অফিসার এসেছিলো , খালেদ আল মামুন । তাকে খুজলাম । সে অন্য দোকানে । কোনো ভাবেই মনটা হালকা হচ্ছিল না। তাকে পেলে সব খুলে বলতাম । এতো বাজে ধারণা বাংলাদেশীদের প্রতি! তাও এমন একটা নগণ্য জাতির কাছে ! আশে পাশে খালিদকে পেলাম না।
রাস্তার পারে একটা টঙ দোকান ।এর মধ্যে বুঝে গিয়েছি ওদের চুখে আমাদের অবস্থান । আমরা কি তবে....? কিছুই ভাবতে পারছি না , অথবা ওই ভাবে ভাবতেই ইচ্ছা হচ্ছে না।
টঙ দোকানদার হয়তো আমার অস্থিরতা টের পাচ্ছিলো । দেখলাম বন্ধুত্ব পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে , "বৌজোঁ !"
যদিও এখন ভর দুপুর কিন্তু তার সুপ্রভাত সম্ভাষণের উত্তরে আমিও"বৌজোঁ "বললাম । সে আমাকে তাদের শ্রেণীর একজন ভাবতে পেরে খুব আন্তরিক ভাব দেখালো । বলার অপেক্ষা রাখেনা লোকটা খুবই গরীব শ্রেণীর । সে দেখলাম অনেক আন্তরিক ভাবে আমি কি চাচ্ছি জানতে চাইল । আমি তাকে বুঝলাম ইশারা ইঙ্গিত আর স্বল্প ভাষাজ্ঞান দিয়ে ।
মোবাইল এর কভার টা দেখলাম তাকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমি কী চাচ্ছি । সে হেসে বললো ,"ওঃ! ক্যবল ।"
আমি আবার ক্লিয়ার করার চেষ্টা করলাম , আমি আসলে ক্যাবল চাচ্ছি না । মোবাইল এর ভাঙা কভার টা খুলে দেখলাম ।হাতের ইশারাতে বুঝালাম ভেঙে গিয়েছে ।
বুঝতে পেরে বেশ উৎফুল্ল দেখালো তাকে ,"ছে…,আবিয়াজ !"
সঠিক নামটা খুজে পাওয়াতে আমিও বেশ খুশি হলাম ," উঈ ,উঈ ,ছে...ছা ...,আবিয়াজ! "
আবিয়াজ, মানে মোবাইল কভার কোথায় পাওয়া যাবে দেখিয়ে দিলো সে । দুটো দোকান ,একটা যেখানে দোকানদার বলেছিলো ,"এরা বাংলাদেশী ,একদম ফকির।" সেই দোকানটা এবং তার পরের দোকান টা ।
রাগটা আমার পড়েনি । ঠিক করলাম পরের দোকানটাতে যাবো ।যাচ্ছিলাম সেই দিকেই । এমন সময় দেখলাম ,আমাদের দোভাষী । এই দেশেরই শিক্ষিত এক যুবক ।প্রচুর টাকা পায় সে আমাদের সাথে কাজ করে । আমাদের প্রচুর সন্মান করে। তাকে দেখে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম । ঠিক করলাম আগের দোকানটাতেই যাবো ।
ঢুকতেই বিরক্তের দৃষ্টিতে তাকাল দোকানী ।
দোভাষীর মাধ্যমেই কথা বলতে পারবো এবার ।
বিরক্তির সাথে "আবার আসছে..!"এধরেনের একটা উক্তি শুনেই দোভাষী চটে গিয়ে দোকানিকে ধরে ফেলল ।খুব কড়া করে কিছু বললো। সামান্য কথা চালাচালি । কিছুক্ষণ পরে অনিচ্ছা সত্যেও কয়েকটা কভার বের করে নিয়ে অসলো দোকানদার।
আমার যেটা দরকার সে কভারটা পেয়ে গেলাম । যতটা খুশি হয়েছিলাম, দাম শুনে আমি আবার ততটা হতাশ ।সাড়ে তিন হাজার শেফা ,প্রায় সাড়ে পাচ শ টাকার মতো । আমি যখন দ্বিধা দ্বন্দর মধ্যে তখন দেখি দোকানী মহা উৎসাহের সাথে দোভাষী কে বলছে , “বলেছিলাম না, এরা ফকির ! লে বংলাদেশি ভিয়েন ঈল না'শিটে রিয়ে । " মানে, বাংলাদেশীরা এখানে খামাখা ঢুকে কিন্তু কিছুই কিনে না।
দোভাষী চুপ ।আমার দিকে তাকাল একবার , দোকানি বলেই চলছে ,
"ঈল ডেমন্দ ছ্ল্মঅ লে প্রি ।" মানে, এরা শুধু দাম ই জিজ্ঞেস করে ।
দোভাষী এবার মাথা নিচু । কথা বলার মুখ নাই ।
আমার আঁতে ঘা লাগলো । ঠিক করলাম যতো দাম ই হোক আমি এখান থেকেই নিবো।
দোকানী আরো কি বলতে যাচ্ছিল ,"ঈল নো দ্যেরাঞ্জ... " মানে, তারা কেবলই বিরক্ত করে..... আমি তাকে থামিয়ে বললাম ,"ঠিক আছে আমি এটাই নিবো ।"
দোকানী বেশ অবাক ! দামটা বোধ হয় সে ইচ্ছা করে অনেক বাড়িয়ে বলেছিলো।দোভাষীর হাসি মুখ দেখে আমি সাথে যোগ করলাম, "আমাদের দেশে অবশ্য এটা অনেক সস্তা ।"
দোকানি এবার আমাকে পেয়ে বসল,বিদ্রুপের সাথে বললো ," কার সাথে কার তুলনা করছো ! বাংলাদেশে তো সব নকল, ভেজাল।মানুষ গুলোও তাই ,আমাদের এখানে এসেও তারা দুই নম্বরী করার চেষ্টা করে.....। "
দোভাষী কথা গুলো খুব গুছিয়ে শালিন ভাবে বলার চেষ্টা করলো আমাকে । কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিলো পেরেক দিয়ে কেও আমার কানের পর্দা ছিদ্র করছে।অসহ্য লাগছে । কে কখন দুই নম্বরী করলো জানার ইচ্ছা হচ্ছিল প্রচন্ড ।
পরে আরো কষ্ট পেতে হতে পারে ভেবে কিংবা দোভাষীর তাড়া খেয়ে আমি আর প্রসংগ বাড়ালাম না । শুধু বললাম অল্প কিছু লোক দিয়ে পুরো একটা দেশকে মাপা ঠিক না ।
চরম সংশয় আর বিপদে পড়লাম যখন দেখলাম কভার টা আমার সেট এ ঠিক মতো ঢুকছেনা । আমি ব্যাপারটা দোকানী কে দেখিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। দোকানদার আমার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী ভাবে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, "এটা তো আমি আগেই জানতাম যে .....।"
দোকানদার কি জানত আমি জানি না,কিন্তু আমি জেনে গেলাম আমার কি করা উচিত ।
আমি বললাম, "যেহেতু এটা লাগছে না ঠিক মতো তাই আমি এটা নিচ্ছিনা , কিন্তু যেহেতু এতক্ষণ এটা ঘাটাঘাটি করলাম তাই আমি তোমাকে তার জন্য মূল্য দিয়ে যাচ্ছি। এই অল্প টাকা ! কোনো ব্যাপার ই না। "
সাড়ে তিন হাজার শেফা বের করে ছুড়ে দিয়ে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে ।
সাড়ে তিন হাজার শেফা আমার ক্ষতি হলো , কেনা হলো না আমার মোবাইল কভার । কিন্তু বের হওয়ার সময় দোকানদারের বিস্মিত চেহারা দেখে আমি জেনে গেলাম কি বিশাল লাভ হলো আমার ! ব্যক্তিগত লাভ নয় , সমগ্র একটা জাতির জন্য বিশাল একটা লাভ!
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:৫৪