বৃষ্টি আমার অসম্ভব ভালো লাগে। টানা বৃষ্টিতে যখন সবার নাভিশ্বাস উঠে যায়, তখনও আমি আরো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে থাকি। আমার এই বৃষ্টিপ্রীতি এখনকার না। যখন খুব ছোট ছিলাম তখন থেকেই বৃষ্টি অনুরাগী ছিলাম। স্কুলে থাকাকালে বৃষ্টি হলে স্কুলে যাওয়া হতো না। অজপাড়াগাঁয়ের স্কুল, তার উপর রাস্তাঘাট খুবই খারাপ। তাছাড়া প্রায় প্রতিবছর ঝড় এলেই আমাদের স্কুলের টিনের ছাউনি উড়ে যেত। এসব কারণে বৃষ্টিতে অঘোষিত ছুঠি ছিল। স্কুলে না গেলেও বৃষ্টির দিনে আমাকে ঘরে পাওয়া যেত না। কাঠের ডাটের বিশাল ছাতা নিয়ে একা একা বেরিয়ে পড়তাম। পিচ্ছিল মেঠো পথ, ব্যাঙের ডাক, শালবন, সবুজ ধানক্ষেত আর ছাতা ছাপিয়ে শরীর ভিজিয়ে দেওয়া হিমেল বৃষ্টি। একটা ঘোরলাগা অনুভূতি। স্কুল পেরিয়ে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পরও অভ্যাসটা ছিল কিন্তু গ্রাম ছেড়ে আসায় ঠিক সেভাবে বর্ষাকে উপভোগ করতে পারিনি।
আর এখন তো আমি অন্য জগতের বাসিন্দা। বর্ষা কখন আসে আর কখন যায় টের পাই না । এই কংক্রিটের জঙ্গলে বসে বৃষ্টি দেখার সময়টুকুও নেই। অফিসের চার দেয়ালের মাঝে দিন কি রাত সেটাই বোঝা যায় না আর তো বৃষ্টি। হঠাৎ হঠাৎ রাতে যখন প্রচন্ড ঝড়ের শব্দে যখন ঘুম ভেঙে যায় তখন বারান্দায় দাড়িয়ে ঝড়ো বাতাস ডিঙিয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে আমার মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। কোলে বসে বৃষ্টির জন্য সে তার বাবার পাগলামী দেখে। আর বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে বাবার বুকে মুখ লুকায়।
একবার ছুটিতে গ্রামে গিয়ে হঠাৎ করেই বর্ষা দেখার সৌভাগ্য হয়। পুরোনো দিনের মতো ছাতা মাথায় বৃষ্টি দেখতে বেরিয়ে পড়ি। চাইনিজ ছোট ছাতা শুধুমাত্র মাথাটা ঢাকতে পারে। শরীরের বাকী সব জায়গা বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে যায়। ভিজতে ভিজতে পুরোনো দিনের ঘ্রাণ খোজার চেষ্টা করি। মস্তিস্কের নিউরনে রক্ষিত সেই গন্ধের সাথে এই বৃষ্টির গন্ধ মিশে গিয়ে আবার কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আমি হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরি তাকে। ধীরে ধীরে সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝে হারিয়ে যাই। সেই টুপটাপ শব্দ, ব্যাঙের ডাক, সবুজ ধানক্ষেত আর আমি। মনে হতে থাকে এই মুহূর্তটা যদি ধরে রাখতে পারতাম! পকেটে থাকা ওয়াটার প্রুফ প্যাকেট দিয়ে মোড়ানো মোবাইলটা বের করি। রেকর্ডারটা অন করে শব্দগুলো ধরি। চোখ বন্ধ করি। আবার আমি যেন সেই কৈশরে। কতক্ষণ এভাবে পার হয়েছে বলতে পারি না। কাছেই হঠাৎ প্রচন্ড বাজ পড়ার শব্দে চমকে গিয়ে মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। ভাগ্যিস প্যাকেটে মোড়ানো থাকায় নস্ট হয়ে যায় নি। আমি আর দেরী না করে ঘরের দিকে পা বাড়াই। আমার ছোটবেলার চেয়ে ইদানীং বজ্রপাতের পরিমাণ মনে হয় অনেক বেড়ে গেছে। প্রায়ই বজ্রপাতে মৃত্যুর খবর দেখা যায়।
ছুটি শেষে আবার সেই কর্মব্যস্ত জীবন। ৯-৬ অফিস, ট্রাফিক জ্যাম, ঘুম। নিত্যকার রুটিন। এই একঘেয়ে জীবনেও যেন কিছুটা চাঞ্চল্য নিয়ে এলো রেকর্ড করা বৃষ্টির সেই শব্দগুলো। একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে ত্রাহি অবস্থা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসলেও আমি প্রচন্ড গরমের জন্য সীটে বসেও ঘুমুতে পারছি না। তখন কী মনে করে মোবাইলে বৃষ্টির রেকর্ডারটা অন করে কানে হেডফোন গুজে দেই। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনেই মনে হলো একটা শীতল বাতাস গা ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তারপর থেকেই ট্র্যাফিক জ্যামে এটা আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল। অবস্থা এমন হলো এই অভ্যাসটা আমার ছুটির দিনগুলোতেও হানা দিতে শুরু করল। ছুটির দিনের দুপুরে কানে হেডফোন গুজে বৃষ্টির শব্দ শুনি। সাথে যোগ হলো ফুল স্পীডে ফ্যানের বাতাস। তখন চোখ বন্ধ করলে মনে হতো সত্যি সত্যিই আমি বৃষ্টির মাঝেই আছি।
তেমনি এক ছুটির দিনের দুপুর। বউ-বাচ্চা গেছে শশুরবাড়ি। একা একা গরমে ভাল লাগছিল না। ফ্যান চালিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির শব্দ শুনছি। আস্তে আস্তে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ কান্নার আওয়াজ পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠি। দেখি ড্রয়িং রুমে বসে এক লোক কাঁদছে। ভয় পেয়ে যাই। এসময় তো বাসায় কারও থাকার কথা না। তাহলে কাঁদছে কে? আমি ধীরে ধীরে কাছে যাই। আলতো করে কাধে হাত দেই। সে ফিরে তাকাতেই ভয়ে পিছিয়ে যাই। একী! এ যে আমার চেহারার একটা লোক।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি "আপনি কে? কাঁদছেন কেন?" সে বলে "আমি তোমার ভেতরের আমি। আমাকে তুমি দেখ না, কিন্তু আমি জানি তুমি আমার অস্তিত্ব অনুভব করো। বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝেও যখন নিজেকে একা একা লাগে তখন তুমি আমার অস্তিত্ব বুঝতে পারো। অনলাইনের ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মত্ত থাকা তুমি যখন ডিপ্রেসনে ভুগো তখন তুমি আমাকে অনুভব করো। যখন তোমার বন্ধু বা কাছের কারো ঘুরে বেড়ানোর ছবি দেখে তোমার মাঝে জেলাসি হয় তখন তোমার অস্তিত্বে থাকি আমি।" তার প্রতিটি কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরতে থাকে। মাথায় তীক্ষ যন্ত্রণা অনুভব করি। মুখ ফুটে আবার জিজ্ঞেস করি "তুমি কাঁদছো কেন?" আমার দিকে তাকিয়ে করুণ হাসি দিয়ে বলে "নিজেকে জিজ্ঞেস করে উত্তরটা জেনে নিও"।
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বুঝতে পারি বাজ পড়ার শব্দটাও রেকর্ড করতে ভুলেনি জড় মোবাইলটা। রাজপথে ভারী ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে থেতলে যাওয়া কুকুরের মতো পড়ে থাকি বিছানায়।
আগের লেখাগুলো-
এলোমেলো চিন্তা
এলোমেলো চিন্তা-২ (সবুজের সন্ধানে)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২২ রাত ৮:০৩