স্থান: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাত্রী ছাউনী।
কাল: ঘামে ভেজা গ্রীষ্মের কোনো দুপুর।
গন্তব্য: নীলক্ষেত।
উদ্দেশ্য: বইকেনা।
গল্পের শুরুটা এভাবেই। আমি সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছি। জব শুরু করেছি ৬-৭ মাস হবে। এর মধ্যে আবার একটা জব চেন্জও করে ফেললাম। আগের জবটা ভালই ছিল, হল থেকেই অফিস করতে পারতাম কিন্তু পাত্তি কম ছিল। তাই নতুন জব অফারটা পাওয়ামাত্র লুফে নেই। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়। ৫-৬ বছর ধরে জমে ওঠা মায়া কাটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হলাম। এয়ারপোর্টের কাছে আশকোনা নামক একটা জায়গায় আমার নিজের এলাকার কিছু ছেলেপেলের সাথে উঠলাম। নতুন পরিবেশ, মেসের জীবন। মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তারপর আবার আমার বউসুলভ কম্পিউটারটিকে হলে জুনিয়রদের কাছে রেখে এসেছি, ডেস্কটপ কম্পিউটার টানা-হ্যাচড়ার ঝামেলার কারনে আনা হয়নি। ভেবেছি সময় করে কোনো এক ছুটির দিনে গিয়ে নিয়ে আসব। এর মধ্যে ছুটি পেয়েছি অনেক কিন্তু ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বের করতে পারিনি। কম্পিউটার কেন বউয়ের মত তা নিশ্চই আর ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন নেই। ব্যাচেলর লাইফে এর চেয়ে সুন্দর বউ আপনি পাবেন না। পড়াশোনা থেকে শুরু করে, মুভি দেখা-গান শোনা, ফেসবুকিং - ব্লগিং সবই তো আমার উনির উপর ন্যাস্ত ছিলো। এমনকি রাতের বেলা রুমমেটরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমার উনি আমাকে অনেক কিছু দেখাতো।
যাক মূল কথায় আসি। তো আমার উনিকে ছাড়া এই ঢাকা শহরে আমার কেমন একা একা লাগতো। অফিস এর পরের সময়টা কাটতেই চাইত না। অগত্যা আমার উচ্চ মাধ্যমিক জীবনের দ্বারস্থ হতে হলো। বুঝিয়ে বলছি, যখন আমি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তাম তখন কম্পিউটার নামক বউটি আমার নাগালের বাইরে ছিলো। দু-একদিন স্বচক্ষে দেখেছি , কিন্তু দূর থেকেই। ছুয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সে সময়টাতে আমার অবসরের একমাত্র সঙ্গী ছিল বই। প্রচুর পরিমানে বই পড়তাম। তিন গোয়েন্দা তখন বিদায় নিতে শুরু করেছে জীবন থেকে, আর সেসময় ওয়েস্টার্ণ এর প্রবেশ। এরপর ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হবার পর যখন বউ কাছে পেলাম, তখন থেকে আসলে বই পড়াটা খুব বেশি হয় নি। তো আমার উনির সাথে এই ক্ষনিকের বিরহ আবার আমাকে বই পড়ার সুযোগ করে দেয়। মেসে একজন বন্ধু ছিল। ওর কাছে ওয়েস্টার্ণ বইয়ের দারুণ কালেকশন ছিলো। ওর সব বইগুলো শেষ করার পর থেকেই মূলত আমার নীলক্ষেতে আনাগোনা।
আজকে রবিবার, আমার ছুটির দিন। দাড়িয়ে আছি বাসের জন্য। প্রচন্ড গরম। চারদিকে মানুষের ঘামের কেমন উৎকট গন্ধ। কিন্তু হটাৎ মনে হল একটু মৃদুমন্দ বাতাস, হালকা সুবাস। আমার হার্টবিট একটু বেড়ে গেল। দেখলাম এত লোকের ভিড়ে বাসে ওঠার জন্য আরো একজন আসছে। ছিনেমার মত তার সাদা ড্রেসের ওরনাটা আমার কাছ ঘেষে যায়। আপাদমস্তক সে সাদা পড়ে আছে। সাদা পরী। আমার মনে হল আমি তাহাকে পাইলাম, যাহার জন্য গত ২৪টি বসন্ত ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু মনটাই খারাপ হয়ে গেল যখন দেখলাম আমার মত সব ছেলেপেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক আমার মত করে। দেখে মনে হল উনাকে পাবার লাইনটা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। আমি মনে মনেই তাকে ভালবাসা দিতে থাকি। (ইতোপূর্বেও মনে মনে অনেকবার ভালবেসেছি) পিছন থেকে আড় চোখে দেখি তার চুলগুলো। ইচ্ছে করে ...। জানি না কী ইচ্ছে করে। মনে মনে প্রার্থনা করি, ঐ পরীটিরও গন্তব্য যাতে নীলক্ষেত হয় এবং বাসে যেন আমার পাশের সিটেই বসে। তাকে নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাই। বাসে উঠেছি, মাত্র দুটো সীট ফাকা আছে তার একটায় আমি বসেছি। আর একটা সীট ফাকা আমি মনে প্রাণে চাইছি যেন ঐ মেয়েটি এই বাসে ঠিক আমার পাশে বসে। দেখি সত্যি সত্যিই মেয়েটি বাসে উঠল। আর কোনো সীট ফাকা নাই, আমার পাশে বসতেই হবে। আমি আগেভাগেই তার জন্য জায়গাটা ফাকা করে দিলাম। সে একটা মিস্টি হাসি দিয়ে আমার পাশে বসল। ঐ হাসিটার টানা চৌদ্দদিন টয়লেট না করে দাড়িয়ে থাকতে পারব। হাসি না সত্যি। গোপাল ভাড়ের একটা গল্পে পড়েছিলাম টয়লেট করার চেয়ে শান্তি দুনিয়াতে নাই। আমি সেই শান্তি তার জন্য উপেক্ষা করব। বাস্তবে ফিরে আসি যাত্রীদের হুরোহুরিতে। বাস এসেছে। অনিক এর একটা বাস মহাখালী-সাতরাস্তা-সোনারগা হয়ে নীলক্ষেত। তারাতারি টিকেট করে বাসে উঠলাম। বাসে উঠে দেখি আমার স্বপ্নের পরী বসে আছে। না না, যা দেখছি ঠিকই দেখছি। এটা স্বপ্ন নয়। সে একটা সীটে বসে আছে, তো স্বপ্নের ঠিক উল্টোটা করলাম। স্বপ্নে সে আমার পাশে বসেছিলো, বাস্তবে আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু বিধী বাম, কিছুক্ষণ পরে হেল্পার এসে বলে "ভাইজান এইটা মহিলা সীট। আপনি অন্য সীটে গিয়া বসেন।" মনের দুঃখে বনে চলে যেতে ইচ্ছে হল, কিন্তু আপাতত পিছনের সীটে গিয়েই বসলাম। এমনভাবে বসলাম যাতে করে তাকে আমি দেখতে পারি। এমন সময় দেখলাম সে কানে হেডফোন দিচ্ছে।
আমিও নিজের কানে হেডফোন গুজে এফএম শোনা শুরু করলাম। কারণ আমি যে মোবাইল চালাই তার কোনো মেমোরী নাই। বাসে চলাচল করার সময় এফএম-ই আমার ভরসা। এই সময় কোনো এক আর.জে.(নাম কমুনা) বকর বকর করছে। আর বলে যে আপনার মনের কথা আমাকে এসএমএস করে জানান অমুক নাম্বারে। আমি কোনো দিন এসব অনুস্ঠানে কল বা এসএমএস পাঠাই নি। তবে এবার পাঠাবো বলে সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু কেন, তা আমি নিজেই জানি না। হয়ত ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ই এই প্রেরণা যুগিয়েছে।
আমি পাঠালাম এই লিখে.
"আমি বাসে করে যা্চ্ছি। আমার সামনে একটা সাদাপরী বসে আছে, যাকে প্রথম দেখাতেই আমার ভালো লেগে গেছে। দেখলাম তার কানে হেডফোন আছে। আমি জানি না সে রেডিও শুনছে নাকি এমপিথ্রি শুনছে। আর রেডিও যদি শুনেও থাকে তাহলে এই চ্যানেলটাই কিনা। কিন্তু আমার মন বলছে সে এখন এই এটাই শুনছে। তাই আমি আপনার মাধ্যমে ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানাতে চাই। অশুভ।"
একটা গান চলছিল রেডিওতে, তুমি বরুনা হলে...। গান টা শেষ হওয়ার পরে রেডিও শুনছি আর চিন্তা করছি আমার মেসেজ কখন পড়বে। আরেকটা গান শুরু হয়ে গেল আমার মেসেজটা পড়ল না। মন খারাপ। শেষে সম্ভাব্যতার সুত্রগুলো নতুন করে আওড়াতে শুরু করলাম। এটা যে সম্ভাব্যতার কঠিন নিয়মের মধ্যে পড়ে গেছে। প্রথমত আমার মেসেজটা রেডিওতে পৌছাতে হবে, দ্বিতীয়ত যারা মেসেজ নির্বাচন করে তাদের কাছে ভাল লাগতে হবে। তৃতীয়ত সাদা পরীর রেডিও শুনতে হবে, চতুর্থত তাকে এই চ্যানেলটিই শুনতে হবে। এত্তগুলা সম্ভাব্যতা মাঝে কেমনে কী? সম্ভবনা শুন্যের কোটায়। এসব চিন্তা করছি তখন হঠাত রেডিওটা বলে উঠল "অশুভ আমাদের কাছে মেসেজ পাঠিয়েছে। ওয়াও, লাভ এট ফার্ষ্ট সাইট। অশুভর মেসেজটা হল: .........। ওক্কে সাদা পরী, তুমি যদি আমাদের কথা শুনে থাক তাহলে তোমার কথা লিখে পাঠিয়ে দাও আমাদের নাম্বারে।" মনটা ভাল হয়ে গেলো। যাই হোক মনের কথাটা তো বলতে পেরেছি। মনের মধ্যে একটা ঢিপ ঢিপ শব্দ। এখানেও সম্ভাব্যতা, শুধু প্রথম দুটি বাদ যাবে। আরও কয়েকটা যোগ হবে। আরো দুটি গান হল। পরে আবার আমার কানে বেজে উঠল "অবিশ্বাস্য!!! অশুভ তোমার সাদা পরী এসএমএস পাঠিয়েছে তোমাকে।....."
স্কুলজীবনে কারো প্রেমে পড়লে মনটা যেমন করে, তেমন অনুভূতি হচ্ছে আমার। কিন্তু সেটা বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। কারন, আবার সম্ভাব্যতা। আমি যাকে দেখছি সেই মেসেজ পাঠিয়েছে কিনা, নাকি কেও মজা করছে। আর যদি সত্যিই কোন সাদা পরী হয়ে থাকে তবে সে হতে অন্য কোনো বাসে, অন্য কোনো গন্তব্যের। হঠাত দেখি সাদা পরী আমার দিকে তাকিয়েছে। সত্যিই তাকিয়েছে নাকি মনের ভুল? আমি আর উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলাম না। আবার মেসেজ পাঠালাম, "প্লীজ সাদা পরীটিকে বলে দিন, যদি সে আমার এই বাসেরই হয়ে থাকে, তাহলে আমাকে যেন আমার নাম ধরে একবার ডাকে।"
সময় গড়াতে গড়াতে কলাবাগান পার হয়ে সায়েন্সল্যাবের কাছে চলে এলাম। আর বড়জোর পাচ মিনিট। এর মধ্যেই কিছু একটা হতে হবে। একবার চিন্তা হচ্ছে, যাই আমি নিজেই গিয়ে কথা বলি, কিন্তু সম্ভাব্যতা আমাকে আটকে রাখছে। যদি এই মেয়েটি না হয়, তাহলে তো মাইরের হাত থেকে রক্ষা নাই। ইভটিজার উপাধি পাব ফ্রীতে। বাস সায়েন্সল্যাবের মোড় পেরিয়ে ঢাকা কলেজের সামনে। এই সময় আবার রেডিওতে আমার মেসেজটা পড়ল, সাথে আরেকটা মেসেজ যেটা সাদা পরী পাঠিয়েছে। সে লিখেছে সে নীলক্ষেতে নামবে। এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। আমি উঠে দাড়ালাম। ঐতো আমার সাদা পরী, একটু একটু করে তার দিকে এগোচ্ছি। সে পেছন ফিরে তাকালো ঠোটদুটো দুলছে, আমার নাম ধরে ডাকবে।
"অশুভ!!!"
অবশেষে তার ডাক শুনলাম আমি। নাকি ভুল? তার মুখটাতো স্হির আছে ঠোট দুটোও নড়েনি তবে কিভাবে কথা বলল। আবার শুনলাম
"অশুভ!!!"
আমি পেছনে তাকালাম, দেখি একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। কানে হেডফোন, হাতে মোবাইল আর পড়নে সাদা ড্রেস।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:২৪