সবকিছু নিয়ে মুনাফার মানসিকতা। একদিকে সরলতা অন্যপাশে তাকে পুঁজি করে হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতা। হুট করে বিশ্বাস; একসময় প্রতারিতের উপলব্ধি। আবার যাকে সঠিক ভাবছি, একসময় জানলাম তা বেশ একপেশে। বাঙালির এই দ্বৈত মানস চরম দ্বন্দের সমীকরণ।
লেখার শুরুতে ভূমিকার অবতারণা খতিয়ে দেখার প্রবনতাকে সমর্থন করার প্রয়াসে। কোন শুভ উদ্যোগ ভেস্তে গেলে যেমন দুঃখ লাগে। তেমনি মহত্বের মুখোশে দালালদের দৌরাত্বও মেনে নেয়া যায়না। ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার বন্ধু, ভাই সর্বোপরি ভ্রমণপিপাসুরা যে যুক্তি তর্কের অবতারণা করেছেন, এ লেখা তারই ধারাবাহিকতায়। বিশেষত ঢাকা-গুয়াহাটি সার্ভিস নিয়ে পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা।
অনেকেই বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিসা আবেদন ও ইস্যু হয় বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাই কমিশন থেকে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি এ প্রক্রিয়ায় ধানমণ্ডিতে আরও একটি Indian Visa Application Center- IVAC (স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার লোকাল অফিস) এর কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। ভারতীয় দূতাবাসের তথ্য মতে, ৩১ জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত ভারত সরকার প্রতিদিন ৪৫০০ থেকে ৫০০০ ভিসা ইস্যু করেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমনসহ নানা আবেদনে এসব ভিসা দেয়া হয়। এর একটি বড় অংশই ভ্রমন সংশ্লিষ্ট। ইস্যুকৃত ভিসার অন্তত ১০ শতাংশ রাখা হয় তদবিরের জন্য। চাহিদা অনুযায়ি ক্ষমতাশালী ব্যাক্তি ও বিশিষ্টজনদের এই কোটা থেকে ভিসা বরাদ্দ দেয়া হয়।
IVAC এর সাথে কথা বলে জানলাম, আবেদনকৃত ভিসার ৯০ শতাংশেরই এন্ট্রান্স হরিদাসপুর এবং বাই রোড। যার ফলে অন্যান্য রুট দিয়ে ভারতে প্রবেশের চাপ কম। বেনাপোল-পেট্রাপোলের মত চ্যাংরাবান্ধা বা ডাউকি সীমান্ত অতটা জনপ্রিয় না হলেও এ রুটগুলোয় ভ্রমন ভিসা ইস্যুর অন্যতম কারণ শ্যামলী পরিবহনের সার্ভিস এবং আবদার। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামুদর মোদির বাংলাদেশ সফরে উন্মুক্ত হয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলোর সাথে ভারতের করিডোর ব্যবস্থা। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও বিআরটিসি ঢাকা-গুয়াহাটি বাস সার্ভিস চালুর নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয় মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই রুটে নিম্নমানের বাস দিয়ে সার্ভিস চালু করে শ্যামলী পরিবহন। পরিক্ষামূলক এ ধারায় তাদের মদদ যোগাচ্ছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি। কিন্তু কেন কিসের বিনিময়ে সরকারি পরিবহন সংস্থা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহযেগিতা করবে ? জুন থেকে চালু হওয়ার কথা যে রুটের সেই রুটে এখনো কেন চালু হলো না সরকারি সার্ভিস ? কেন একটি সম্ভাবনাময় সেবা ছেড়ে দেয়া হলো ক’জন প্রভাবশালী আর দালালের হাতে। সে বিষয়ে জবাবদিহীতার প্রয়োজন ও দায় নেই কারও!
শ্যামলী পরিবহনে আপনি আমি ৫১০০ টাকা জমা দিয়ে ঢাকা-গুয়াহাটির জন্য যে ধাপ পূর্ণ করি সেখান থেকে তাদের কাজ শুরু। প্রথমেই বলে রাখি, তারা কিন্তু ই-টোকেন করে না। তারা জমা দেয় রিকুইজিশন ফর্ম। যা দেখতে হুবহু ই-টোকেন ফর্মের মতই। শুধু ডান পাশের কর্নারে ভিজিট ডেটটা থাকে না। এমনকি আপনার হয়ে ওরা স্বাক্ষরও দিয়ে দেবে আপনার ফর্মে। লাগবে কেবল, ন্যাশনাল আইডির ফটোকপি, ইউটিলিটি বিলের একটা ফটোকপি, ছবি, পাসপোর্ট এবং ডলার এনডোর্স অথবা ব্যাংক স্টেটমেন্ট। এসব কাগজের বাইরে যা লাগে তার সবই (স্বাক্ষর পর্যন্ত) নিজেরাই করে দেয় দালালরা। ধরে নিচ্ছি আপনি শিলং যাবেন, জনপ্রতি ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে যাওয়া আসার সময়টুকু বাদে মাত্র ২ দিনের শিলং ভ্রমণের খরচ। আদতে আমাদের টাকার অংকটা কম মনে হতে পারে। কিন্তু অংক বলে অন্য কথা।
অফার ১ : যাওয়া আসা বাবদ ৪ হাজার+ভিসা প্রসেসিং ফি ৬০০+ সার্ভিস চার্জ ৫০০ = ৫১০০ টাকা। এর বাইরে গুয়াহাটি কিংবা শিলং থাকা, খাওয়া, ঘোরা এমনকি ট্রাভেল ট্যাক্স তো আপনাকে মেটাতে হবে।
অফার ২: কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে সার্ভিস দেয়া হয় ১৫০০০ টাকার বিনিময়ে। গুয়াহাটি ও শিলং ভ্রমন করায় ট্রাভেল এজেন্সি ও শ্যামলীর যৌথ দালালরা। সময়টা একটু বাড়িয়ে শিলংয়ে থাকা কয়েকজন বাংলাদেশীদের দিয়ে সেখানেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দু-পয়সা কামিয়ে নেয় কাউন্টার কালেক্টররা।
পুরো প্রক্রিয়াটি হয় কমলাপুর, কল্যানপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিআরটিসি-শ্যামলীর বিভিন্ন সুসজ্জিত কক্ষে বসে। তাই এ নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়না সেবাগ্রহীতাদের মনে। এমন অফারের জন্য প্রচার হিসেবে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে এরা। অফারটি বুঝতে ২৬ জুন যোগাযোগ করি বিআরটিসি-শ্যামলীর কমলাপুর কাউন্টারে। সেখানে অমিত বাবু দুইজনের জন্য ১০,০০০ টাকা + ব্যাংক এনডোরসমেন্টের জন্য মাথাপিছু ৫০০ করে নিয়ে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিল। কী ভরসায় পাসপোর্টের মত গুরুত্বপূর্ণ দলিল তাদের জিম্মায় রেখে যাব জিজ্ঞাসা করায় তারা জানায়, এটা পুরোটাই বিশ্বাসের বিপরীতে বিনিময়। আমার যাওয়ার কথা ৩০ জুলাই অথচ ২৮ তারিখ পর্যন্ত ভিসা হয়নি। ২৮ জুলাই ইন্ডিয়ান হাই কমিশন থেকে আমাকে ডাকা হয়। অবশ্য আমার বন্ধুর ভিসা হয়ে যায় দুইদিন আগে। এরমধ্যে পাসপোর্ট জমা দেয়ার পর টোকেনটি রাখা ছিল শ্যামলীর কাছেই। সেটা বুঝিয়ে দিতে ছোটখাটো একটা নাটেকের অবতারণা করে তারা। তাড়াহুড়ো আর ৬০০ টাকা সিএনজি অটোরিক্সার খরচ মিটিয়ে হাই কমিশনে যাওয়ার পর সেখান থেকে জানানো হয় আমার পাসপোর্টের সাথে জমা দেয়া কাগজপত্র সব ভুয়া। আমার দেয়া বৈধ কাগজের কোনটাই শ্যামলীর দালালরা হাই কমিশনে জমা দেয়নি। এমনকি যে ভুলগুলো খুব সাধারণভাবে চোখে পড়ে তাও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি তারা। বুঝলাম এই র্যানকেট খুব বেপরোয়া এবং ক্ষমতাধর। ৩০ জুলাই সকালে ৩ জনের পাসপোর্ট বাতিল (ডিবার) করে দেয়া হল। অর্থাৎ এই তিনজনের ১ জন আগামি একবছর বাকি ২জন আর কখনই ভারতে যাওয়ার আবেদন করতে পারবে না। শ্যামলীতে ফোন দেয়া হলো তারা তখল পুরো বিষয়টি অন্যের ঘাড়ে চাপানোর এবং কোথাও একটা ভুল হয়েছে বলে দায় সারতে চাইলো। সাথে টাকা ফেরত দিতে টালবাহানার যুক্তি দিচ্ছিল। এমন প্রতারণার শিকার হয় আরও বেশ কজন। ভারতীয় হাই কমিশন জালিয়াতির প্রমান পাওয়ায় শ্যামলিকে ভিসা দেয়া বন্ধ করে দেয় ১ আগস্ট। ঘটনার পর থেকে বিস্তারিত কথা বলা এড়িয়ে যাচ্ছে দালাল বিপুল (01711448124) আনন্দ বাবু (01726624702) ও নয়ন (01714517373) সহ অন্যান্য কাউন্টারম্যানরা। একই কায়দায় জালিয়াতি করে বেশকজনের পাসপোর্ট বাতিল হয়েছে ঢাকা-শিলিগুড়ি রুটেও। সবশেষ ২ আগস্ট বাতিল হয় আরও ৪ জনের পাসপোর্ট। এরপর ৩ আগস্ট হাই কমিশনে গিয়ে জানতে পারি শ্যামলী উপর মহল থেকে বিষয়টি ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক করে আবারও তাদের ব্যবসা চালু করবে কিছুদিনের মধ্যে। শ্যামলীর পক্ষ থেকে সময়টা আগস্টের মাঝামাঝির মধ্যে ঠিক হয়ে যওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু যাদের পাসপোর্ট বাতিল করে দিল তাদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ পরিবহন সংস্থা ও ট্রাভেল এজেন্সি। সুতরাং সাধু সাবধান।
ই-টোকেনের জন্য হাইস্পিড ইন্টারনেট কানেকশন ও পিসি লাগে, বাসাবাড়িতে তো তেমন পিসি নাই তাই আমরা ছাড়া কেউ পারে না- উক্তিটি গুলশান সার্কেল -২ মোড়ে এক দালালের। তার দোকানও সেখানে। প্রকাশ্যে লেখা আছে- ভারতীয় ই-টোকেন করানো হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে যোগাযোগ করি একাধিক কম্পিউটার প্রকৌশলীর (নাম প্রকাশ না করার শর্ত আছে) সাথে। পেশাগত কাজে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ ৭ বছরের। তারা জানায়, নির্বাচিত কয়েকটি আইপি ছাড়া ই-টোকেন সার্ভারে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। তবে ভাগ্যগুনে দু-একজন ঢুকে যায়। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা- বিটিআরসি’র একশ্রেণীর দালালের থেকে তাদের দায়িত্ব থাকে আপলোড গেটওয়েটা জ্যাম রাখা আর নির্বাচিত আইপি’র জন্য পরিস্কার রাখা। ব্যাপারটা অনেকটা ট্রাফিক সিগন্যালের একপাশ আটকে অন্যপাশে গাড়ি ছাড়ার মত। এই কাজের জন্য তারা মোটা অংকের মাসোহারা পায়। তবে টাকার ভাগ এবং এ সংক্রান্ত অংক জানাতে অপারগ তারা। ভারতীয় হাই কমিশন এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কথা বলতে নারাজ। কেননা দালালরা যা করছে তাতে তাদেরও অনেক কর্মকর্তা কর্মচারি ভাগ পায়। স্বল্প চাকুরি জীবনে ভিনদেশে মিশনে এসে টু-পাইস কামিয়ে নেয়ার চান্স তাদের অনেকেই ছাড়তে নারাজ। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও প্রতারণা নিয়ে একটি লেখা বেশ কিছুদিন থেকে লেখক ছাড়াই ওয়েবে ঘুরছে। কেউ এর বিস্তারিত বা সত্যতা জানালে উপকৃত হই।
ছবি সংযুক্ত :
দালালদের কর্মতৎপরতা : কর্মদিবসের সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত ভারতীয় হাই কমিশনগুলোর আবেদন নিতে সার্ভার খোলা রাখায় হয় দিল্লীতে। বাংলাদেশ থেকে আট ঘণ্টার এই কাজ শেষ হয়ে যায় ৩ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে। দিল্লীর দেয়া তথ্য অনুযায়ি রেকর্ড সর্বনিম্ন ৩ মিনিটে এবং সর্বোচ্চ ৪১ মিনিটে বাংলাদেশ থেকে আবেদনগুলো আপলোড হয়েছে। হাই কমিশনের দাবি, দিল্লী থেকে বর্তমানে দিনপ্রতি ৪৫০০ থেকে ৫০০০ ভিসা দেয়া হয়। অর্থাৎ সেকেন্ডে সার্ভারে অন্তত ২৫ টি আবেদন আপলোড হয়। এবার আসা যাক এ সংক্রান্ত বাণিজ্যের বিষয়ে। ৫০০০ ভিসার জন্য ই-টোকেন প্রতি ২৫০০ টাকা করে নেয়া হলে দিনে অংকটা দাড়ায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। মাসে ৩৭ কোটি ৫০ লাখ। বছরে ৪শ ৫০ কোটি টাকা। ১৫ বছরে এ টাকায় আরেকটা পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।
ভারতীয় হাই কমিশনে দালালদের বড় একটি চক্র কাজ করে। তারা হচ্ছে ভারতের A1 ট্রাভেলস, ন্যাশনাল ও পপুলার ট্রাভেলস। এদের সাথেও শ্যামলির যৌথ বাটপারি আছে। সার্বিক সহযোগিতায় পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের পরিবহন সংস্থা – WBTD ও বনগাঁওয়ের স্থানীয় কয়েকজন দালাল। এই চক্রটি বাংলাদেশ থেকে ভারতের যে কোন রাজ্যে ভিসা পেতে দালালি করে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ট্রাভেল অপারেটর, শ্যামলীর দালাল ও ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মচারিরা টাকা ভাগবাটোয়ারা করে। লিগ্যাল প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও ঘুর্ণিপথ হওয়ায় শটকার্ট বাতলে দিতেই তাদের একজোট হওয়া। তবে এক্ষেত্রে খরচটা কয়েকগুন বেশি। ঝুঁকিও থাকে নথিপত্র গায়েবের।
• পেশাগত কারণে অভিজ্ঞতাপ্রসূত এবং সমালোচনাধর্মী লেখা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:০৯