বান্দরবন, নামটা শুনলেই মনে হয় বাঁদর ঝুলে যেই বনে। অদ্ভুত নামের এই জেলার প্রেমে পড়েছি আমি। আমি মুত্তাজান রেজা অমি। পেশায় একজন বেসরকারি প্রকৌশলী। চাকুরিজীবনের প্রায় সাড়ে তিন বছর চলছে। আমার জন্মস্থান দিনাজপুর, বেশ ছিমছাম ঠাণ্ডা একটি শহর। মাধ্যমিক পর্যন্ত শুধু খেলেবেড়ানোই ছিল জীবন। এরপরে ঢাকা থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে খুলনা থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক পাশ করি। ২০০৮ এর শুরুর দিকে প্রথম সময় নিয়ে ঘুড়তে বের হই, সাথে খুব কাছের দুই বন্ধু সুমন আর শাহআলম। সেবার ঘুরলাম চট্টগ্রাম, কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন। তখন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর ঘুড়তে বের হই, খুব কম করে হলেও বছরে একবার। সুন্দরবন, কুয়াকাঁটা, সিলেট, এসব খানে এখন পর্যন্ত গিয়েছি ২-৩ বার, আর আমার সবচেয়ে পছন্দের সেন্টমার্টিন আর বান্দরবনের প্রতিটিতে গিয়েছি আট বার। শুধু ২ বার গিয়েছি পরিবারসহ, মানে মা, বাবা, দাদা, মামনিরা (ছোট খালা) সহ। আর বাকি সববার গিয়েছি বন্ধু বান্দবদের নিয়ে। মাত্র গত সপ্তাহে ঘুরে আসলাম রাখাইন ঝর্ণা থেকে। এবার বান্দরবন গেলাম প্রায় এক বছর পরে। নানাবিধ কারনে প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত ছিলাম। খুব বেশী জরুরী ছিল এই বারের ভ্রমণ। আমি ঘুরতে যাই শুধু মজা করার জন্ন্যে, ব্যাপারটি মোটেও এই রকম না। মজা তো করতে যাই অবশ্যই, তার চেয়ে বড় হোলো নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করা, উপলব্ধি করা জীবনের প্রকৃত অর্থ, প্রকৃতিকে, নিজের প্রতিটি নিঃশ্বাসকে। পাহাড়িদের জীবনযাত্রায় আমি খুজে পাই জীবনের সম্পূর্ণ নতুন রুপ। যে সভ্যতার বড়াই করি আমরা, তা যে আসলে কতটা ঠুনকো, লোক দেখানো, মিথ্যা, তা হাঁড়েহাঁড়ে উপলব্ধি করা। নিউটনের ৩য় সুত্র মনে হয় শুধু পদার্থ বিজ্ঞান না, কার্যকরী প্রকৃতির ক্ষেত্রেও। প্রযুক্তি আমাদের কি দিয়েছে, তার তালিকা প্রস্তুত করা যেমন নেহায়েত বোকামি, তেমনি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া সম্পদের তালিকাও অনেক বড়। ৫-৭ জন বন্ধু একসাথে বসলে আগে আড্ডা চলত সারা রাত, আর এখন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট আর কম্পিউটার/ ল্যাপটপ এর কারনে এক সাথে বসার সমতই হয় না, হলেও মাঝখানে থাকে মোবাইল নামের একটি ভয়ংকর দানব। অজস্র মিথ্যা, আর পেশাদারি জীবনের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে বান্দরবনের কোনো বিকল্প মেলা আমার পক্ষে দুষ্কর। অনেকেই হয়তো বলবে মোবাইল বন্ধ রাখলেই হয়, কিন্তু এটি মোটেই সম্ভবপর নয় আমার মত চাকুরিজীবীর জন্নে। তাই বলতে গেলে বাঁচার জন্নে এবারের রাখাইন ঝর্ণা ভ্রমণ।
পটভূমি
এই বছরের মার্চ মাস থেকে আমি শাওনকে (কুয়েটের ঘনিষ্ঠ বন্ধূ) বলছি চল সবাই মিলে ঘুরতে যাই। পেছাতে পেছাতে সেপ্টেম্বর চলে আসল, দলবলও বেশ বড় হল, ৯ জন। শাওন, সাঈদ, দেবু, ব্রুস, শাহআলম, আলিম, ছোট ভাই স্টার, আশিক আর আমি। এই ঘটনাটি সেপ্টেম্বর এর প্রথম সপ্তাহের। স্টার এর বড় ভাই ডাক্তার, বান্দরবনেই পোষ্টিং। তিনি জানালেন এইবার বান্দরবনে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নরমালের চেয়ে প্রায় ৩০০% বেশী, তাই যাওয়ার ১ সপ্তাহ আগে থেকেই একটি প্রতিশেধক ঔষধ খেতে হবে। টেক্সট করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হল ঔষধের নাম। কিন্তু পরের দিনই স্টার জানালো, ঢাকায় পাওয়াই যাচ্ছে না ঔষধটি। তাই চট্টগ্রামে খোজার সাহস করলাম না আমি। প্রথম বাগড়া বাঁধালো ব্রুস, ছুটি পেলো না। ঠিক হোলো ওকে ছাড়াই যাবো সবাই। এরপরে ছুটি পেলো না শাওন আর সাঈদ। শাওন না যাওয়াতে দেবু যাবে না, সে না গেলে ছোট ভাইরা যাবে না, আর এত জন না যাওয়াতে যাবে না শাহআলমও। বাকি রইল শুধু আমি আর আলিম। মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। তারপর স্মরন করলাম রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানের ২টি লাইন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে। আবার ভাবলাম, আব্দুল যে পরিমাণ পাগল, ওর সাথে একা যাওয়া তো বেশ ভাল রকমের বিপদজনক। ও আমার দেখা সবচেয়ে বড় বান্দরবন প্রেমিক। ও এখনো কুয়েট থেকে বের হয় নি। এটা নিয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যাথাও তো নেই। ইন্টারনেটে ফ্রি ল্যান্সিং করে ও মাসে যত আয় করে, আমাদের ব্যাচের কেউ এখন পর্যন্ত চাকরি করে তার ধারে কাছেও পৌছাতে পারে নি। এই বছরেই এটা ছিল ওর ৪র্থ বার বান্দরবন ট্যুর। নাফাকুম, বগা লেক, কেওকাড়াডং, জাদীপাই ঝর্ণা, তাজিংডং, সাফাহাফলং, মদক মোয়াল, অমিয়খুম, সব ওর দেখা শেষ। শেষ বার ১০ দিন ছিল, ক্যাম্পাস এর ছোট ভাইদের নিয়ে ছিল ৫ দিন, আর ৫ দিন ছিল এক আমেরিকানের সাথে। এতকিছুর পরেও কবিগুরুকে গুরু মেনে আব্দুলকে বললাম, তোর সাথে বান্দরবন যাবো, তুই যেখানে নিয়ে যাবি, সেখানেই যাবো। তবে সময় ৩ রাত, ৪ দিন। আব্দুlল মহাখুশী। অতঃপর, আব্দুল আলিম ৮ই সেপ্টেম্বর খুলনা থেকে রওনা দিল দুপুর ২ তায়। ঢাকায় আর এক ছোট ভাই এর মাধ্যমে আমার দিনাজপুরের বন্ধু রাসেলের ডি এস এল আর ক্যামেরা আলিমের হাতে পৌছানো হোলো। আলিম ঢাকায় নেমে মাত্র ২ ঘন্টা পরেই বান্দরবনের গাড়িতে উঠে। বাসটি চট্টগ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ায় ভোর সাড়ে ৫টায় আমি জী.ই.সি মোড় থেকে ওই বাসে উঠলাম, শুরু হোলো স্বর্গলোকের পথযাত্রা।
প্রথম দিন (৯ই সেপ্টে.- ১৪)
বাস এ উঠেই আব্দুলের সাথে দেখা। ২-৪ মিনিট কথা বলতেই দেখি ও ঘুম। আমিও ঘুম দিলাম। বাস কন্ডাক্টার এর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বাস থেকে নেমে দেখি সকাল ৭.৩০টা বাজে। রিক্সা নিয়ে রওনা দিলাম থানচি,রুমা বাসস্ট্যান্ডের পথে। বেশ সুন্দর সকাল। তবে শুরুতেই বিপত্তি। আমি যে জুতা পরেছি, ৫ মিনিট হাটতেই দু পায়ের গোড়ায় চামড়া উঠে গেছে। এই জুতা পরে হাঁটা অসম্ভব। আব্দুল আমার হাঁটা দেখেই বলে, জুতা খুল। আমরা ততক্ষণে থানচি বাস স্ট্যান্ড। আলিমকে বলছি মাত্র ৮টা বাজে, ৯ টার দিকে আমরা বাজার থেকে স্যান্ডেল কিনে রওনা দেই। আলিমের কাছে আবার নগদ টাকাও নাই, বাস ধরলে টাকা তুলতে পারবে না। আমার কাছে ছিল ৫৫০০ টাকা। শুনে বলে যথেষ্ট। ওর পিড়াপিড়িতে আমি জুতা খুলে ফেলে দিলাম। আমার কথা শুনার আগেই ও ৮টার বাসের টিকেট কেটে ফেলছে। ৫ মিনিট পরে বাস। টিকেট ফেরত নেয় না, শুধু একটাই কথা, থানচি গিয়ে কম দামে কিনতে পারবেন। কি আর করা, বাধ্য হয়ে খালি পায়ে বাসে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। বাস এ প্রথম আলিমকে প্রশ্ন করলাম আমরা যাচ্ছি কোথায়। বাকলাই ঝর্ণা। পথ জানতে চাইলাম। ও বলল থানচি থেকে ৪ ঘন্টা হাঁটলেই বাকলাই গ্রাম। আজ রাতে ওই গ্রামেই থাকব আমরা। কাল যাব ঝর্ণা দেখতে। বললাম বেশ। ওর কাছেই শুনলাম, ওর গত বারের গাইড এখন খুলনায়, কুয়েটে, ওর রুম এ। ঘুরতে গেছে। বললাম এই বার গাইড কাকে নিচ্ছেস, ঠিক করেছিস আগেই? বাকলাই পর্যন্ত গাইড নেবো না। ব্যাগ থেকে বের করল Google earth থেকে download করা পথের ম্যাপ। সব ঠিক আছে, কিন্তু গাইড লাগবেই- আমার তাৎক্ষণিক উত্তর।
আব্দুলঃ গাইডের চেয়ে আমি ভাল রাস্তা চিনি
আমিঃ তুই যতই ভাল রাস্তা চিন না কেন, গাইড লাগবেই।
আব্দুলঃ কেন?
আমিঃ তুই রাস্তা চিনিস, এটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, তবে আমরা মাত্র ২ জন যাচ্ছি, ২ জনের যে কারো একটা বিপদ, যেমন পায়ে ব্যাথা বা যে কোনো কিছু হলেই একজনের পক্ষে পরিস্থিতি ট্যাকেল দেওয়া প্রায় অসম্ভব।
আমার যুক্তিতে শেষ পর্যন্ত হার শিকার করল আব্দুল।
আব্দুলঃ তবে এই পথে যাব না, এই পথে গাইড ছাড়াই যাব।
আমিঃ তাহলে যাব কোথায়?
আব্দুলঃ চল তাহলে রুমার দিকে যাই, রাখাইন ঝর্ণা যাওয়া হয় নি।
আমি সাথে সাথে রাজি।
ওয়াই জংশন নামে একটা জায়গা আছে যেখান থেকে রুমা আর থানচির পথ আলাদা হয়ে যায়, চিম্বুক পাহাড়ের নিচেই, বান্দরবন থেকে ২৮ কিমি দূরত্ব। সেখানে বাস থেকে নেমে গেলাম আমরা। ছোট্ট একটি বাজার আছে সেখানে। পেয়ারা আর পেপে খেলাম। বাস এর জন্ন্যে অপেক্ষা করছি, এর মাঝে একটা চাঁন্দের গাড়ির ড্রাইভার বলল ভাইরা কি রুমা যাবেন? আমরা বললাম, তা যাব, কিন্তু পুরো গাড়ি ভাড়ি নিতে পারবো না। শেষ পর্যন্ত লোকাল ভাড়া দিয়ে রুমা গেলাম চাঁন্দের গাড়িতে। পথের মাঝেই আব্দুল তার পরিচিত গাইডকে ফোন দিয়ে বাজারে থাকতে বলল।
রুমায় নেমেই প্রথমে আমি স্যান্ডেল কিনলাম। দেখা হোলো আমাদের গাইড শাহ্‌জাহান এর সাথে। ভালই লাগল ছেলেটিকে। ২২ বছর বয়স, হালকা পাতলা গড়ন। আবুলের লিস্ট দেখে বাজার করা হোলো। পিয়াজ, ডাল, মশলা, লবণ, এক প্যাকেট ওরস্যালাইন, ২ প্যাকেট ম্যাগি নুডুলস, ছোট কয়েক প্যাকেট গ্লুকোজ, ব্লেড, শুটকি, টর্চ আর ওডোমস। ওডোমস হোলো মশা প্রতিরোধক ক্রিম। আমি মনে করার পরেও ভুল করে কোনো বিস্কুট, চানাচুর বা শুকনা খাদ্য কেনা হয় নি। পরে এই ভুল এর মাশুল দিতে হয়েছে হাঁড়েহাঁড়ে। রুমা থেকে বের হওয়ার আগে যেতে হোলো আর্মি ক্যাম্প এ। রুমা বা থানচি দিয়ে যে কোন দিকে যেতে হলে বাধ্যতামূলক আর্মি ক্যাম্পে এ গিয়ে অনুমতি নিতে হয়।
দুপুরে খেয়ে যখন হাঁটা আরম্ভ করি, তখন বাজে দুপুর সাড়ে ১২টা। রুমা থেকে বের হতেই প্রথমেই ছোট একটা পাহাড় পাড়ি দিতে হয়। সে পাহাড়ে উঠতেই আমার, আব্দুল এর কাহিল অবস্থা। আধা ঘন্টা উঠার পরে একটা দোকানে পানি খেলাম। আব্দুল ওর ব্যাগ থেকে ক্যাথা বের করে ওই দোকানে রেখে দিল ওজন কমানোর জন্ন্যে।
আবার হাঁটা শুরু করলাম, এবার পাহাড় বেয়ে নেমে আসলাম রুমা খাল এ। দুই পাশে সবুজ পাহাড়, মাঝে বয়ে চলছে খাল। খালের পানি একেবারে স্বচ্ছ। হাঁটু পানি, তবে প্রচুর স্রোত, আর প্রচুর পাথর খালের মাঝে। অসাধারন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। হঠাৎ আমার মজার একটা কথা মনে হোলো। এখানে একটি মানুষ যদি মাসখানেক থাকে, তারপর অজ্ঞাণ করে নিয়ে ভরদুপুরে পুরান ঢাকায় নিয়ে যদি জ্ঞান ফিরিয়ে আনা যায়, সাথেসাথে পাগল হয়ে যাবে। শহুরে মানুষদের এই সৌন্দর্য্য অনুভব করা খুব কঠিন। তারপরও দুইটি ছবি দিচ্ছি যেনো কিছুটা উপলব্ধি করা যায়।
সাড়ে ৩টা পর্যন্ত খালের পাশ দিয়ে হেঁটে আমরা পৌছলাম বগামুখ পাড়া। খালটি মাঝ দিয়ে পাড়ি দিতে হয় বেশ কয়েকবার। শাহজাহান বলল আজ রাত আমাদের এখানেই থাকতে হবে। আমি আর আব্দুল বেশ কিছুক্ষণ জোরাজুরি করলাম যে আমরা আজ আরো ২-৩ ঘন্টা হাঁটতে চাই। শাহজাহান অনেক কষ্টে আমাদের বুঝাতে সার্থক হল যে আজ আর যাওয়া ঠিক হবে না, কারন পরের গ্রাম প্রায় ৫ ঘন্টা দূরে, অন্ধকার হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত আমরা বগামুখ পাড়ায় একটা বাসায় আশ্রয় নিলাম। এটি একটি মারমা গ্রাম। ছোট্ট গ্রাম, সব মিলে ৩০টির মত পরিবার আছে।
বান্দরবনে সাধারণত ৪ জাতির গ্রাম আছে রুমা আর থানচির দিকে। বম, মারমা, মুরং এবং ত্রিপুরা। বম উপজাতি হোলো সবচেয়ে বেশী অতিথি পরায়ন এবং পরিস্কার। এর পরেই মারমা উপজাতি। মুরং এবং ত্রিপুরা উপজাতি মোটেই অতটা অতিথি পরায়ন না।
আমরা আশ্রয় নিলাম কারিগর এর জামাই এর বাসায়। এখানে গ্রামের মোড়লকে বলা হয় কারিগর। বাড়িতে ব্যাগ রেখে আমরা গেলাম খালে গোসল করতে। খালে নামার সময় আমি বুঝতে পারলাম আমার ডান পায়ে টান পড়েছে। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। গত বছর যখন আমি বগালেক আর কেওকাড়াডং ঘুরতে আসছিলাম, তখন নামার সময় এই টান পরেছিল। অনেক কষ্ট হয়েছিল শেষের এক ঘন্টা নামতে। চুপ করে থাকলাম, কাউকে কিছুই জানালাম না। গোসল সেরে ঘরে এসে ঘরের পুরুষের সাথে বেশ অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। বিস্মিত হতে হয় তাদের এত সহজ চিন্তাভাবনা দেখে। উন্নত সমাজ ব্যবস্থার আলো তাদের মাঝে এসে পৌছে নি। আমাদের কি নেই, বিদ্যুৎ, এসি, গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, জীবনকে আরামপদ করার সব কিছু আছে আমাদের কাছে, তারপরও তারা আমাদের চেয়ে হাজার গুন বেশি সুখী। খুব বেশি হিংসা হয় তাদেরকে। জুম চাষ করেই তারা জীবিকা চালান। সৌরবিদ্যুৎ আছে তাদের কিছু বাসায়। শুধু লাইট জ্বলে তা দিয়ে। বাসার মালিকের নামটা ৩-৪ বার শুনেও ঠিক বুঝতে পারলাম না। তবে আর একটু হলেই তার মেয়ের প্রেমে পড়েই গেছলাম, শুধু আমি না, আব্দুলও। বয়স হবে হয়ত ১৫-১৬। তবে এতটাই নিস্পাপ সুন্দর যা আমরা শহরে দেখে অভ্যস্ত না।
সেখানে মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ দিতে পারলেও ক্যামেরারটা পারলাম না। সন্ধ্যার আগে তারা একটি মুরগি ধরে রান্না করল। রাত ৮টার মাঝেই খাওয়া শেষ। আব্দুল তখনি ঘুমাতে চাচ্ছিল। আমি ওকে জোর করে ধরে নিয়ে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। চাঁদের আলোয় মনে সম্পুর্ন অপার্থিব মনে হচ্ছিল সবকিছু। আধাঘন্টাখানেক হেঁটে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। কোনো খাট না, তোষক না, শুধু কাঠের মেঝের উপরে চাঁদর বেছানো। আর আছে একটা বালিশ আর কাথা। পরের দিনের দীর্ঘ যাত্রার কথা মনে করে ডান পায়ের টান পড়ায় কিছুটা অসস্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২য় দিন (১০ই সেপ্টেম্বর-১৪)
ভোর ৫টায় ঘুম ভেঙে গেল। ভোরের আলোয় আর এক নতুন রুপে চিনলাম গ্রামটিকে। ভোর, দুপুর, সন্ধা আর রাত, প্রতি বেলায় যেন ভিন্নরুপ। কিছুক্ষণ ঘরের বাইরে বসে আব্দুলকে টেনে তুললাম। শাহজাহান ততক্ষনে ভাত রান্না শেষ করেছে। মুখ ধুয়েই ভাত মুরগী খেয়েই যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। এর মাঝে বিল নিয়ে আসলেন বাড়ির মালিক। ৩ জনের রাতে থাকা আর রাত এবং ভোরে ভাত মুরগী ডাল সহ মোট বিল মাত্র ১০০৫ টাকা। আগে আমি আরো বেশ কয়েক বার এ রকম গ্রামের বাড়িতে ছিলাম, তাই অবাক হলাম না এত কম টাকা শুনে। টাকা মিটিয়ে রওনা নিলাম ঠিক ৬টায়। আমদের বের হওয়ার কথা ছিল ভোর ৪ টায়, যেন রোদ বেশী ওঠার আগেই প্রথম পাহাড় পাড়ি দিতে পারি। ৫মিনিট পরে খাল পার হয়ে একটু উপরে উঠেই পেলাম বগামুখ উপরের পাড়া। এরপর শুরু হল খাড়া পাহাড় বাওয়া। ১ ঘন্টা উপরে উঠতেই আমার খুব খারাপ অবস্থা। বমি হয়ে গেল সব। আগের দিনই খেয়ে যেতে সাথেসাথে হাঁটার কুফল পেয়েছিলাম। তারপরও দেরি হয়ে যাওয়াতে খেয়ে সাথে সাথে বের হতে হয়েছে। ধীরেধীরে খাড়া পাহাড়টির মাথায় উঠতে লাগল ৪ ঘন্টা। আমাদের সাথে ছিল আধা লিটার এর ২টি বোতল আর ১ লিটার এর একটি বোতল। এগুলোর মাঝে আমরা প্রোয়োজনমত স্যালাইন আর গ্লুকোজ মিশিয়েছি। পাহাড়ের একেবারে উপরে একটা ঝিরি আছে। সেখান থেকে পানি ভরিয়ে নিলাম। ঝিরি হচ্ছে ছোট ঝর্ণা। এর চেয়ে পরিস্কার আর সুস্বাদু পানি শহরে পাওয়া অসম্ভব। পাহাড়ের চূড়ায় একটা ছোট্ট মাচা করা আছে। সেখানে বসলাম কিছুক্ষন। আর নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে না সামনে, তাই শেষ বারের মত বাসায় কথা বললাম। তারপর আবার হাঁটা। এ বারে অবশ্য কছুটা সমতল, অল্প চড়াই উতঁরাই। এর মাঝে দেখা হল রাখসীদ নামের এক পাহাড়ির সাথে, শুনলাম সে রুমা বাজার থেকে হেঁটে আসছে। রুমা থেকে হেটে পুকুরপাড়া যেতে তার সময় লাগে ৩-৪ ঘন্টা। শুনেই মাথা ঘুরে গেল। ৭ ঘন্টা হেটেও আমরা অর্ধেক ও পাড়ি দিতে পারলাম না। আর তাদের লাগে ৩-৪ ঘণ্টা!! সেও আমাদের সাথে গল্প করতেকরতে হাঁটা শুরু করল। প্রচণ্ড রোদ ছিল সেদিন, আর বাতাস নেই বললেই চলে। তাই দরদর করে ঘামছিলাম সবাই। প্রায় ১২ টার দিকে প্রথম একটা খাড়া পাহাড় নামতে হল। এইবার আমি টের পেলাম আমার পা টান খাওয়ার ভয়াভয়তা। নিচু ঢাল যেখানে স্বাভাবিকভাবে আমি দৌড়ে নেমে যাই, তা নামতে হল প্রচণ্ড আস্তে, খুড়িয়েখুড়িয়ে। নামার সময় ডান পা মোটেই বাঁকা করতে পারছিলাম না। পথিমধ্যে একটা চিকন বাঁশ ভেঙে আমাকে আর আব্দুলকে দিয়েছিল শাহজাহান, বাঁশে ভর দিলে হাঁটা অনেক সহজ হয়ে যায়। যখন খাড়া পাহাড় নামতে হল তখন আমার একেবারে বেহাল অবস্থা। যেহেতু আমি ডান পা ভাজ করতে পারছিলাম না বেশি, তাই ডান পায়ের উপর ভর দিতে হচ্ছিল, তাই সমানে পিছলে যাচ্ছিল পা। রাস্তার পাশেই খাঁদ, ব্যালেন্স রাখতে না পারলেই কত নিচে যে পড়তে হবে তার কোন ঠিক নেই, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় ২৫০০ ফুট নিচে পড়তে হবে। রাস্তার ১টি ছবি দেই, কিছুটা বোঝা যাবে।
এমতাবস্থায় পাহাড়ি দাদা পুরো রাস্তা আমাকে হাত ধরে নামায়, আর আমার ব্যাগ নিয়ে নেয় শাহজাহান। ঢাল বেয়ে আবার পৌছাই রুমা খালে, খালের পাশে শুয়ে পড়লাম আমি আর আব্দুল। আমার কাতর আর্তনাদ, আর কত দূর। এই আর একটা পাহাড় পাড়ি দিতে হবে। শুনে আমার মনে হল তক্ষনি মেরে ফেলি ওকে। আর একটা পাহাড়, আদৌ কি সম্ভব আমার পক্ষে ?! ১০ মিনিট পরে আবার রওনা দিলাম। সেই পাহাড় পেতেই আরো এক ঘণ্টা হাটতে হল। এই এক ঘন্টার রাস্তা একেবারেই অন্নরকম। ২ পাশে পাহাড়, আর মাঝ দিয়ে ঝিরি। আলোই আসে না ঠিক ভাবে, অনেক সিনেমায় এমনটা দেখিছি আমরা। আফসোস, আলোর জন্ন্যে ছবি তুলতে পারলাম না। আর কোন শুকনো খাওয়ার ও নাই আমাদের সাথে। পুরো খালি পেটে ক্লান্তির শেষ সীমানায় পৌছে আমরা পৌছলাম কালপাথর এ, যা পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকে নিচে দেখা যায় পুকুরপাড়া। চারিদিকে পাহাড়, মাঝে বিশাল পুকুর। পুকুরের ২ পারে ২টি পাড়া, পুকুড়পাড়া আর প্রাঞ্জং পাড়া। একটি ছবি দিচ্ছি কালপাথর থেকে পুকুরপাড়ার কেমন দেখায় তা দেখানোর জন্ন্যে।
সেখানে শুয়ে বাতাস খেলাম প্রায় ২০ মিনিট। শাহজাহান আগে নেমে গেল, খাওয়ারের ব্যাবস্থা করার জন্ন্যে। কিছু না বলেই রখসীদ দাদা চলে গেল। সে চাইলে দুপুর ১২ টার আগেই পৌছাতে পাড়ত। তখন বাজে বিকাল ৪ টা। আমাকে এত সাহায্য করল কোনো প্রতিদান ছাড়া, অথচ সামান্য ধন্যবাদ জানানোর সুযোগটাও দিল না। মানুষ মানুষের জন্ন্যে- এই কথাটির সাক্ষাৎ প্রমাণ পেলাম। পরে আরো এক ঘন্টা হেঁটে পৌছলাম পুকুড়পাড়ায়।
পুকুড়পাড়ায় পৌছে রুমে ঢুকেই কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ঘুম। ঘুম থেকে উঠলাম একটু পরে শাহজাহানের এর ডাকে। ভাত খেলাম আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে। তারপর খেলাম জাম্বুরার মত দেখতে একটা ফল, তবে স্বাদ শশার মতন। খেয়ে বের হয়ে বাইরে আসলাম। দেখি অজস্র কুকুর, মুরগী আর শুঁয়োর। এটি একটি ত্রিপুরা গ্রাম, বেশ বড়। তবে কোনো দোকান নেই গ্রামে। রুমা বাজার থেকেই তারা বাজার করে থাকে। পুকুড়পাড়া পড়েছে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলায়। জেনে খুব অবাক লাগছিল যে বান্দরবন থেকে হেঁটে রাঙ্গামাটি হেঁটে চলে আসছি। এরপর রিপোর্ট করতে গেলাম পাশেই আর্মি ক্যাম্পে। যদিও আমাদের সেদিনই যাওয়ার কথা ছিল রাখাইন ঝর্ণা দেখতে, মাত্র ১ ঘন্টা হাঁটা পথ, তারপরও যেতে পারি নি, কারন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল আর আমাদের একবিন্দু পরিমাণ শক্তি ছিল না। আর্মি ক্যাম্পের প্রধান আমাদের সাথে কিছুক্ষন গল্প করলেন। আমাদের সাথে কোনো পরিচয়পত্র না থাকায় কিছুক্ষন পেঁচালো। তারপরে উপদেশ দিলেন যেন এরপর থেকে আসলে অবশ্যই পরিচয়পত্র নিয়ে আসি।
ক্যাম্প এ একটা ছোটখাট ক্যান্টিন আছে। ওখান থেকে ৪ প্যাকেট বিস্কুট কিনলাম। তারপর রুম এ গেলাম। এই গ্রামে এতটাই উন্নত যে এখানে টয়লেট আছে! আশপাশের অন্ন্যান্য গ্রামে টয়লেটের কথা চিন্তা করাই ভুল। আব্দুল আগেই বলেছিল পুকুরপাড়া এ সব গ্রামের তুলনায় রাজধানী। বিনা বাক্যে কথাটা মেনে নিলাম।
সে রাতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল শুধু কামেরা আর মোবাইল চার্জ করা নিয়ে। যেহেতু সৌরবিদ্যুৎ ছিল সেখানে, তাই বাড়ির মহিলাকে বললাম একটু কামেরা আর মোবাইল চার্জ দিতে চাই। কথা শুনে চমকে উঠলেন তিনি। সাথেসাথে বললেন আমাকে হাজার টাকা দিলেও দেব না। কেন প্রশ্ন করতে তিনি জানালেন মাসখানেক আগে তাদের গেস্টহাউজে আমাদের মত অতিথি এসেছিল। তারা চার্জ দেওয়ার সময় একটা সোলার প্যানেল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি আর রিস্ক নেবেন না। এই পরিবারটি ছিল বাঙালি। সুজন মাস্টার নামের এক লোকের বাড়ী। সুজন মাস্টার কিন্তু একটি NGO তে চাকরি করেন, কোনো কালেই তিনি শিক্ষকতা করান নি। তাদের পরিবারের সব ছেলে মেয়ে শহরে থেকে পড়াশুনা করে। ভাবলাম আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে অনুরোধ করি। তাদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ আছে, সম্ভবত তাদের জেনারেটর আছে। গিয়ে অনুরোধ করলাম একজন সৈনিকের কাছে। সে তার ঊর্ধতন কর্মকর্তার কাছে গেল আমাদের অনুরোধ নিয়ে। ইছুক্ষন পরে ফিরে এসে বলল, দুঃখিত আমদের স্যার অনুমতি দিচ্ছেন না। বললাম ১০টি মিনিটের জন্ন্যে দেন। তাও ফিরিয়ে দিল। আসলেই ক্যামেরা চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। খুব খারাপ লাগছিল, এত কষ্ট করে এত দূরে এসে ছবি তুলতে পারব না ভেবে। আর কথা না বাড়িয়ে ফিরে খেয়ে ঘুম দিলাম।
তৃতীয় দিন (১১ই সেপ্টেম্বর -১৪)
ভোরে ঘুম ভাঙল ৬টার দিকে। তারাতারি উঠে আব্দুলকে তুললাম ঘুম থেকে। মুখ হাত ধুয়েই বেরিয়ে পরলাম কাঙ্খিত রাখাইন ঝর্ণা দেখার জন্ন্যে। মনের মাঝে কিছুটা শংকা, এত কষ্ট করা যে ঝর্ণা দেখার জন্ন্যে, তা কি আসলেই এতটা সুন্দর? যাত্রা শুরু করে বুঝতে পারলাম পুকুরপাড়া বেশ খানিকটা উপরে, ১৫০-২০০ ফুট হতে পারে। পুকুরটি এতই বড় যে পুকুড়ের অপর পাড়ে যে প্রাঞ্জং পাড়া আসে, সেখানে পৌছতেই লেগে গেল প্রায় ২৫ মিনিট। তেমন কোনো বড় পাহাড় পড়ল না পথে। ঝর্ণা পর্যন্ত পৌছতে সময় লাগল ১ ঘণ্টার চেয়ে একটু বেশি। এটি আসলে ঠিক ঝর্ণা না, অনেক গুলো ছোট ছোট ধাপে নেমে আসছে স্বচ্ছ পানির তীব্র স্রোত। অনেক পোস্টার, সিনেমায় এমন দ্রশ্য দেখেছি। তবে নিজের চোখে যা দেখলাম তা এ সবের চেয়ে হাজার কোটি গুনে সুন্দর, কোণো ভাবেই এই সৌন্দর্য নিজের চোখে না দেখলে বোঝানো অসম্ভব।ভয়াবহ পিচ্ছিল পানির নিচের পাথর। অনেক সাবধানে খালটি পার হয়ে অপর পাশে গিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব। ভয়ংকর সুন্দর কথাটির এর চেয়ে বাস্তবসম্মত উদাহরণ এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি খুব একটা দেখি নি। হথাৎ মনে হল আমার পশ্চদেশে কিছু একটা কামড় দিয়েছে। প্রথমে গ্রাজ্য না করলেই একটু পরে হাত দিয়ে অনুভব করলাম পিচ্ছিল কিছু একটা। প্যান্টটা কিছুটা নামিয়ে আব্দুলকে বললাম দেখ মনে হ্য় জোঁক ধরেছে। ওতো হাসতেহাসতে গড়াগড়ি। বলে আমি এত বার বান্দরবনে আসছি, কখনও এখানে জোঁক ধরে নি, কোনোজনের এখানে ধরতে দেখি নি, শুনিও ও নি। শেষমেষ জোঁকটিকে লবণ দিয়ে সরানো হোলো। বেশ কিছুটা দুর গেলাম হেঁটেহেঁটে। খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছিল, এতটাই পিচ্ছিল। ক্যামেরার অভাব বোধ করছিলাম প্রচণ্ড ভাবে। সাথে ছিল, তবে একটা ছবি তুলতেই চার্জ শেষ। বাধ্য হয়ে মোবাইল দিয়ে ছবি তুললাম। বিস্কুট খেলাম সেখানে। প্রায় দেড় ঘন্টা ছিলাম রাখাইন ঝর্ণার পারে। বাধ্য হয়ে ফেরার পথ ধরলাম; সময় নাই, তাই। ফেরার আগে দু চোখ ভরে শেষ বারের মত দেখে নিলাম সৃষ্টিকর্তার অনাবিল সৃষ্টি। তিনটি ছবি দিচ্ছি কিঞ্চিত ধারনা করার জন্ন্যে।
ফেরার পথে পুকুরপাড়ার পুকুরের চারিদিকের পাহাড়ে দেখি মেঘে ছেয়ে আছে। প্রতিটি পদক্ষেপ যতটা কষ্টের, ঠিক ততটাই মনোমুগ্ধকর। যেন কষ্টের বিনিময়ে পুরস্কার রুপে পাওয়া যাচ্ছে এই সৌন্দর্য্যের দর্শন।
পুকুরে অনেক ইচ্ছা থাকার পরেও ডুব দিতে পারলাম না, কারন ভিজলে আমার প্যান্ট অনেক ভারি হয়ে যাবে, যা পরে হাঁটা বা ব্যাগে বহন করা দুটোই সমান কষ্টকর। পাড়ায় ফিরে কিছুক্ষন পরে ভাত খেলাম। তারপরে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিলাম। খেয়ে দেয়ে সাথেসাথে হাঁটার ভুল আর করলাম না।
বিল নিয়ে আসলেন মহিলা। আমরা ৩ জন রাতে ছিলাম, আর ৩ বেলা ভাত খেয়েছি। তার মাঝে ২ বেলা মুরগী দিয়ে। বিল আসছে ১৪৬৫। বিল মিটিয়ে আবার আর্মি ক্যাম্প এ গিয়ে রিপোর্ট করে ফিরতি পথ ধরলাম। বাজে তখন বেলা ১১টা। আমার পায়ের টানের অবস্থা আরো বেশি খারাপ। ঠিক করলাম ৪-৫ ঘন্টা হাটলে আনন্দ পাড়া অথবা মেন্দ্রিপাড়া পাওয়া যাবে। সেখানে থাকব। চড়া রোদ সে সময়। ৩-৪ ঘন্টা পর পায়ের ব্যাথায় প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। আর জোঁক যেন আমাকে পেয়ে বসছিল। ওদের পায়ে ১ টা ধরলে আমাকে ধরে ৩টা। ঝিরির পাশে এমন একটা স্থানে পৌছলাম যেখান থেকে আনন্দ পাড়া ১ ঘন্টার পথ, তবে আমাদের পথ থেকে ভিন্ন দিকে। সমস্যা হল রাতে ওখানে থাকলে বান্দরবন কাল যাওয়া খুব কঠিন, কারন রুমা থেকে শেষ বাস ৩টায়। আব্দুল অনেক সাহস দিয়ে রাজি করাল বগামুখ পাড়ার দিকে রওনা দিতে। ১ ঘন্টা হাঁটার পরেই দেখি আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছে মেঘে। শাহজাহান তাগাদা দিল জোরে হাঁটার জন্ন্যে। পায়ে ব্যাথা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হাঁটছিলাম। কিছুক্ষনের মাঝে ঝুম বৃষ্টি নামল। রিক্সায় যে নীল পলিথিন থাকে, অমন পলিথিন ছিল আমাদের সাথে। কিন্তু ছিল ২টি। আলিম তার ব্যাগ একটাতে নিল আর একটিতে শাহজাহান ওর আর আমার ব্যাগ নিল। এবার ঝুম বৃষ্টিতে হাঁটা দিলাম। বৃষ্টি পড়ছে একেবারে মাথার উপর থেকে। কোথাও যে দাঁড়াবো, সে উপায় নেই। বাজ পড়ার শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে। আর রাস্তা সেই রকম পিচ্ছিল। ভয়ও লাগছে বেশ ভালই। এর মাঝে দেখি এক দল ছেলে মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে পিঠে ২মন ওজনের বস্তা নিয়ে অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছে!!
আমরা জানি আশেপাশে কোন গ্রাম নেই, তাই জুমঘর খুজতে থাকি। জুমঘর হোলো আসলে গুদাম ঘর। মানুষ থাকে না, শুধু জুমের চাল বা অন্ন্যান্য ফসল জমিয়ে রাখে। ১০ মিনিট হেঁটে একটা জুমঘর পেলাম। তবে কপাল খারাপ। দরজা তালা দেয়া। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর আর একটা জুমঘর পেলাম। দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই প্রথমেই জোঁক ছাড়াতে লাগলাম সবাই। বৃষ্টির মাঝে জোঁক সব বেরিয়ে আসে। ২-৩ টি করে ধরছিল প্রত্যেককে। ঘরে ঢুকে দেখি সেখানে আছে তিন জন। একজন পুরুষ আর দুই জন মহিলা। ঘরটার বেশির ভাগ জুড়েই ছিল ধান। আমি পুরুষটিকে অনুরোধ করলাম যেন আমাদের রাতে ঘরে থাকতে দেন। কিন্তু কোনো ভাবেই সে রাজি হল না। সে ভয় পাচ্ছিল কারন ঘরে তাদের চাল ছিল। আমি তারপরও তাদের বললাম যে আমি তো পাহাড়ে হেঁটে অভ্যস্ত না, এত বৃষ্টিতে হাঁটতে গেলে পড়ে যাব। তাও তারা রাজি হল না। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের তাদের বাড়ি যাওয়ার জন্ন্যে বলল। তাদের বাড়ি আমাদের উল্টো পথে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম বেশ ভয় নিয়ে। একে তো বৃষ্টি, আবার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তবে আর কিছুক্ষন গিয়ে আর একটি জুমঘর পেলাম। অনেক আশা নিয়ে সে ঘরে গিয়ে দেখি ঘরে কেউ নেই, আর দরজাও খোলা। সাথে সাথে আমাদের মনে হল আমরা সাতরাজার ধন পেয়েছি। এমন বৃষ্টিতে প্রায় সন্ধ্যা বেলায় এমন একটি আশ্রয় খুঁজে পাওয়া কোন ভাবেই সাতরাজার ধনের চেয়ে কম নয়। আমরা প্রথমেই ভেজা কাপড় ছেড়ে পুরো শরীরে জোঁক চেক করলাম। আমাকে ধরেছিল মাত্র ৯টা!! আলিম আর শাহজাহানকে ১ বা ২টা। এরপরে শুকনো কাপড় পড়লাম। আমাদের চিন্তা তখন শুধু একটাই, রাতে খাওয়ার আছে শুধু ২ প্যাকেট বিস্কিট!
ঘরটি একটা পাহাড়ের খাদের পাশে। আর পাহাড়ের অন্ন সব বাড়ির মতই মাটি থেকে প্রায় ৪ ফিট উচ্চতায় ঘরের মেঝে। কোন পশুপাখি যেন ঘরে ঢুকতে না পারে, তাই এ ব্যাবস্থা। ঘরটি বেশ বড়, এক পাশে ধানের স্তূপ আছে, আর এক পাশে পাটি বেছানো। হঠাৎ শাহজাহান আবিষ্কার করল ঘরের মাঝে পাতিল আসে। তারমানে দুপুরে এখানে যে থাকে, সে অবশ্যই রান্না করে খায়। ঘরের নিচে নেমে পাওয়া গেল চুলা আর শুকনো বাঁশ। সত্যি আনন্দে নাচলাম কিছুক্ষণ সবাই। বৃষ্টির পানি পাতিলে ধরলাম। ব্যাগ থেকে পেয়াজ আর নুডুলস বের করা হল। আমি পেয়াজ কেটে দিলাম, আর আলিম আর শাহজাহান ২ জন মিলে চুলা ধরিয়ে রান্না করল নুডুলস। রান্না শেষ হতে হতে চারিদিকে আঁধার নেমে আসল। আমরা টর্চ জ্বালিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম। নুডুলসকে মনে হল অমৃত।
খাওয়া শেষে আমরা আড্ডা দিলাম কিছুক্ষন। আমরা পাহাড়ের ধারে একটা জুমঘরে, প্রায় ২ ঘণ্টা পথের মাঝে কোন মানুষ নাই, প্রচণ্ড বাতাস, আর হাল্কা বৃষ্টি। এরচেয়ে রোমহর্ষক রাত আমার জীবনে এখন পর্যন্ত আর কাটাই নি। বৃষ্টি থামল কিছুক্ষন পরে। বেশ কিছুক্ষন পরে বুঝতে পারলাম মেঘ ঘিরে রয়েছে আমাদের ঘর। অপার্থিব কথাটি কোনভাবেই যথেষ্ঠ না সে পরিবেশ বোঝানোর জন্ন্যে। আর সব কিছু বাদ, শুধু এই রাতটিকে পাওয়ার জন্ন্যে যা কষ্ট হয়েছে গত ৩ দিনে, তার দ্বিগুণ করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। আমার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল এমন একটা রাত কাটানো। সৃষ্টিকর্তার কাছে অজস্র ধন্যবাদ আমার স্বপ্ন পুরণ করার জন্ন্যে। আমার মনের চাওয়াটা কয়েকটি চরণে প্রকাশ করার ছোট্ট প্রয়াশ-
শহরতলী ছেড়ে......।
সবুজ পাহাড়ের বুকে...
একটি বার প্রানভরা নিঃশ্বাস...
শহরের বাতাসে ভেসে বেরানো মিথ্যা
অথবা দূষিত কালো ধোঁয়া ......।
বিলীন হতে চাই না আমি নষ্ট শহরের বুকে
শুধু চাই পবিত্র বাতাসই যেন আসে
অন্তিম মুহূর্তে...
তা আজ হোক অথবা অর্ধ শতাব্দী পরে
আমাদের বালিশ ছিল ব্যাগ। তবে ঠান্ডায় বেশ কষ্ট হচ্চিল। ব্যাগ থেকে বের করে আর একটি প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়লাম। তারপরও কাপছিলাম। পরে যে পলিথিনের ভেতরে ব্যাগ ভরে আনছিলাম, তার ভেতরে পা ঢূকালাম, আর আলিম একটা লুঙ্গি নিয়েছিল চাদর হিসেবে। সেখানে ঢুকালাম হাত। এভাবে রাতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছি, জানি না।
চতুর্থ দিন (১২ই শেপ্টেম্ব্র-১৪)
আমাদের ইচ্ছা ছিল ভোরে ঘরের মালিক আসার আগেই বের হয়ে যাব। আমরা বের হওয়ার প্রস্তুতি নিতেই হাজির হল ঘরের মালিক। আমরা বৃষ্টিতে আশ্রয় নিয়েছি দেখে কিছু বলল না। আমাদের কেনা শুটকি দিয়ে দিলাম তাকে উপহার স্বরুপ। ঘর থেকে বের হতেই আর একটা বার মুগ্ধ হলাম চারিদিক দেখে। জুমঘর যে পাহাড়ের ঢালে আছে, সেই ঢালের নিচের খাদ মেঘ দিয়ে ঢাকা ছিল। ২টি ছবি দিচ্ছি আমার সেই স্বপ্নের জুমঘরের।
সাড়ে ৫টার দিকে রওনা দিয়ে সাড়ে আটটায় পৌছলাম বগামুখ পাড়ায়। সেখানে আগে যে বাসায় উঠেছিলাম, সেখানে গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। এর মাঝে নুডুলস রান্না করল শাহজাহান। খেয়ে বিদায় নিয়ে রূমার দিকে রওনা দিলাম সাড়ে ১০টার দিকে। আবার রুমা খাল ধরে যখন রুমায় পৌছালাম, তখন বাজে প্রায় পৌনে ২টা। ৩টায় বাসের টিকেট কেটে আমি বসলাম। শাহজাহান অনেক কষ্টে আলিমকে রাজি করিয়ে নিয়ে গেল আর্মি ক্যাম্প এ ফেরার রিপোর্ট করার জন্ন্যে। আমার আর হাঁটার মত অবস্থা ছিল না। পা ব্যাথায় ছিড়ে পড়ছিল। নিজের কাছেই অবাক লাগছিল পায়ের এই অবস্থা নিয়ে কিভাবে ৪ দিন ছিলাম। ৩টায় চাঁদের গাড়ি করে রওনা দিলাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। তার আগে বিদায় নিলাম শাহজাহানের কাছে। প্রচণ্ড সাহায্য করেছে ছেলেটি। কথা দিলাম, পরের বার আসলে অবশ্যই তাকে নিয়েই যাব।
বাসে উঠে বান্দরবনে পৌছলাম সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। আব্দুল রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। আমি সে রাতে হোটেল এ থেকে পরের দিন সকালে আসলাম চট্টগ্রামে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু আর ছিল না।
যদি সুস্থ থাকি, তাহলে অবশ্যই আবার আসব, এবারের গন্তব্য হবে অমিয়খুম। অনেকেই আছেন যারা সুযোগ পেলেই যান দেশের বাহিরে, ঘুরতে। তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই, মাথা গরম হয় তখন যখন তারা বলেন আমাদের দেশে দেখার কিছু নেই। ieরবীন্দ্রনাথের নীচের চরণগুলি এই সব ছাগলের জন্ন্যেই প্রযোজ্য।
বহু দিন ধ'রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
এত কষ্ট করে যাওয়া নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতেই পারে, তবে আমার মনে হয় গাড়িতে চড়েই যদি যাওয়া যেত তাহলে আমরা এত সুন্দর রাখতাম না এই স্থানগুলি। কক্সবাজারের মত নষ্ট করে দিতাম। তাছাড়া আমার দর্শন হোলো কষ্ট করে দর্শন মেলে বলেই তা এতটা সুন্দর, যেমনটা গোলাপ সুন্দর তার কাঁটা আছে বলেই। আপনাদের আমার স্বর্গলোক দর্শনের আমন্ত্রন জানিয়ে বিদায় নিলাম।