টঙ্গীর সাতাইশ এলাকায় একটি এগার বছরের মেয়ে গলায় ফাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এটা আমাদের কমিউনিটি পুলিশের এলাকা আমার বাড়ির পাসেই। তাই খবরটা শুনার পরপরই হাজির হই স্পটে। লোকেলোকরন্য একটি বিল্ডিং। তার দুই তলায় একটি রুমে এই কান্ড। দরজা ভিতর থেকে আটকানো। ফাক দিয়ে উকি ঝুকি মেরে দেখা গেল একটি মেয়ে ঝুলে আছে। পা গুলো দেখা যাচ্ছে। জনমনে নানা প্রশ্ন। কেন এই অল্পবয়সি শিশুটি আত্মহত্যা করল? উল্লেখ্য সেদিন রাতে মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসী দেয়া হয়। কেউ বলছে ফাঁস ফাঁস খেলা করতে গিয়ে এই ফাঁসি।
আমি যাবার কিছুক্ষন পর পুলিশ আসল। শুরু করল জেরা। মেয়েটি তার ভাই এর বাসায় মারা যায় তাই ভাই ভাবিকেই জেরার মুখে পড়তে হল। দরজা ভাংগা হল । সিলিং ফ্যানের সাথে ওরনা পেচিয়ে একটি নিতান্ত অল্প বয়সি বাচ্চা মেযে ঝুলে আছে। বয়স ১১ কি ১২ হবে। দুরে বিছানায় একটি চিরকুট পাওয়া গেল। সুইসা্ইড নোট। পুরটাই যেন সিনেমার সাজানো আত্মহত্যার কোন দৃশ্য। পুলিশ সুইসাইড নোটটি নিয়ে পড়তে লাগল। তাতে খুবই কাঁচা হাতে ভুল বানান আর উচ্চারনে যা লিখা ছিল তা বহুকষ্টে পড়ে যা পাওয়া গেল-
ভাবি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করলে না। অন্যের কথা বিশ্বাস করলে।
প্রাথমিক তদন্তে যা জানা গেল-
প্রাথমিক তদন্ত-
প্রাপ্ত ডকুমেন্টের আলোকে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হয়-
মেয়েটির নাম বলার প্রয়োজন নাই। গ্রাম থেকে তার ভাই তাকে দু মাস হলো এনে রেখেছে। পাসের একটি স্কুলে ৩য় শ্রেনীতে ভর্তি করেছে। যদিও তার বয়সি মেয়েরা ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেনিতে পড়ে। ভাই ভাবি পরেজগার মানুষ। বোনটিকে তাই সে মতে চলতে বলে। ভাইয়ের দুটি ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। তার সন্তানদের সাথে সাথে বোনটিকেও তারা আদর করে আবার শাসনও করে। আর মেয়েটি স্বভাবে খুবই চঞ্চল আর বেজায় রাগি বলে তার ভাই ভাবি পুলিশকে জানায়। বয়স্বন্ধিকালের একটি দোষ। কয়েকদিন আগে তারই স্কুলের একটি ছেলের সাথে মেয়েটির ভাব ভালবাসার সম্পর্ক হয়। শুনা যায় ছেলেটি মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার পায়তারা করছিল। ভাই ভাবি কোন ভাবে তা জানতে পেরে তাকে বুঝায়। এভাবেই চলছিল। ঘটনার দিন রাতে মেয়েটি তার ভাইকে বলে পড়ার চাপ। সে নিচে তার এক সহপাঠির কাছে যেযে পড়বে। পড়েছেও। এরপর রোজগার মত রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়েছে। ভাই ভাবি দুজনই গার্মেন্ট এ চাকুরী করে। তাই সকাল আটটায় তারা চলে যায়। যাবার সময় বোনটিকে বাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে বলে বাড়িওয়ালাকে তা দিতে আর তার জন্য রাখা খাবার সময় মত খেতে। ভাইয়ের বাচ্চারা সকাল ছয়টায় চলে গিয়েছিল মাদ্রাসায়। তাই ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। সকালে বাড়িওয়ালা ভাড়ার টাকা নিতে গিয়ে দেখে দরজা খুলছে না। তখনই ভাইকে খবর দেযা হয়। ভাই এসে দরজার ফাক দিয়ে বোনকে ঝুলন্ত প্রথম আবিষ্কার করে। এ ঘটনায় ভালবাসা সংক্রান্ত একটি ধারনা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যা বয়স্বন্ধিকালিন সমস্যা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।
পরবর্তী তদন্ত-
পরবতীর্তে পুলিশ তদন্তে যা পাওয়া যায়-
মেয়েটি খুব চঞ্চল। সে বাড়ীতে একা থাকত। এ সুযোগে পাসের বাসার এক লোক যার গ্রামরে বাড়িতে যার স্ত্রী সন্তান আছে সে মেয়েটিকে একা পেয়ে ইভটিজিং করত। মেয়েটি তা তার ভাবিকে বলে। ভাবি তার ভাইকে জানায়। এরপর দুজনে মিলে বাড়িওয়ালাকে অবহিত করে। বাড়িওয়ালা সেই লোকটির সাথে কথা বলে । লোক সম্পূর্ন বিষয়টি অস্বিকার করে বোনটিকেই এর জন্য দায়ি করে। সে বলে বোনটি কারনে অকারনে তার রুমে আসত। একদিন আমি ঘুমের ঘোরে কি বলতে কি বলেছি তাই সে ধরে বসে আছে। এরপর ভাই ভাবি আর বাড়িওয়ালা বিষয়টি নিয়ে আর এগুইনি। ভাইটি বোনটিকেই শাসন করে। তাকে ঘন ঘন যার তার রুমে যেতে নিষেধ করে। এরপর বেশ কদিন চলে গেল।লোকটির সাথে সবাই স্বাভাবিক হযে গেল। হাসি ঠা্ট্টাও চলতে লাগল ভাই ভাবির সাথে। মেয়েটি মনে এই বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। মনে ক্ষোভ পুষে রেখছিল। যার পরিনাতিতে এই ঘটনা। সুইসাইড নোটিটি ভাজ করা ছিল। সেখানে আরো কিছু কথা পরে পুলিশ উদ্ধার করে। তাতে যা লিখা ছিল তা হল-
ভাবি আমার কথা তুমি বিশ্বাস করলে না । অন্যের কথা বিশ্বাস করলে । আমার মৃতুর জন্য ………….দায়ী। ইতি…………..।
ঘটনা এই পর্যন্তই। পুলিশ তার কর্ম করছে। পোষ্টমাটম হয়েছে। পাসের লোকটি কে গ্রেফতার করা হয়েছে………..আইন তার নিজস্ব গতিতে এগুচ্ছে।
প্রশ্ন নং ১
একটি গ্রামের মেয়ে শহরে যার বয়স দুই মাস সে কি করে এমন নাটাকিয় ভাবে গলায় ফাস দিল?
প্রশ্ন নং ২
মেয়েটি চঞ্চল । তাই বলে এ ভাবে সুইসাইড নোট লিখে ১১/১২ বছরের একটি শিশুর আত্মহত্যা অস্বাভাবিক নয় কি?
প্রশ্ন নং-৩
মেয়েটি ভাবির নাম উল্লেখ করল ভাইয়ের নয় কেন?
প্রশ্ন নং- ৪
খাট থেকে সিলিংফ্যোন অনেক দুরে। মেয়েটি উঠেছে একটি চেয়ার দিয়ে তার উপর তেলের টিনে পা দিয়ে । তার পর ঐ উচুতে ওরানা পেচানা। প্রতিটি কাজ খুব সুক্ষ্। কথা হল এই বয়সের একটি মেয়েকি এত সব করতে পারে?
প্রশ্ন নং – ৫
বয়স্বন্ধিকালে মেয়েদের ভাব ভালবাসা জাতিয় এসব সমস্যা হলে তাদের কি শাষন করা যাবে না?
প্রশ্ন নং ৬
সিনেমা নাটকে আজকাল আত্মহত্যার দৃশ্য হরহামেশা দেখানো হয়। এসব দেখে শিশুরা কি প্রভাবিত হচ্ছে না?
প্রশ্ন নং-৭
পরবর্তী তদন্তে জানা গেল পাসের এক লোক এর জন্য দায়ি। বায়োস্বন্ধীকালিন ভাব ভালবাসা নয়। প্রাথমিক তদন্তে ভাই বা ভাবি কেউই সেই লোকের নাম বলেনি কেন?
প্রশ্ন হাজারটা করা যায়। কিন্তু উত্তর নিজেদেরই বের করে নিতে হবে। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। সচেতন হতে হবে প্রতিটি বাবা মাকে। সন্তানের মন বুঝতে হবে। সে মতে আচরন করতে হবে। তাদের কথার সত্যতা যাচাই করতে হবে। হালকা করে দেখলে হবে না। মনে রাখতে হবে আপনার একটি ভুল সিদ্ধান্তের মাশুল হতে পারে ভায়বহ। স্রষ্টা দয়াময় সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুন। সবাইকে হেফাজত করুন।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:০০