প্রয়াত ড. আকবর আলি খান (১৯৪৪ - ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২) তার 'পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে একটা প্রবন্ধের নাম দিয়েছিলেন 'শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি'। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি সরকারি আমলা, অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ। ২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। তাই তার পক্ষে প্রবন্ধের এমন অকুতোভয় নাম দেওয়াটা শোভন ।
আমি অর্থনীতিবিদ নই, সরকারী কোন আমলাও না । আমি এদেশের আম জনতাদের একজন । আমি রাজনীতি আর কম্পিউটার বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি । আমি যদি ড. আকবর আলী খানের মতো এমন বিদগ্ধ প্রবন্ধ লিখতে চাই তাহলে তার নাম কি দেওয়া যেতে পারে? 'শুয়োরের বাচ্চাদের রাজনীতি' নাকি 'শুয়োরের বাচ্চাদের আইটি নীতি' ?
যাই লিখি না কেন তাতে ঘুরে ফিরে ওই অসৎ আর দুর্নীতিবাজদের আদ্যপান্তই লেখা হবে । চলুন একটা গল্প শুনি তাহলে। বৃটিশ আমলে আসানসোল মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটকে এক পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলেছিল ‘হুজুর এদেশে তিন ধরনের মানুষ আছে।
১.যারা ঘুষ খায় না।
২.যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে।
৩. কিছু শুয়োরের বাচ্চা আছে, যারা ঘুষ খায় কিন্তু কাজ করে দেয় না।
ড. আকবর আলী খান তার আলোচ্য প্রবন্ধে সেই সব ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যারা ঘুষ খায় কিন্তু কাজ করেনা । তার 'শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি' তত্ত্বের উৎপত্তি মূলত উপরিউক্ত গল্প থেকেই।
সেকালের গল্প শোনা হল, চলুন এবার একালের একটা গল্প শোনা যাক । এক ভদ্রলোক তার উপর করা এক প্রভাবশালীর মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচতে ব্যাংক থেকে লোন তুলে তদন্ত কর্মকর্তাকে উৎকোচ বাবদ কিছু টাকা দিলেন এবং বাকি টাকা চার্জশীট দেওয়ার পর দিবেন বলে ওয়াদা করলেন। কিন্তু চার্জশীটে দেখা গেলো ভদ্রলোককে রেহাই দেওয়াতো হয়ইনি বরং অক্টোপাসের মতো আইনের ধারাগুলি উনার আপাদমস্তক জড়িয়ে গেছে। ভদ্রলোক মনে মনে নয় বেশ জোরেশোরেই বললেন "এ্য তো দেখি শুয়রকা বাচ্চা নিকলা "। তদন্ত কর্মকর্তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে কপালে যা আছে তাই হবে ভেবে তিনি ভারাক্রান্ত মন আর ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
একটু পরে আসল ক্লাইম্যাক্স শুরু হল । ভদ্রলোক শুয়ে আছেন, হঠাৎ সেই তদন্ত কর্মকর্তার কল আসলো, তিনি ভদ্রলোকের কাছে মাফ চেয়ে যা বললেন তার সারমর্ম হলো, থানার বড়বাবু (শুয়রের বাচ্চা) বাদীর কাছ থেকে বিবাদীর উপর এজহারে বর্ণিত অভিযোগ আর ধারাগুলি চার্জশীটে বহাল রাখার শর্তে বড় অংকের উৎকোচ গ্রহণ করায় বিবাদীর দেওয়া অল্প কয়টা টাকা ধোপে টিকেনি এবং ইত্যাদি ইত্যাদি । অতঃপর এখন সেই টাকাগুলো তিনি বাদিকে ফেরত দিতে চান।
এটাও সম্ভব? আশ্চর্য! ভদ্রলোক হাতে টাকা পেয়ে যারপরনাই খুশি, তিনিতো অবাক যে বাংলাদেশে এমনও "সৎ" পুলিশ অফিসার আছে! যে কিনা ঘুষ নিয়ে কাজ করে দিতে না পারায় তা আবার ফেরত দেয়? আসলেই আমাদের দেশে এখনো "সৎ" পুলিশ আছে। সব তো আর "শুয়োরের বাচ্চা" না । যাইহোক, নিজের ভবিষ্যত জেলে কাটাবার দুশ্চিন্তা ভুলে ভদ্রলোক আপাতত টাকা ফেরত পাওয়ার আনন্দে বেশ আনন্দিত এবং পুলিশের "সততায়" বিস্মিত।
উপরিউক্ত গল্পদ্বয় সামহয়ার ইন ব্লগের ব্লগার 'প্রফেসর সাহেবের' পোস্ট থেকে ঝেড়েছি । এবার আসুন 'শুয়োরের বাচ্চাদের রাজনীতি' প্রসঙ্গে। 'শুয়োরের বাচ্চাদের রাজনীতি' প্রবন্ধে শুয়োরের বাচ্চাদের রাজনীতির ধরণ বা প্রভাব হতো নিম্নরূপ বিভিন্ন রকমের । যেমন-
০১. ভিন্ন মত বলে কিছু নেই, আমার দলের নীতিই একমাত্র আদর্শ ।
০২. অন্যের আবার অধিকার কি? নিজের পকেট আগে ভরো ।
০৩. দল ক্ষমতায়, আমরা সরকারি লোক ।
০৪. যার জোর তার মুল্লুক ।
০৫. বিচার মানি কিন্তু তাল গাছ আমার ।
০৬. পদ পদবী আছে যার তার তরে নমস্কার ।
০৭. খেয়েছে যে একবার তার জন্য রাঁধো আবার।
০৮. আই এম জিপিএ ফাইভ, আমার বাপের ট্যাকার পাহাড় ।
০৯. যোগ্যতার খ্যাতা পুড়ি, আসুন সবে তেল মারি ।
১০. ক্ষমতায় থাকবো সদাই পাবলিক হোল মহা-ভোদাই ।
এই দশ ধরণের বাইরে আরও হাজারটা ধরণ বা প্রভাব দাঁড় করানো যাবে । দুর্নীতি যার একমাত্র মূলনীতি । রাষ্ট্র যন্ত্র ব্যবহার করে বাক স্বাধীনতা হরণ করা, দুর্নীতি । অন্যের অধিকার কেড়ে নিয়ে নিজের পকেট পুরো করা, দুর্নীতি । দলীয় প্রভাব খাটানো, দুর্নীতি । ম্যান্ডেট থাকুক বা না থাকুক যেন তেন ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা, দুর্নীতি । টাকা দিয়ে, তেল মেরে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি হাসিল করা দুর্নীতি । দুর্নীতি আর দুর্নীতি। পরতে পরতে দুর্নীতি।
শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে ড. আকবর আলী খান একস্থানে বলেছেন, '‘...তবু দুর্নীতি নির্মূল করা সহজ হবে না। শুয়োরের বাচ্চারা এক দিনে জন্ম নেয় না, কাজেই রাতারাতি তারা উধাও হবে না। দীর্ঘস্থায়ী এ প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে সরকারের আয়তন হ্রাস। জনগণেরও ভালো করে বুঝতে হবে যে বর্তমান কাঠামোতে সরকার জনগণের ভালো করতে গেলে তাদের উপকার হবে না, হবে অনিষ্ট।’
‘উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে: “হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়োরের বাচ্চাদের সামলান।”
বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২১ সালের 'দুর্নীতির ধারণা সূচকে' বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছিলো । অর্থাৎ আগের বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও পরের বছর হয়েছে ১৩তম। টিআই এর দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে ২০২১ বছরের তুলনায় বাংলাদেশের এক ধাপ অবনমন হয়ে পুনরায় ১২ তম হয়েছে । অর্থাৎ অবস্থা যে লাউ সেই কদুই আছে ।
একদিন আমরাও দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, সোমালিয়া বা ভেনেজুয়েলাকে তালিকার শীর্ষ থেকে টেনে হিঁচড়ে বাংলাদেশের নিচে ফেলে দেবো, এমন দুরাশা করি না । যদি এমন হয় তাহলে সেদিন আর এমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে কিনা প্রবন্ধ লিখবে আর তার শিরোনাম হবে 'শুয়োরের বাচ্চাদের রাজনীতি' ।
ফুটনোটঃসামহয়ার ইন ব্লগ
ছবি - দৈনিক সমকাল
রুদ্র আতিক, সিরাজগঞ্জ
০৬ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ৯:৫২