জামায়াতেরও মত প্রকাশের অধিকার থাকা উচিত : তসলিমা
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে দেশে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় বইছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে এবং ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দিয়ে এই মৌলবাদী জামায়াতিরাই ১৬ বছর আগে বাংলাদেশের নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে দেশান্তরিত হতে বাধ্য করেছিল। কালের কণ্ঠের এই প্রতিনিধির সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে মানবতাবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিন বলেন, মাওলানা নিজামীকে যদি নবীজির সঙ্গে জামায়াতিরা তুলনা করে থাকে তাহলে ক্ষতি কী হয়েছে? জামায়াতেরও তো আর সবার মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে পারে! তবে তিনি এও মনে করেন নিজামী-মুজাহিদদের মতো ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করে কোনো লাভ হবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ৭২-এর সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশে ধর্মীয় আসঙ্গমুক্ত সৎ ও উদার রাজনীতির সংস্কৃতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গত রবিবার অনলাইনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তসলিমা নাসরিন বলেন, 'মৌলবাদী জামায়াতিরা তাদের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে যদি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সঙ্গে তুলনা করে থাকে, তাহলে আমি বলব যে, এটা তাদের স্বাধীন মত প্রকাশেরই বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বের প্রতিটি মানুষেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আমি আমার লেখার মাধ্যমে সবসময় নারীর স্বাধীনতার কথা বলেছি, মানুষের সমঅধিকারের কথা বলেছি, ধনী-দরিদ্রের বিভেদ ঘুচিয়ে সমতার কথা বলেছি, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলেছি।' তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, 'তখন আমার কী অপরাধ ছিল? একের পর এক সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে নেওয়া অনৈতিক সিদ্ধান্ত বা জামায়াতিদের ফতোয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই অনৈতিকতার জন্য তিনি জামায়াত, বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমানভাবে দায়ী করেন। নিজামী বা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা বা ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করেও কোনো লাভ হবে না বলে তসলিমা মনে করেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কারো বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিকাশ কখনোই হয় না, যদি কারোর মত প্রকাশের স্বাধীন অধিকার না থাকে। এজন্য তিনি দেশের সচেতন সমাজকে আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভঅবে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে। তবে সেই অধিকার আদায় করতে গিয়ে কারোর মাথার মূল্য যেন কেউ ধার্য করতে না পারে বা কাউকে যেন সে জন্য দেশান্তরিত হতে না হয়।
কিছুদিন আগে তসলিমা নাসরিনের একটি লেখাকে কেন্দ্র করে ভারতের দুজন মানুষ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ প্রসঙ্গে নাসরিন বলেন, যে পত্রিকাটি তাঁর লেখা প্রকাশ করেছিল, তারা তাঁর অনুমতি না নিয়েই লেখাটা পুনর্মুদ্রণ করেছিল। লেখাটা সাম্প্রতিক নয়, চার বছর আগের এক লেখা। এই ব্যাপারে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না বলে তসলিমা নাসরিন কালের কণ্ঠকে জানান।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি সরকারকে সাধুবাদ দিয়ে বলেন, এত বছর পর হলেও এই সরকার যে বিচার প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সেটা এক বিরাট শুভসূচনা। তবে সেই সঙ্গে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার পক্ষেও মত দেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর কিছু বলতে অনুরোধ করলে তিনি বলেন, দেশের ধনী এবং গরিব শ্রেণীর অসমতা ঘোচাতে না পারলে এবং নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে এই জাতির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অঙ্কুরেই ঝরে যেতে বাধ্য। '৭২-এর সংবিধানের আলোকে জাতিকে অবশ্যই স্যেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং তাতে বিলম্ব করার কোনো উপায় নেই। তসলিমা বলেন, এ সবই ভেস্তে যাবে যদি না ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হয়। সৎ রাজনীতিবিদের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, তাঁদের শুধু জনগণের কথাই ভাবতে হবে, নিজেদের কথা নয়। অপরাধীকে শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ড দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। জাতির কাছ থেকে ভালো কিছু পেতে হলে, সরকারকেও ভালো কাজ করতে হবে। মসজিদ-মাদ্রাসাকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিমুক্ত করতে হবে এবং মাদ্রাসার বদলে বিজ্ঞানভিত্তিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে সমঅধিকারের শিক্ষা দিতে হবে।
এখন কোথায় অবস্থান করছেন জানতে চাইলে তিনি নিজেকে যাযাবর আখ্যায়িত করে বলেন, যাযাবরের কি নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থাকে অবস্থানের?
বিঃদ্রঃ কপি পেস্ট পোস্ট