৮ ফেব্রুয়ারি (রেডিও তেহরান) : জুলুম ও শোষণ চিরস্থায়ী হয় না। ঐতিহাসিক এ মহাসত্য সাম্রাজ্যবাদী প্রধান পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও প্রযোজ্য। এক সময়কার বৃহত্তম উপনিবেশবাদী শক্তি ব্রিটেন আজ পাশ্চাত্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছেই তেমন কোনো বড় বা নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে গুরুত্ব পায় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পতনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় অতিক্রম করে চূড়ান্ত পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর বিশ্বের মুক্তিকামী জাতিগুলোর জন্য এটা এক বড় সুসংবাদ। এমনকি মার্কিন নাগরিকদেরও অনেকেই এ ব্যাপারে উল্লসিত ও গভীর আশাবাদী যে ইতিহাসের অন্যতম প্রধান জালেম শক্তির পতন ঘনিয়ে আসছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনও সংকটমুক্ত ছিল না। যদিও অনেকে মনে করেন যে দুইশ বছরেরও আগে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র এক সময় প্রগতিশীল বা অগ্রগামী রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হত। বর্তমানে দেশটির নানা ভিত্তিতে ধরেছে মারাত্মক পচন। গোটা মার্কিন জাতি এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। এক যুগ আগেও মার্কিন সরকারের যে প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল তা এখন বহুলাংশে কমে গেছে। মার্কিন নাগরিকদের অনেকেই মনে করেন দেশটির অবস্থা এখন চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীর মত। এ পর্যায়ে রোগীর শরীরের প্রায় সব অংশেই ছড়িয়ে পড়ে ক্যান্সার।
আসলে শত শত বা হাজার হাজার দিক থেকে ক্ষয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিদিনই দেশটির আরও বেশি খারাপ অবস্থার বা দুর্দশার খবর আসছে। এই বিশেষ আলোচনায় আমরা মূলত দেশটির অর্থনৈতিক ধসের চিত্রই তুলে ধরব। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক অবক্ষয়েরও অনেক চিত্র তুলে ধরা যায়।
যেমন, মার্কিন নাগরিকদের এবং বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের এক বিশাল অংশই আত্ম-গর্বিত, স্বার্থান্ধ, অর্থ-লোলুপ, উদ্ধত, অকৃতজ্ঞ, প্রতারক ও শতভাগ ভোগবাদী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব দিক থেকেই পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। কিন্তু বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিকই ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত রয়েছেন বলে তারা এই বাস্তবতাটি বুঝতে পারছেন না। বরং তারা মনে করেন মার্কিনী বলেই অশেষ সমৃদ্ধির ধারা তাদের জন্য চিরকাল বজায় থাকবে।
মার্কিন অর্থ-ব্যবস্থার ধস খুবই স্পষ্ট। দেশটির বেদনার দিনগুলো অত্যাসন্ন। খুব বেশি দেরি না হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগ মার্কিনীই হয়ত তা বুঝবেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতনের ৩৪ টি আভাস বা আলামত এখানে আমরা একে একে তুলে ধরছি:
১. বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন জিডিপি বা গড় অভ্যন্তরীণ উতপাদনের অবদান ছিল শতকরা ৩১ দশমিক ৮ ভাগ। আর ২০১১ সালে এই হার নেমে এসেছে ২১ দশমিক ৬ ভাগে।
২. ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৮ সালেও আমেরিকা ছিল মানব-শিশু জন্ম নেয়ার জন্য বিশ্বের সেরা স্থান। কিন্তু এখন এক্ষেত্রে আমেরিকার স্থান বিশ্বে ১৬তম।
৩. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দিক থেকে একটানা চার বছর ধরে মার্কিন অবস্থান নীচে নামছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম এই র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করে আসছে।
৪.ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্য অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ৪০টি পাবলিক ট্রেড কোম্পানির অর্থের যোগানদাতাদের অর্ধেকই সেগুলোর মূল খরচের বরাদ্দ আগামী মাসগুলোতে কমিয়ে আনার চিন্তাভাবনা করছেন।
৫. ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে সংখ্যক নতুন বাড়ী বিক্রি হয়েছে তার চেয়েও তিন গুণ বেশি বাড়ী বিক্রি হয়েছে ২০০৫ সালে।
৬. যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-শহরগুলোর সংখ্যা ছিল বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বর্তমানে এইসব শহরের বেশিরভাগই দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ডেট্রয়েট শহরের কথা বলা যায়। একজন মার্কিন এমপি ডেট্রয়েট শহর গুটিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
৭. ২০০৭ সালে বিশ থেকে ২৯ বছর বয়সী মার্কিনীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৫। বর্তমানে এই শ্রেণীর মার্কিনীদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৩ শতাংশ।
৮. ১৯৫০'র দশকে মার্কিন পুরুষদের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি মানুষ ছিল চাকরিজীবী। বর্তমানে মার্কিন পুরুষদের শতকরা ৬৫ শতাংশেরও কম চাকরির অধিকারী।
৯. প্রায় প্রতি চার জন মার্কিন শ্রমিকের একজন ঘণ্টায় দশ ডলার বা তারও কম মজুরি পাচ্ছেন।
১০. গত মন্দার সময় মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের বেতন ছিল মধ্যম পর্যায়ের। এরপর থেকে আমেরিকায় যেসব চাকরি সৃষ্টি হয়েছে তার শতকরা ৫৮ ভাগই নিম্ন বেতনের চাকরি।
১১. মার্কিন পরিবারগুলোর বার্ষিক আয় গত চার বছর ধরে কমেই আসছে। এই কয় বছরে তাদের আয় ৪ হাজার ডলারের চেয়েও বেশি কমেছে।
১২. চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ২৮ গুণ বেড়েছে।
১৩. ২০০১ সালের পর থেকে আমেরিকার ৫৬ হাজারেরও বেশি কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১০ সালে প্রতিদিন গড়ে ২৩ টি মার্কিন কারখানা বন্ধ হয়েছে। তাই এইসব অবকাঠামোগত ধসের পরও এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই যে মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা ক্রমেই ভাল হয়ে উঠছে।
১৪. আমেরিকায় ২০০৫ সালের প্রথমদিকে পেট্রোল বা জ্বালানী তেলের দাম ছিল গ্যালন-প্রতি ২ ডলার। ২০১২ সালে এর দাম তিন দশমিক ৬৩ ডলার।
১৫. ১৯৯৯ সালেও শতকরা ৬৪ দশমিক এক ভাগ আমেরিকান চাকরি-ভিত্তিক স্বাস্থ্য-বীমার আওতাভুক্ত ছিল। বর্তমানে ৫৫ দশমিক এক ভাগ আমেরিকান এই সুযোগ পাচ্ছে।
১৬. মার্কিন পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালে আমেরিকার ৬১ ভাগ নাগরিকই ছিল মধ্যবিত্ত বা মধ্য-আয়ের অধিকারী। বর্তমানে শতকরা ৫১ ভাগ আমেরিকান মধ্যম আয়ের অধিকারী।
১৭. বর্তমানে আমেরিকার দুই কোটি বিশ লাখ নাগরিক তাদের আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ব্যয় করেন আবাসন খাতে। ২০০১ সাল থেকে এই খাতে তাদের ব্যয় বেড়েছে শতকরা ৪৬ ভাগ।
১৮. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদম-শুমারি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশটির শতকরা প্রায় ২২ ভাগ শিশু দরিদ্র।
১৯. ১৯৮৩ সালে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে উপার্জনকারী ব্যক্তিরা প্রতি এক ডলার আয় করতেন ৬২ সেন্ট ঋণের বিপরীতে, ২০০৭ সালে প্রতি ডলারের বিপরীতে তাদের ঋণের পরিমাণ এক দশমিক ৪৮ ডলার।
২০. মার্কিন নাগরিকদের গৃহ বাবদ বন্ধকি ঋণের মোট পরিমাণ এখন বিশ বছর আগের তুলনায় ৫ গুণ বেশি।
২১. ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে নেয়া মার্কিনীদের বর্তমান ঋণের মোট পরিমাণ ত্রিশ বছর আগের তুলনায় ৮ গুণ বেশি।
২২. মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক Federal Reserve চালু হওয়ার পর থেকে দেশটির মুদ্রা ডলারের মূল্য ৯৬ গুণ কমেছে।
২৩. ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়স-গ্রুপের মার্কিন নাগরিকদের শতকরা ২৯ ভাগ এখনও তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করেন।
২৪. ১৯৫০ সালে মার্কিন পরিবারগুলোর ৭৮ শতাংশের মধ্যেই (প্রতি পরিবারে) বিবাহিত এক দম্পতি থাকত। কিন্তু বর্তমানে এই বিবাহিত এক দম্পতি রয়েছে এমন পরিবারের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ মাত্র।
২৫. মার্কিন আদম শুমারি সংস্থার হিসেব মতে শতকরা ৪৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিক এক ইউনিট বাড়ীর অধিকারী এবং এই খাতে তাদেরকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সরাসরি আর্থিক সাহায্য নিতে হচ্ছে। অথচ ১৯৮৩ সালে এক তৃতীয়াংশেরও কম মার্কিন নাগরিক এ ধরনের সাহায্য নিত।
২৬.মার্কিন সরকার ১৯৮০ সালে সব আয়ের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ হস্তান্তর-খরচ বাবদ পরিশোধ করত। বর্তমানে এই খাতে ব্যয় ১৮ শতাংশ।
২৭. ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে তিন কোটি ৮০ লাখ আমেরিকান ফুড স্ট্যাম্প বা সস্তা খাদ্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে ৪ কোটি ৭১ লাখ মানুষ এই খয়রাতি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
২৮. বর্তমানে প্রতি চার মার্কিন শিশুর একজনই ফুড স্ট্যাম্প বা সস্তা খাদ্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল।
২৯. এক হিসেব মতে ফুড স্ট্যাম্প বা সস্তা খাদ্য কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল মার্কিন নাগরিকদের সংখ্যা ২৫ টি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।
৩০. আমেরিকায় ১৯৬৫ সালে প্রতি ৫০ জন নাগরিকের মধ্যে কেবল একজন খয়রাতি চিকিতসা-সহায়তা পেত। কিন্তু বর্তমানে দেশটির প্রতি ছয় জনের একজনকে এ সাহায্য নিতে হচ্ছে। ওবামা সরকার আরও এক কোটি ৬০ লাখ মার্কিন নাগরিককে এই খয়রাতি সহায়তার আওতায় আনার পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
৩১. ২০০১ সালে আমেরিকার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলারেরও কম। বর্তমানে দেশটির জাতীয় দেনার পরিমাণ ১৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ১৬ লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। প্রতি ঘণ্টায় এর সঙ্গে দশ কোটি ডলার যুক্ত হয়ে এই দেনার বোঝা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
৩২. ১৯৭৭ সালের তুলনায় বর্তমানে মার্কিন জাতীয় দেনার পরিমাণ ২৩ গুণ বেশি।
৩৩. মার্কিন পিবিএস (পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস) রিপোর্ট অনুযায়ী যেসব মার্কিন পরিবারের বার্ষিক আয় ১৩ হাজার ডলার বা তারও কম সেইসব পরিবার তাদের আয়ের শতকরা নয় ভাগ লটারির টিকেট বাবদ খরচ করে!
৩৪. মার্কিন অর্থনীতি যত বেশি শোচনীয় হচ্ছে ততই মার্কিনীরা হতাশা প্রতিরোধক ওষুধসহ চিকিতসকদের নির্দেশিত নানা ধরনের ওষুধ সেবন করছে। এই খাতে মার্কিনীরা ২০০৫ সালে যতটা অর্থ ব্যয় করত তার চেয়েও ৬০০০ কোটি ডলার বেশি খরচ করেছে ২০১০ সালে।
মার্কিন জনগণ যখন এতটা দুর্দশায় রয়েছেন তখন দেশটির কংগ্রেসের অর্ধেকেরও বেশি সদস্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করছেন খুব স্বল্প সময়ে। তারা অল্প কিছু সংখ্যক মার্কিন ধনকুবের বা পুঁজিপতির স্বার্থ রক্ষা করে চলছেন সংসদে। দেশটির মাত্র এক শতাংশ পুঁজিপতির হাতে আমেরিকার বেশিরভাগ সম্পদ পুঞ্জীভূত রয়েছে।
তাই নিরানব্বই শতাংশ বঞ্চিত মার্কিন নাগরিককে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার করতে ও ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক করতে সম্প্রতি শুরু হয়েছিল “৯৯ শতাংশ” শীর্ষক আন্দোলন। মার্কিন সরকার কঠোর হাতে এ আন্দোলন দমিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী শাসন-ব্যবস্থার দানব এভাবে বেশি দিন টিকে থাকতে পারবে না। #
রেডিও তেহরান/এএইচ/৭