শিক্ষাব্যবস্থা একটা জিনিস বটে! একেক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা একেক ধারার, একেক প্রকৃতির মানুষ তৈরি করে। যারা কওমী মাদ্রাসায় পড়ে তাদের চিন্তার ধারাটা একরকম। যারা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ালেখা করে তাদের চিন্তাধারা আরেকরকম। অন্যদিকে মাম্মি-ডেডি টাইপের শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যরকম মানুষ তৈরি করে। বাস্তব জীবনে এসব ভিন্ন ধারার মানুষগুলো যখন মিলিত হয় তখন কিছুতেই এক ধরনের মানুষ অন্য ধরনের মানুষের সাথে মিশতে পারে না। একের মতামত ও চিন্তাধারাকে অন্যে মেনে নিতে পারে না।
ব্রিটিশরা যখন আমাদের অঞ্চল দখল করে নেয় তখন তারা এই ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা আরোপ করে এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে বিভক্ত করে দিয়ে যায়। শিক্ষাব্যবস্থা আজও এ ধারাতেই বয়ে যাচ্ছে। ফলে আজও আমাদের মানসিকতা এক হতে পারেনি। ব্রিটিশরা মূলত একটা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা আর একটা ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে। তবে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় এই মানের শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে তোলার টার্গেট নেয় যারা বড়জোর ব্রিটিশ শাসকদের কেরানী হতে পারবে। এটা তাদের জন্য জরুরি ছিল। কারণ, তারা সংখ্যায় ছিল কম। অর্ধদুনিয়া সেই কম সংখ্যার মানুষ দিয়ে শাসন করা মুশকিল। তাই তাদের প্রশাসন চালাত দরকার প্রচুর সংখ্যক কেরানীমানের শিক্ষিত জনসংখ্যা।
এই কেরানীমানের শিক্ষিতদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলা হলো যে তাদের নিজস্বতা বলে কিছু বাকি থাকল না। তাদেরকে ইতিহাস শেখানো হয়েছে, কিন্তু সেটা ব্রিটিশ রাজা-রানীদের ইতিহাস, ইউরোপের ইতিহাস। তাদেরকে বিজ্ঞান শেখানো হয়েছে। কিন্তু সেটা সাধারণ মানের বিজ্ঞান। তাদের সাহিত্য শেখানো হয়েছে। কিন্তু সেটা ইউরোপীয় সাহিত্য। নিজেদের কিছু না শেখার কারণে তারা স্বভাবতই ইউরোপীয়দের মাহাত্ম্য জেনে তাদের প্রতি আপ্লুত হয়ে পড়ল। মনে-মগজে তাদেরকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মেনে নিল। আর নিজেদের ব্যাপারে, নিজেদের বাপ-দাদাদের ব্যাপারে তাদের মনে সৃষ্টি হয় হীনমন্যতা ও নিদারুণ লজ্জা। এসবের ফল হয়েছে এই যে, তারা নিজেদের প্রপিতামহের নাম মনে না রাখতে পারলেও শেকেসপিয়ারের পিতার নাম কি, ব্রিটিশ রাজাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা কত ইত্যাদি তাদের মুখস্ত।
বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। পরীক্ষার খাতায় নিজের প্রপিতামহের নাম লিখতে হবে না। কিন্তু শেকেসপিয়ারের নাম লিখতে হবে। ব্রিটিশ রাজা-রানী বা ইউরোপের ইতিহাস ভূগোল জানতে হবে। পাঠ্য বইয়ে প্রপিতামহের নাম নেই, বলার মতো তাদের বড় কোনো ঘটনা নেই। মূলধারার পাঠ্য বইয়ে যা আছে তা লজ্জাকর পরাজিত হওয়ার কাহিনী, অসহায় আত্মসমর্পণের কাহিনী, সংখ্যায় বহু হয়েও গুটিকয়েক ইংরেজের হাতে জন্মভূমি ছেড়ে দেওয়ার কাহিনী।
শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্রিটিশদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ওরাও একমাত্র গায়ের রঙ ছাড়া সবকিছুতে ব্রিটিশ হয়ে গেল। বিজয়ীদের কাপড় পরিধান করার স্টাইলকে অনুকরণীয় ফ্যাশন ভাবতে শুরু করল। তারা যেভাবে খানাপিনা করে সেগুলোর অনুসরণ করা শুরু করে দিল। দস্যুটাইপের ব্রিটিশ বেনিয়ারা ধর্মের দিক দিয়ে খ্রিষ্টান। কিন্তু এদেশীয়রা পুরোপুরি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে নিল না। তবে নিজের ধর্মেরও অনুসরণ করল না। কারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মকে কুণ্ঠিত করে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় তারা না খ্রিষ্টান আর না নিজের ধর্মের ভালো অনুসারী। নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানে না। তাই ধর্মের প্রতি খুব একটা টান এদের নেই। পারলে তারা ধর্ম ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচে। অনেকে তাই নিজের নাম রাখে অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির। যেন কোন ধর্মের সেটা পরিষ্কার না হয়।
দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে তারা এসব ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলো ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু তার আগে তারা তাদের পছন্দ মতো সেই শ্রেণিটার হাতে ক্ষমতা ছেড়ে যায়, যাদেরকে তারা হাতে কলমে গড়ে তুলে যায়, যারা তাদের অনুপস্থিতিতেও তাদের হয়ে কাজ করে যাবে। এরাই এখন আমাদেরকে শাসন করে যাচ্ছে। এই শাসকরা এখন আমাদেরকে ঠিক সেভাবেই শাসন করে যেভাবে শাসন করত ব্রিটিশরা। ঘটনা অনেকটা এরকম যে, জেল দারোগা চলে গেল। কিন্তু কয়েদীরা জেল থেকে বের হলো না। বরং তাদের মধ্য থেকে কিছু চতুর কয়েদীরা জেলারের আসনে বসে আগের মতোই জেলখানা চালাতে লাগল।
ওদিকে ব্রিটিশদের আমলেই অপর অংশ, যারা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে তারা কেবল ধর্মের খুটিঁনাটি তর্ক, মাসলা-মাসায়েল শিখেছে। দুনিয়ামুখী কোনো কিছু করে খাওয়ার শিক্ষা এরা অর্জন করেনি। ফলে এরা দুনিয়াবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ঐ শিক্ষিত শ্রেণির দান-দক্ষিণার উপর। যেহেতু সাধারণ শিক্ষিতরা ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে কিছুই জানে না, নিজের মা বাবার জানাজাটাও পড়াতে পারে না, সেহেতু তারাও নির্ভরশীল হয়ে পড়ল ধর্মীয় শিক্ষিত শ্রেণিটির উপর। প্রয়োজনের সময় ধর্মীয় শিক্ষিতদেরকে টাকা পয়সা নজরানাস্বরূপ দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেয়। এই ধর্মীয় শিক্ষিত শ্রেণিটিও সাধারণ শিক্ষিতদের মতোই আগের অবস্থানে রয়ে গেছে। তারাও আর এ থেকে বের হতে পারল না। তাদেরকে জোর করেও তা থেকে বের করা যাচ্ছে না।
সাধারণ শিক্ষিতদের মাঝে ধর্মের প্রভাব না থাকায়, আধ্যাত্মিকতা না থাকায় তারা দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দেয়। ফলে তারা ন্যায় অন্যায়ের ধার না ধেরে দুনিয়াবী দিক দিয়ে উন্নতি লাভ করে। একইভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, মন-মানসিকতা গড়ে ওঠে দুনিয়ামুখী হয়ে। অন্যদিকে যারা ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকে তারা সবকিছু কেবল পারলৌকিক দিক দিয়ে বিবেচনা করে। এ কারণে এই দুই শ্রেণির চিন্তাধারা কখনো মেলে না। একপক্ষ মনে করে ওরা ওরা পশ্চাৎপদ চিন্তাধারার। আরেক পক্ষ মনে করে তারা গোল্লায় গেছে। কিন্তু তারপরেও তারা একের উপর অন্যেরা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এভাবেই তারা চিন্তা-চেতনায় বিপরীত অবস্থান নিয়েও কেবল পারস্পরিক এ নির্ভরশীলতার কারণে টিকে আছে।