somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যদ্যপি আমার গুরু : দুটো মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক আর আটপৌরে আলাপও যেন সাগর থেকে তুলে আনা মণি-মুক্তোর মত অমূল্য রত্ন

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যদ্যপি আমার গুরু : দুটো মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক আর আটপৌরে আলাপও যেন সাগর থেকে তুলে আনা মণি-মুক্তোর মত অমূল্য রত্ন





পাঠক জীবনের একটা পর্যায়ে সবারই মনে মনে একটা ইচ্ছা জাগে যে আমিও একদিন লেখক হব, এমনি করে লিখব। কিন্তু বেশির ভাগেরই অবস্থা বোধহয় “I wanna a be a writer but I don’t know what to write about!” “যদ্যপি আমার গুরু” -এই প্রথম একটি বই কিছুটা আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে যে খুব আটপৌরে বিষয়বস্তুকেও রিপ্রেজেন্টেবল করে লিখলে সেটা থেকেই দারুন এক সৃষ্টি সম্ভব। এর মানে কিন্তু এই না যে বইটি এতটাই পলকা যে পড়ে মনে হয়, “এ আর এমন কি?! আমিও তো এরকম কতই লিখতে পারি?” বরং ঠিক উল্টো। বইটির বিষয়বস্তু দুই গুরু-শিষ্যের দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলাপচারিতার নানান দিক। কিন্তু নেহাত ঘোরোয়া আলোচনায় ইতিহাস-সংস্কৃতি, অর্থশাস্ত্র, রাজনীতি, ধর্ম কি যে উঠে আসেনি তাই ভাবতে হয়!

আহমদ ছফা আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে ছিলেন প্রায় সাতাশ বছর। সুদীর্ঘ একটা সময়। সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষক হলেও মনে হয়নি তাদের সম্পর্কটায় আদৌ কোন ফর্ম্যালিটি ছিল। এত দীর্ঘ সময় ধরে কাউকে গুনমুদ্ধ করে রাখা কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক পেরেছিলেন, শুধু ছফা নয়, সমসাময়িক অনেক প্রতিভাবানেরাই তাকে গুরুর আসনে আসীন করেছেন। এই মানুষটিকে বিশ্বকোষ বললে বাড়িয়ে বলা হয় না, জ্ঞানের শাখায় শাখায় তার অবাধ বিচরণ। ছাত্রের মনের জানালা খুলে দেয়া শিক্ষক বুঝে এমন কাউকেই বলে। অথচ বিস্তর পড়াশোনা, অগাধ জ্ঞানী এই মানুষটি কখনও নিজে কিছু লেখেননি । আবদুর রাজ্জাক স্যার কেন লেখেননি এই ব্যাপারে ছফা ব্যাখা দিয়েছেন এভাবে, এই মানুষটি তার সমকালীনদের গন্ডি পেরিয়ে এতখানিই উপরে উঠেছিলেন যে তাদের কাতারে নেমে আসা হয়ত একটু মুশকিল হত তাঁর জন্য। আবদুর রাজ্জাক স্যারকে সমালোচনাও কিন্তু তাকে কম শুনতে হয়নি। তৎকালীন বহু বিখ্যাত ও বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিদের নাম উঠে এসেছে ভাল মন্দ নানা প্রসংগে। উজ্জল একটি নক্ষত্রের মত এই মানুষটির ব্যক্তিজীবন ছিল খুব অদ্ভূত। খাঁটি ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন, কাপড়-চোপড়ের নেই কোন আড়ম্বর, খেতেও ভালবাসেন যা কিছু বাঙালী। অথচ তিনি কতটা বিশ্বজনীন প্রখর দৃষ্টির অধিকারী এই ব্যাপারে ছফা মন্তব্য করেছেন, “নিজেস্ব সামাজিক অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে এবং নিজের সামাজিক পরিচিতির আদি বৈশিষ্ট্যসমূহ গৌরবের সাথে ধারণ করে একটি বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।”

আমি বইটি পড়ার সময় আবদুর রাজ্জাক স্যারকে যতটা না লক্ষ্য করেছি মনের অজান্তেই আহমদ ছফার উপর নজর রেখেছি তার চেয়ে বেশি। সাতাশ বছর – এত দীর্ঘ সময়ের নানা কখনপোকথন থেকে আহমদ ছফা যে বিষয় গুলোকে আঁজলা ভরে তুলে নিয়েছেন সেগুলো আসলে আমার মনে হয় আবদুর রাজ্জাক নয়, আহমদ ছফাকেই বেশি সংজ্ঞায়িত করেছে। যে বিষয় গুলোতে তার মুগ্ধতা বেশি ছিল, স্যারের যে কথা গুলো তিনি ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন সেগুলোই তুলে এনেছেন তার বইতে। ভূমিকায় তিনি বলেছেন আবদুর রাজ্জাক স্যারের অনেক কথায় হয়ত অতি সংবেদনশীলেরা নিতে পারবে না, আবার অনেক কথার ভুল ইন্টারপ্রিটেশনে স্যারও রুষ্ঠ হবেন। তাই দুটো ব্যাপারে ছফাকে লক্ষ্য রাখতে হয়েছে। আবদুর রাজ্জাকের “Wit” গুলোও জায়গা বিশেষে সুন্দর করে খাপে মিলিয়েছেন যাতে করে নেহাত দুটি অচেনা-অজানা মানুষের কখনপোকখন পড়ে আমরা বিরক্ত না হয়ে যায়! অগাধ জ্ঞানের পাশাপাশি কাঁঠালের এঁচোড় বিষয়ক ঘটনার অবতারণা আবদুর রাজ্জাক স্যারের মানবীয় গুনাবলি প্রকাশ করেছে তো বটেই। হেনরী কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার ঘটনাও এক মজার ব্যাপার। আহমদ ছফার মুন্সীয়ানায় তাই আমি মুগ্ধ – ঠিক কতটুকু সিরিয়াসনেসের সাথে কতটুকু কৌতুক জুড়ে দিলে আমরাও আবদুর রাজ্জাক স্যারকে ভালবেসে ফেলব উনি তা মাথায় রেখেই এই বই লিখেছেন।

অনেকে অনেক প্রশ্ন হয়ত তুলেছেন আহমদ ছফার উদ্দেশ্য কি ছিল এই বইটি লেখার পিছনে, নিজের গুরুর মহত্ব তুলে ধরা নাকি আবদুর রাজ্জাক স্যারের নানান বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান ইত্যাদি। আমার কাছে মনে হয়েছে আহমদ ছফা এই অসাধারন মানুষটির সান্নিধ্যের স্বাদ কিছুটা হলেও আমাদের কাছে পৌছে দিতে চেয়েছেন এই বইটির মধ্য দিয়ে। দুজন অসম বয়সী বন্ধুর টুকরো টুকরো আলাপচারিতার স্মৃতিচারণ বলে একে মেনে নিতেও আমার আপত্তি নেই।

বইটি আরেকটি কারনে প্রশংসার দাবি রাখে তা হল এর অসংখ্য রেফারেন্স। ইতিহাস, ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য এত এত বিষয় দুজনের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে যে কেউ যদি এসব বিষয়ে আরও পড়াশোনা করতে চান তাহলে রেফারেন্স হিসাবে কি পড়বেন আমাদের আলোচ্য গুরুর কাছ থেকে তা ভালই জেনে নিতে পারবেন। বাংলার সুলতান থেকে শুরু করে জিন্নাহ, বঙ্কিম থেকে শুরু করে টলস্টয়, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত থেকে বিথোভেনের মুনলিট সোনাটা, মার্ক্স-এঙ্গেলস থেকে অ্যাডাম স্মিথ, ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র কিংবা সেক্যুলারিজম সবই তাদের আলোচনায় একে একে উঠে এসেছে। এমন নয় যে আপনি এসব সম্পর্কে বিস্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পাবেন এ বইয়ে, কিন্তু জ্ঞানের নানা শাখার সূত্র ধরিয়ে দিতে অবশ্যই সক্ষম হবে বলে আশা রাখছি। আবদুর রাজ্জাক স্যার নিজেই একবার আহমদ ছফাকে বলেছিলেন, “ প্রথম লাইব্রেরীতে ঢুইক্যাই আপনার টপিকের কাছাকাছি যে যে বই পাওন যায় পয়লা একচোটে পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনে নিজেই খুইজ্যা পাইবেন আপনার আগাইবার পথ।” আর আমার মনে হয়েছে “টপিক” টা কি বেছে নেব সেটারই নানান পথ বাতলে দিয়েছেন লেখক এই বইটিতে।

আবদুর রাজ্জাক স্যার বই পড়া প্রসঙ্গে খুব দারুন একটা কথা বলেছেন, “পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর্যা নিবেন , আপনের পড়া অয় নাই।” এই কথাটার সাথে নিজের মিল খুঁজে পেলাম। কারন আমার মনে হয় আমিও রিভিউ লিখি ঠিক একই কারনেই – যতটা না অন্য পাঠকদের বইটির কথা জানানোর জন্য তার চেয়েও বেশি আমি নিজের মধ্যে বইটা নিতে পেরেছি কিনা উপলব্ধি করার জন্য। দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল আহমদ ছফার এই বইটি পড়ার। সত্যি বলতে এই প্রথম তার লিখা পড়লাম। তাই হালখাতা খুলতে “যদ্যপি আমার গুরু”ই বেছে নিয়েছি। দুটো মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক আর আটপৌরে আলাপও যেন সাগর থেকে তুলে আনা মণি-মুক্তোর মত অমূল্য রত্ন। এই সুন্দর বইটা আসলে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতার মত মনে হল।

সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ১:২৯
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×