এক মন খারাপের দিনে চায়ের কাপে চিন্তিত চুমুক দিচ্ছিলাম। হটাত চোখে পড়ল আমার চেয়েও বেশি মন খারাপের এক মুখচ্ছবি। সিগারেটের ধোঁয়া মুখ দিয়েও বেরোচ্ছে আবার নাক দিয়েও বের হচ্ছে ছেলেটার। পরনের কি ছিল খেয়াল করার মানে নেই। হাত বাড়িয়ে দিলাম হাসিমুখে, 'কেমন আছেন?'
- ভালোই আছি। কে আপনি? আমাকে চেনেন? আমি কিন্তু আপনাকে চিনি নাই।
একসাথে বেশি প্রশ্ন করা ভালো না ।তারপরও আমি মেনে নিলাম, বুঝলাম সে অপরিচিতে বিব্রত।
-আমি এখানেই থাকি। এখানেই চা খাই। আমি বিপ্লব। আমি আপনাকে চিনি না, কিন্তু এখানে যারা আসে সবাই আমাকে চেনে। তাই ভাবলাম আপনিও আমাকে চেনে রাখেন।
- আমি হৃদয়। চট্টগ্রাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় এসেছি পড়াশোনা করতে ।
- আচ্ছা। ভালো।
এভাবে একদিন, দুদিন, তিনদিনে আমাদের মধ্যে ভালোই সম্পর্ক হয়ে গেল। আমরা একসাথে বাসা থেকে বের হয়ে একসাথে চায়ের দোকানে ঢুকে একসাথে চা খেয়ে একসাথে বের হয়ে একসাথে রেল লাইন ধরে হেঁটে বেড়াই। আমি যেহেতু লেখালেখি করি, আমি সবসময় অন্যের গল্প শুনি কিন্তু নিজের গল্প কাউকে বলি না। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে তার বলে যাওয়া একটা গল্প শুনলাম। ও নিজেই নিজের গল্পের নাম দিল," প্রথম বাবা দেখা"।
আমার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় যখন মায়ের গর্ভে আমার বয়স ৫ মাস। মা আমাকে নিয়ে মামার বাড়ি চলে আসে । আমার নানু বেঁচে আছে এখনো, তাই মামা-মামীদের কাছে আমার আর মায়ের কদর আছে এখনো। মামার বাড়ীতে থাকলে কোন মানুষের জন্যই পথচলা মসৃণ হয় না। আমারও মসৃণ ছিল না। অনেক কথা শুনে বড় হয়েছি, ক্লাস টেনে উঠে আস্তে আস্তে ফিডব্যাক দেয়া শুরু করি। টুকটাক রাজনীতিতে সম্পর্ক রাখা শুরু করি , আর কেউ কিছু বলে না।
তখন কলেজে পড়ি।আমার বয়স আঠার উনিশের মাঝামাঝি। কলেজে উঠলেই গায়ে গরম চলে আসে কিন্তু। একবার আমাদের গ্রামের এক মাতব্বরের ছেলেকে মেরেছিলাম। সামান্য ঝগড়া থেকে ও আমার মাকে গালি দিয়েছিল, আমি সহ্য করতে পারি নাই। সকালে ওকে একা মেরেছিলাম আর বিকালে বন্ধুবান্ধবসহ মেরেছিলাম। আমি দুবারই ওর মাথায় আর মুখে হাতুড়ি দিয়ে মেরেছি। হাত থেকে হাতুড়ি পড়ে যাবার পর হাত দিয়ে ঘুষি দিছি, খুব মারছি। ওকে দ্রুত হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। মনের জেদ মিটে নাই দেখে আবার মারার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখনই খবর পেলাম ওরা আমাকে মারতে আসছে। চারদিকে ফোন দিয়ে বন্ধুদের খবর দিলাম। সবাই সাথে সাথে চলে আসায় আর আমাকে কিছু করতে পারেনি। এদিকে আমার মা প্রায় পাগল হয়ে যাবার মত অবস্থা। তারপর বিশাল সালিশ বসবে বলে কথা হচ্ছে। আমার নাকি বিশ হাজার টাকার মত জরিমানা করবে। আমি তখন পাগল হয়ে গেছি প্রায়। আমি এত টাকা কোথা থেকে দিব? মা কত কষ্ট করে আমাকে পড়ালেখা করান তার উপর খেতে কষ্ট হয়। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সালিশের বিচার না মেনে ইউনিয়ন পরিষদে আপিল করব। আমি আসলে জানতাম না কি ঘটতে যাচ্ছে।
এদিকে আমার সাথে না পেরে আমাকে গালাগালি করা হচ্ছে। কিন্তু একটা গালি শুনে আর ঠিক থাকতে পারলাম না , "জারজ"। যদিও আমি আমার বাবাকে দেখি নাই কিংবা বাবার সাথে কখনো আমার কথা হয় নাই, তবুও আমি জানতাম যে আমার বাবা আছে। তারমানে আমি জারজ না। কিন্তু সবাই জানেনা কিংবা জানলেও আমাকে গালি দেয়ার জন্যই বলা হইছে। আমার ছোট ফুফু আবার আমার মামার বাড়ির পাশেই বিয়ে হইছে। উনি সব কিছু কার কাছে শুনে বাবাকে ফোন করে বললেন, এটা আমি জানতাম না।
পরদিন সকালে বিশাল সালিশ বসল। ঐ দোকানেই যেখানে আমি ছেলেটাকে মেরেছি। গ্রামের চেয়ারম্যান যদিও আমার ফেভারে ছিল কিন্তু মাতব্বরের হুমকির মুখে উনি আসলেন না। হঠাত করে দশ বারটা মোটরবাইক আর তিন চারটা সি এন জি চালিত বেবীট্যাক্সি আসল। সবমিলিয়ে ত্রিশ জনের মত হবে। আমার পাশের বাড়ির একজন আমাকে চিনিয়ে দিলেন আমার বাবা কে। আমি গেলাম বাবার কাছে। চেহারা আমার মতই, ক্লিন শেভড, পিছন দিকে ফিরানো চুল, হাতে সিগারেট। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ,'কেমন আছ?"
- ভালো। ভেবেছিলাম বুকে ঝরিয়ে ধরবে। ধরে নাই। যাইহোক মরুভূমিতে দু এক ফোঁটা পানি পড়লেই কি আর না পড়লেই কি???????
বিচার আমার পক্ষে আসল। আমাকে গালাগালের অপরাধে মাতব্বরের ছেলেকে বকাঝকা করা হল। আর আমাকে বলা হল ছেলেটাকে মুছে দিতে, দিলাম।
এই প্রথম আমি আমার বাবাকে দেখলাম। পুরাই আমার মত। একটু রুক্ষ। মুখে হাসি মনে হয় কখনোই ছিলো না।
তারপর অনেকবার দেখা হল, কথা হল, কিন্তু সেই প্রথম দেখার অনুভুতি পাই নাই। আমার প্রথম সিগারেট খাওয়া ছিল ২০১০ এর বাবা দিবসে, হাতে সিগারেট রেখেই মাকে ফোন দিলাম, "মা, বাবার কথা খুব মনে পড়ছে"
মার উত্তর ছিল অনেক মায়াময়," আমি তোর বাবা না?" হয়ত কথাটা বলার পর মা কেদেছে।কিন্তু আমি আর হতাশ হইনাই।
বিপ্লব, একটানা কথা গুলা বলে ফেললাম। তোমাকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ দিই নাই।
আমি রেললাইনের পাশের ধূসর ঘাস গুলর দিকে তাকিয়ে দু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছি। আমি আমার অতীতের দিকে তাকালে ছেলেটা আমার গল্পই আমাকে শুনালো। আসলে গল্প না, আক্ষেপ।
অবশেষে আমি আশরাফ, আর বিপ্লব আমার বন্ধু।