শামুক নাকি ঘণ্টায় ২৪ ইঞ্চি পথ চলে। একথা আমাকে প্রথম বলেছিলেন বড় ভাই।
বাসে ভিড়ের ভেতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাইয়ার কথাটা ভাবতেছিলাম। বাস চলছে শামুকের থেকে ধীর গতিতে। একহাতে ৫ টা বইয়ের একটা প্যাকেট অন্যহাত দিয়ে বিআরটিসি দোতালা বাসের গেটের রড ধরে দাঁড়িয়ে আছি। প্রচণ্ড গরম, ফরমাল ড্রেস পরা ( পায়ে জুতা) গরম বেশ লাগছে। বাসের ভেতরে ভিড়ে এমন চাপাচাপি যে ভূরি ধারী লোকটা তার ভুরির জন্য আজ সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। চাপাচাপির এমন তীব্রতার জন্য। এক পর্যায়ে সুপারভাইজারের চলাচল প্রায় বন্ধ দেখে সব স্টুডেন্টদের ব্যাগ কাঁদ থেকে নামিয়ে সামনে আনতে বলল। অবশ্য তাতে ফাপর শুনতে হয়েছে তাকে।
যাচ্ছি ফার্মগেট থেকে আবদুল্লাহপুর। বাসের ভেতরে যেখানে তিল ঠাই নাই সেখানে একজন যাত্রী যদি বাস থেকে নামে তাহলে দশজন ওঠার জন্য চেষ্টা করে। আর যে এই বাসে ওঠার যুদ্ধে সফল হচ্ছে সে প্রথমে উঠে নিজের পকেট চেক করে। কারণ এমন ভিড়েই পকেট থেকে ফোন চুরি হয় বেশি। আর যার ফোন পকেটে থাকবে সেই সবথেকে সফল ব্যক্তি যেন কোন যুদ্ধ জয় করে উঠলো।
বাস ফার্মগেট পেছনে রেখে যখন আগারগাও এলো তখন আবারও জ্যামে আটকে গেলো । একজন যাত্রী নামতেই ৭/৮ জন যাত্রী বাসে ওঠার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছে। আমি সিঁড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় । দেখলাম দুই একজন পুরুষের সাথে একজন ৪০+ বয়সী মহিলাও উঠেছে। এই ভিড়ের ভেতরে ধাক্কা সামলিয়ে বাসে উঠা নিশ্চয়ই তার জন্য এভারেস্ট জয় করার মতন।
মহিলা বাসে উঠেই তিনি নিজের জন্য কিছু জায়গা করার চেষ্টা করছেন। এতেই শুরু হল তার জন্য বিপত্তি। তার জন্য একটু বাড়তি জায়গা দিতে গিয়ে আশেপাশের সব পুরুষদের হচ্ছে নানা সমস্যা। এমনিতে ধাক্কাধাক্কি, চাপাচাপিতে সবারই কষ্ট হচ্ছে সাথে উনার জন্য আরও বেড়ে যাচ্ছে। আশেপাশের অনেকেই সহনশীল না হয়ে হচ্ছে বিরক্ত।
একজন সুপারভাইজার কে ডেকে বলে- এই মিয়া বাসে মহিলা উঠাইছেন কেন ?
আরেকজন বলে- বাসে কি সীট আছে নাকি যে মহিলা উঠাইছেন ? নাকি আপনার মাথায় সীট আছে ?
মহিলা প্রতিবাদী হয়ে উঠলো, বাসে পুরুষ উঠতে পারলে মহিলা উঠতে পারবে না কেন ?
একজন বলল, না পারবে না।
সাথে এই লোকটা আরও কিছু বলতে গেলো। লোকটা আমার পাশে ছিল , আমি তাকে থামালাম। লোকটাও থামল।
অন্য একজন হঠাৎ বলে উঠলো , আপনার আর আমার পার্থক্য কি জানেন ? আপনি হলেন মহিলা আর আমি হলাম। এই নামে পার্থক্য মহিলা আর পুরুষ।
লোকটা আরও কিছু কথা বলল। কথার ভেতরে মূর্খতার ছাপ । তাছাড়া রয়েছে নৈতিকতার অভাব। তার যুক্তি খণ্ডন করার দিকে এগুলাম না।
চলছে কথা কাটাকাটি। মহিলা চারপাশের মানুষের প্রতি ক্রোধে ফেটে উঠছেন। আমি কার পক্ষে কী বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। পরিবেশ পরিস্থিতি আসলে কারোর অনুকূলে না। এমন না যে কেউ আরামে বসে যাচ্ছে , ফাঁকা বাস এমনও না। কেউ কেউ অনেক অপেক্ষার পর সীট পেয়েছে সে সীট ছাড়ছে না। সেও যে বসে আরামে আছে মন না। তার গায়ের উপর ঝুঁকে আছে আরও একজন। আর এ ঘটনা তো ঘটছে গেটের কাছে। ভেতরে সীট পর্যন্ত যাওয়াও তো অনেক ঝাক্কি ঝামেলার ব্যাপার।
আমি কী যেন ভেবে আস্তে আস্তে বললাম, আন্টি আপনার নিরাপত্তার জন্যই সবাই এমন বলছে।
আমার কথাগুলো তার পর্যন্ত পৌছায় নাই। আর তিনিও তো জানেন যে এই ভিড়ে নোংরা পুরুষ দ্বারা কী ধরণের নোংরামির স্বীকার হতে পারেন। কিন্তু তার তো যেতে হবে বাসায়। এমন না যে বিশ মিনিট পর যে বাস আসবে সেটায় কোন ভিড় থাকবে না। ভালো ভাবে যেতে পারবেন এমনও না। সারাদিনই এমন থাকবে। তাহলে কি তিনি যাবেন না ?
তাকে তো বাসায় যেতে হবে । তাকে বাসায় যেতে হবে স্বামী অফিস থেকে বাসায় এসে গরম ভাত চাইবে এর জন্য, তাকে বাসায় যেতে হবে কলেজ থেকে ছেলে/ মেয়ে এসে মা কে খুঁজবে এর জন্য, তাকে বাসায় যেতে হবে কাজের বুয়াকে কোন কিছু নিয়ে পালিয়ে না যায় তার জন্য, তাকে বাসায় যেতে হবে নিজে অসুস্থ বাসায় যেয়ে ঔষধ খেতে হবে তার জন্য। একটু দ্রুত যেতে পারলে একটু বেশি ভালো হয়।
মাঝে মাঝে বাসে থেকে দেখি বাসের হেল্পার মহিলা/ মেয়ে বলে বাসে তুলছে না। মেয়েটি/ মহিলা ছুটে চলা বাসের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তার দু'চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে অপরাধের অশ্রু। তার অপরাধ সে মেয়ে হিসেবে জন্ম নিয়েছে আর এ জাতি দিতে পারছে না তাকে সুস্থ যাতায়াত ব্যবস্থা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৯:৫৫