-আপনার কীভাবে মৃত্যু হয়েছে ?
প্রথম প্রথম প্রশ্ন শুনে চমকে উঠতাম। আমার যে মৃত্যু হয়েছে এটা মানতে পারতাম না। জীবনের জড়তা হয়তো কাটে নাই তখন। এখন শুনতে শুনতে আর উত্তর দিতে দিতে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
আমি কবরে আসার পর আশেপাশের কবর থেকে সব এসে আমার কাছে ভিড় করে। জানতে চায় আমার কীভাবে মৃত্যু হয়েছে। কারোর গায়ে গন্ধ, কারোর গায়ে সুবাস এক একজনের এক একরকম। আমি শুধু অন্যরকম। আমার উপর কোন শাস্তি বা শান্তি কিছুই দেওয়া হয় নাই। সবার কৌতূহল তাই আমাকে নিয়ে। পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে । প্রত্যেক রাজনৈতিক দল আমার মূর্তি বানাচ্ছে। ইসলামী দলগুলো আমার নামে মসজিদ বানাচ্ছে। কারণ জানার জন্য সবাই উদগ্রীব। যতটা আগ্রহ নিয়ে আমার কাছে আসছে ঘটনা জানার পর ততটায় হতাশ হছে। একবার কেউ আসল কথা জেনে যাবার পর তার আর আনাগোনা থাকছে না।
-বলছেন না যে ?
এবার চমকে উঠলাম। এমন কর্কশ আর ভারী গলা শুনে যে কেউ চমকে উঠবে। জীবিত থাকাকালীন সময়ে উনার গলা সুন্দর ছিল। রাস্তায় মেয়েদের দেখে শিস দেবার জন্য তার গলা কর্কশ করে দেওয়া হয়েছে। ভাবছিলাম উত্তর কেমন দেব সংক্ষেপে নাকি এককথায় নাকি ঠিকঠাক বর্ণনা দেব। ভাবতে ভাবতে দেরি হয়ে গেলো আর তাতে উনার সহ্য হয় নাই।
-কী যেন বললেন ?
আমি নিজে রেডি হবার জন্য ইচ্ছাকৃত আবার জানতে চাইলাম। সে আরও রেগে গেলো কারণ সে আমার ইচ্ছাকৃত কাজের কথা জেনে গেছে। মৃত্যুর পর একজনের সাথে আরেকজনের মনের যোগাযোগ সম্ভব, সব জেনে যায়। আরও কর্কশ গলা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তবু তিনি ধমকালেন না।
-আপনার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে ?
-আজরাইল এসে জান কবচ করেছে। তাতেই আমার মৃত্যু হয়েছে।
-আমাকে রাগাবেন না কিন্তু। রাগলে আমার গায়ের পোকা আপনার গায়ে দিয়ে দেব।
-তাতে আল্লাহ তো আপনার গায়ে আরও পোকা দেবেন। আর আপনার পোকা আমাকে কামড়াবে না।
উনি আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। অবশ্য উনার চোখের পাপের জন্য উনার চোখ এমনিতে লাল করে দেওয়া। এবার কাল হয়ে গেলো। আমি বিষয়টা বুজতে পেরে আর কথা ঘুরালাম না।
-আমার মৃত্যু হয়েছে ক্ষুদার যন্ত্রণায় আর মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে মানুষের লাঠিপেটায়।
-আপনি একটা মিথ্যা বলেছেন। আপনি নিশ্চয়ই টের পেয়েছেন। না খেয়ে কেউ মরে না।
এ পারে এসে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বললেই চেহারায় একটা কালো দাগ পড়ে যায়। অবশ্য আমার শরীর আধপোড়া কালো দাগ পড়লে বেশি বুঝা যায় না।
আমার মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত বাসী খাবার খেয়ে। বাসী খাবার আবার খেয়েছিলাম চুরি করে। গ্রামের বাড়ি নড়াইল থেকে অভাব অনাটনে ভুগে এসেছিলাম ঢাকায়। ভেবেছিলাম এখানে এসে কোন একটা কিছু করে খাওয়া যাবে। কিন্তু ঢাকায় আসার পর ধারণা বিপরীত হল। সাথে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো। এখানে আসার পর পর দেশের রাজনৈতিকদলগুলোর আন্দোলনের জন্য সব রাস্তা বন্ধ। কেউ কোন কাজে নিচ্ছে না। গার্মেন্টসগুলোর বেহাল দশা।
চাচার কাছ থেকে ধার করে আনা টাকা প্রথম দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। এরপর থেকে অনাহার যাপন। রাত্রে ফুতপাথে ঘুমানো, দিনে ভিক্ষাবৃত্তি করে চলছিল। চেহারা,জামা-কাপড়ের অবস্তা বেহাল হয়ে গেলো। কুড়িয়ে পাওয়া একটা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি এই এক পোষাকে বেশ কয়েকদিন চলছে। দাড়ি গোঁফ বেড়ে দেখতে গাজা বাবার মতোই লাগছে। সব সহ্য করলেও পেট পেটের কষ্ট সহ্য করা যায় না। দুই দিন খেতে না পেরে এদিক সেদিক খাবার খুজতেছিলাম। শাহাবাগের কাছে এক হোটেলর পেছনে গিয়ে দেখি রান্না ঘরের তাকের উপর প্লেটে খাবার রাখা। কেউ ছিল না সেখানে। দোকানের বাইরের দিকে রাজনৈতিক দুই দল মুখমুখি অবস্থান করছিল। সবাই সেদিকে। খাবারে গন্ধ পাচ্ছিলাম কিন্তু খিদের জ্বালায় নাক বুঝে খেয়ে ফেললাম। খাওয়ার পর থেকে মাথা প্রচণ্ড আকারে ঘুরতে লাগলো। সাথে পাকস্তলি যেন গুলিয়ে আসছে। তখন হঠাৎ করে একটা লাল কৌটা চোখে পড়লো। গায়ে লেখা ‘ ১০০% খাঁটি ইঁদুর মারা বিষ।’ বুঝতে পারলাম হোটেলের মালিক বাসী খাবারে ইদুর মারার জন্য বিষ মেখে রেখেছে । অবশ্য মৃত্যুর পর খাবার চুরি করে খাবার জন্য শাস্তি হয় নাই। বেঁচে থাকতে কুটনামি করতাম না। অন্যের দোষ গোপন রাখার জন্য আমার কিছু দোষ গোপন রাখা হয়েছে।
-এরপর কী হল ?
-কিসের পর ?
-ঐ খাবার খাওয়ার পর ?
আমি ভুলে গিয়েছিলাম কবরে আসলে একজন আরেকজনের মনের কথা পড়তে পারে। এতক্ষণে যা যা ভাবছিলাম সব সে পড়ে ফেলেছে।
-হঠাৎ করে হোটেল বয় পেছনে চলে আসে। আর আমাকে তাড়া দেয়। আমি পথ না পেয়ে গলি দিয়ে রোডের দিকে চলে আসি। দুই দলের যেখানে মুখোমুখি আন্দোলন হচ্ছিল।
-কোন দলের লোকের ভেতরে গিয়েছিলেন ?
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। উনি আবার কোন দল করতো কি না। যদি উনার দলের লোকের সাথে না ভেড়ার কথা বলি তাহলে হয়তো গায়ে পোকা দিয়ে দেবার ভয় দিবে।
-আমার মনে নেই। দুই দিনের না খাওয়া পেটে ইদুর মারা বিষ খেয়ে মাথা ঘুরছিল। মনে হয় মাঝ বরাবর। এক দল আমাকে ভাবছিল বিপরীত দলের , অন্যদল ভাবছিল তাদের বিপরীত দলের। আর সাথে সাথে দুই পাশের লোক এসে শুরু করলো আমার উপর লাঠিপেটা। কেউ একজন এসে আমাকে টেনে জলন্ত টায়ারের উপর ফেলে দেয়। এরপর আর কিছু মনে নেই, জ্ঞান ফেরার পর দেখি আমি আপনাদের সাথে।
এমন সময় পাশে এসে বসেছে আর এক প্রতিবেশী। কথায় খুব পটু। ও আমার থেকে দুই তিন কবর দূরে থাকে । সহজ সরল মানুষ। কিন্তু কৌতূহল বেশি। বেচারার মৃত্যু হয়েছে আমার মৃত্যুর কিছুদিন পরই। রোড এক্সিডেন্টে সে মারা যায়। আমাকে নিয়ে যতসব হুলস্থূল কর্মকাণ্ড সে দেখে এসেছে।
সে আমাকে প্রথমে স্যালুট দিয়ে বলা শুরু করে। সে সবসময় আমাকে ‘স্যার’ সম্বোধন করে কোথা বলে। সে আমাকে বেশ সম্মান করে তা আচারণ দ্বারা বোঝাতেও চায়। তার কথা হল কেউ আমাদের মৃত্যুর পর মনে রাখছে এটা কম কিসের। সে যেভাবেই হোক। মৃত্যুর পর যদি কেউ মনে না রাখে সে মরায় লাভ কী ? ভালো খারাপ কোন একটা করে আসতে হবে পৃথিবীতে যেন মানুষ যুগে যুগে স্মরণ করে।
-‘স্যার কে মেরে ফেলার পর একগ্রুপ বলে ওটা আমাদের দলের কর্মী আরেকগ্রুপ বলে আমাদের গ্রুপের কর্মী। পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যেতেই লাশের দাবিতে আলাদা আলাদা মিছিল করতে শুরু করে। শুরু হয় আরেক দফা মারমারি নিজেদের কর্মী মারার জন্য।
মর্গ থেকে লাশ বের করার পর এলোমেলো দাড়ি আর লম্বা পাঞ্জাবী দেখে অনেকে আবার বাউল ফকির বলা শুরু করে। একটা পুটলি পাওয়া গিয়েছিল ঘটনা স্থলে বলে স্যারকে বাউল গ্রুপ নিজেদের কর্মী হিসেবেও দাবি করে। বাউলরা একটা আঁকড়াও বানায়। আমি ওটা দেখতে গিয়েই তো রোড এক্সিডেন্ট করে মারা যাই ।’
যতবার ওর মুখে আমাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কথা শুনি ততই হাসি পায়। আমি হাসলে যারা কবরের আজাব ভোগ করছে তারাও হাসে। আমার সামনের দাঁত নেই পাঁচটা। লাঠি পেটায় পরে গিয়েছিল। দাঁত ছাড়া হাসি দেখে তারাও একটু হেসে নেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫