হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ পেলাম সকালে ঘুম ভেঙ্গে।অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম,যতটা খারাপ লাগার কথা ততটা লাগছে না।এই কয়েক দিন ক্রমাগত হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে টিভি চেনেল গুলোর একের পর এক প্রতিবেদন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম।এই ভাবনা গুলোই লিখতে বসলাম আজ।
আমার বাসায় তাঁর কিছু বই আগে থেকেই ছিলো।ছোটো চাচার কিনা।বই গুলো চোখের সামনেই ছিলো,পড়তাম না।এক পেইজ দুই পেইজ পড়ে রেখে দিতাম।তারপর হঠাৎ একদিন যেন বড় হয়ে গেলাম।এক টানে শেষ করলাম 'কবি' বইটা।চলে গেলাম জাদুবাস্তবতার অলৌকিক ভুবনে।সেই ঘোর সহজে ছাড়লনা।
এরপর হুমায়ুন আহমেদ -নামটা অমোঘ আকর্ষণের মত হয়ে উঠলো।মলাটে এ নাম থাকলেই যেন তা পাঠ্য উপযোগী।ক্লাস থ্রী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-দীর্ঘ সময়।আমার দুর্ভাগ্য হল আমি পরের বই গুলো আগে আর আগের বই গুলো পর পড়েছি।যে কোনো পাঠক তাঁর লেখার ভঙ্গির যে ক্রম পরিবর্তন তা সহজেই ধরতে পারবেন।
আশি আর নব্বইয়ের দশকে লেখা হুমায়ুন আহমেদের বই গুলো ছিলো করুন রসে লেখা নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবার গুলোর অভাব অনটনের চিত্র।নিষ্ঠুর বাস্তবকে তীব্র ভাবে ফুটিয়ে তোলার একটা প্রয়াস দেখা যেত অই সব বইয়ে। এ ঘরনার কয়েকটা বইঃ
আশবরী
জয়জয়ন্তী
সাজঘর
কোথাও কেউ নেই
মেঘ বলেছে যাব যাব
এই সব বই গুলো পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়।বেশির ভাগ বইই দ্বিতীয়বার পড়ার ইচ্ছা হয় না। অনেক বইয়ের শেষটা চরম ট্র্যাজিক ।আমি ঠিক জানি না এর পর কবে তিনি তার যাদুবাস্তব বই গুলো লিখা শুরু করলেন,তবে এগুলোই তাকে অসম্ভব জনপ্রিয় করার সাথে সাথে সমালোচকদের প্রিয় টারগেটে পরিণত করে দেয়।
লিলুয়া বাতাস-এইটা হলো উনার দ্বিতীয় শ্রেণির বইগুলোর ভাল একটা উদাহরণ।অসম্ভব সব চরিত্র।ভাষায় একটা নিজস্ব স্টাইল।চমকের পর চমক।ঘটনার নাটকীয় সব বাঁক।পাঠক ঘোরের মধ্যে যে কখন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ করে ফেলবে নিজেই টের পাবেনা।কাহিনীর মাঝে মাঝে কিছু ফিলোসফিক লাইন।বৃষ্টি,জোৎস্না নিয়ে আবেগ।নিজের তৈরী কাঠামতে নিজেই বন্দী হয়ে গেলেন যেন শেষের দিকে।
তাঁর নাটকেও একই অবস্থা।আজ রবিবার,অয়ময়,কোথাও কেউ নাই,বহুব্রিহী-এগুলোর সংলাপ,অভিনেতারা ছিলেন একটা ক্যাটাগরীর।হুমায়ুন ফরিদী,জাহিদ হাসান,সুবর্ণা মোস্তফা,আলী যাকের,মোজাম্মেল হক-তাঁর নিজস্ব বাহিনী ছিল।ওই সব নাটকের কাহিনী ছিলো সলিড,সংলাপ ছিল সূক্ষ্ম রসবধ সম্পন্ন।মানুষকে হাসানোর জন্য লাগাম ছাড়া ভাঁড়ামো ছিল না।মানুষ তখন অইসব নাটকে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলো যে বাকের ভাইয়ের ফাঁসির প্রতিবাদে রাস্তায় মিছিল হয়।কোন নাটকে ডাক্তারদের নিয়ে কি জানি বলেছিলেন,তাই তাঁর কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়ে ছিলো। তখন অবশ্য বিটিভি ছাড়া অনয কোনো চেনেলও ছিলো না।তারপর দেখলাম তাঁর আরেক বাহিনী।ডাক্তার এজাজ,ফারুক,স্বাধীন খসরু,শাওন।নতুন কাঠামো,নতুন সংলাপ।কিন্তু এক কুমিরের বাচ্চা কয় বার দেখা যায়?আমি নিজেই তাঁর নাটকের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।
তাঁর মৃ্ত্যুর পর সব টিভি চেনেল গুলোতে অনেক প্রতিবেদন দিচ্ছে।টক শো করছে।একটা জিনিস খুব অড লাগলো।প্রায় কেউই 'নন্দিত নরকে' আর ;শংখনীল কারাগার' এই দুইটা ছাড়া অন্য কোনো বইয়র নাম জানে না।প্রচন্ড বিরক্তিকর।
বেশির ভাগের স্ট্যাটাসে দেখলাম হিমু,মিসির আলী,শুভ্র মারা গেসে বলে হাউকাউ।আমার কাসে এরা বহু আগেই মারা গেসে ।গত কিছু বছর ধরে হিমু,মিসির আলীর বইগুলা ফরমেয়াসী লেখা ছাড়া আর কিছুই হচ্ছিলো না। প্রতি বই মেলায় একটা হিমু না হলে ব্যবসা হবে না। কই 'পারাপার','তোমাদের এই নগরে',সে আসে ধীরে , আর কিসের 'হলুদ হিমু কালো র্যাব,আজ হিমুর বিয়ে,রিমান্ডে,আঙ্গুলকাটা জগলু' ; খুব দুঃখের সাথে লক্ষ্য করলাম তিনি আর নিজের মন থেকে লিখছেন না। বাধ্য হয়ে লেখা টাইপ। হিমু অবশ্য এম্নিতেউ আমার প্রিয় চরিত্র হলেউ তার বইগুলো ভাল লাগতো না। কারণ, ধরলাম হিমু একটা আনকমন চরিত্র,অ্যান্টিলজিক নিয়ে কাজ করে। কিন্তু বাদল,মাজেদা খালা,ছোটো ফুপা,রূপা-এরাও কি অস্বাভাবিক চরিত্র নয়? আসলে এরা নরমাল হলে হিমুর বই গুলোর কাহিনী আগাত না।এরা হিমুকে তাল দেয় বলেই কাহিনি আগায়।এক বইয়ে এত অ্যাবনরমাল চরিত্র হজম হয় না।
হিমুর তুলনায় মিসির আলী চরিত্রটি অনেক সহজ।যে কেউ ইচ্ছা করলেই হিমুর মত আজগুবি কাজকাম করতে পারবেনা,কিন্তু মিসির আলির চরিত্র টা অনুকরণ করতে ত পারবেই,আমার মনে হয় করলে ভাল। হয়তো তাঁর মত বিশ্লেষনি ক্ষমতা থাকবেনা,কিন্তু শান্ত ও চুপচাপ ত থাকা যাই ই।শুভ্রও মোটামুটি বাস্তবই লাগে।যদিও রিসেন্টলি পড়ি নাই।
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর লেখনীর সেরা কাজ গুলো দেখিয়েছেন আমার মতে নিচের তিনটি ক্ষেত্রেঃ
(১)আত্মজীবনী মূলকঃ অনন্ত অম্বর,হোটেল গ্রেভার ইন,এই আমি ইত্যাদি।
(২)ইতিহাস ভিত্তিকঃ মধ্যাহ্ন,বাদশাহ নামদার,মাতাল হাওয়া ।
(৩)ভৌতিক গল্প
সায়েন্স ফিকশন গুলোতে তিনি কাহিনি কিংবা সায়েন্স থেকে মানবিক আবেগকেই বেশি হাইলাইট করেছেন।কিছু কিছু সাইফাই পড়লে বিভ্রান্ত হতে হয় এটা আসলেই সাইফাই কিনা। অনন্ত নক্ষত্রবিথী পড়ে মেজাজ খুব খারাপ হয়েছিলো।
হুমাযুন আহমেদের মত ভৌতিক বা অতিপ্রাকিত গল্প এক জাফর ইকবাল ছাড়া আর কেউ লিখসেন বলে মনে হয় না। উনার প্রিয় লেখকও ছিলেন স্টিফেন কিং।কং এর বই আমিও পড়সি।ভুতের গল্পকে অন্য লেভেলে নিয়ে গেসেন।
কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি কার কাসে না থাকলেও 'কবি' উপন্যাসে তাঁর কবিতা গুলো পড়লে বোঝা যায় তিনি চেষ্টা করলে এই ক্ষেত্রেও দারুন করতেন।
সবাই কেন হুমায়ুন আহমেদের বইই বেশি কিনে?এর কারণ আমার কাসে মূলত আর্থিক নিরাপত্তা।টাকা দিয়ে অন্যকারো বই কিনলে সেটা উসুল হবার চান্স সবচেয়ে বেশি তাঁর বইয়েই।শেষের দিকে তো উনি পাঠককে আনন্দ তথা বিনোদনের জন্যই লিখে গেসেন বলে মনে হচ্ছিলো।
সিনেমার ক্ষেত্রেও একি অবস্থা।আগুনের পরশমণির মত সিনেমা আবার কবে হবে কে জানে?শ্রাবণ মেঘের দিনে আমার হলে গিয়ে দেখা প্রথম মুভি।বাকি গুলার কথা আর বললাম না। সবই আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক হয়ে গেল।
রহস্যময়তা তাঁর লেখনীর প্রধান একটা অস্ত্র। গ্রামাঞ্চলের পটভুমিতে লিখলে"সুসং দুর্গাপুর', ভাটি অঞ্চলের মানুষ-এগুলো থাকবেই। উইশমেকিং ও তাঁর লেখনীর আরেকটা উপাদান ।চরিত্ররা এমন সব কান্ড ঘটাবে যা শুধু কল্পনাতেই করতে পারি।কাহিনীর মধ্যে হঠাৎ বাড়ি মারার একটা ব্যাপার আসে তাঁর লেখায়। কথাবার্তা নাই,এমন বাঁক নিবে কাহিনী,এর মজাতেই পাঠক শেষ পর্যন্ত ঝুলে থাকবে।
মাঝে মাঝে উনার জন্য খারাপই লাগতো। ভাল লাগুক না লাগুক, উনার লিখতেই হতো।প্রকাশক,পত্রিকার সম্পাদকদের চাপ। এই কারণে শেষের দিকে কি সব যে লিখসেন উনি,উনিই জানেন।
আগামী বইমেলায় হয়ত উনার কয়েকটা অপ্রকাশিত বই আর সমগ্র কিছু বিক্রি হবে। কিন্তু তারপর কি হবে?? বছরের সাথে বইমেলায় বিক্রির একটা গ্রাফ করলে বুঝা যাবে।তাঁর মৃত্যুতে সব চেয়ে বিমর্ষ নিশ্চই প্রকাশকরা। বিশেষ করে অন্যপ্রকাশ।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম যে উনার মৃত্যুতে আমি ব্যাক্তি হুমায়ুন আহমেদের জন্য কষ্ট পেলেও তাঁর রচনার জন্য কোনো হাহাকার অনুভব করিনি। এটার উদাহরণ দেয়া যায় এভাবেঃ সাকিব আল হাসান যখন অবসর নেয়ার অনেক পর বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবেন তখন আমি বেঁচে থাকলে যে কষ্ট পাব তার তুলনায় এখন হঠাৎ এখন আল্লাহ নাকরুন কোনো কারনে যদি তিনি মারা যান তাহলে যে কষ্ট পাবো তার কি কোনো তুলনা আছে? হুমায়ুন আহমদের ব্যাপারটাও আমার কাছে এরকম। নতুন কিছু পাচ্ছিলাম না উনার কাছ থেকে। সবই চর্বিত চর্বন। অবশ্য আমি জানি উনার সব চেয়ে ফালতু বইটার মত একটা বই লিখার স্বামর্থ্যও আমার নাই। যাই হোক, উনার বিদেহী আত্মার প্রতি এই বিদিগ্ধ পাঠকের শ্রদ্ধা। যত কিছুই বলি না কেন, শেষ মেশ তাঁর বই ই আমার অবসরের সঙ্গী হয়ে থাকবে,সারাজীবন।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ২:৩৪