বড় মাপের ধরা খেলাম; ইঁদুর কপালে হলে যা হয়! চাচা মিয়া টাইপের চেহারা দেখে ওনার সি.এন.জি.-তে উঠেছিলাম। কিন্তু এ চাচা যে মনে-প্রাণে টগবগে তরুণ তা আগে বুঝি নি। সি.এন.জি. চালাচ্ছে একদম প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্রের মত! সবকিছুকে ড্যামকেয়ার করে ছুটে চলেছে। আর গোবেচারা (গরুর চেয়েও অসহায় যে বেচারা) আমি অটোরিক্সার লোহার খাঁচায় বন্দী হয়ে একটানা স্রষ্টার নাম নিচ্ছি। হঠাৎ দুই পাশ থেকে দুই বাস এসে আমাদের ফেলে দিল মাইনকা চিপায়। আমার তো ঠ্যাং কাঁপাকাঁপি করে দিশাহারা! রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মান নির্ঘাত ৭ ছাড়িয়ে গেছে। দুইপাশ থেকে চাপাতে চাপাতে বাসগুলো যেন একদম সি.এন.জি.-র ভিতরেই ঢুকে যাবে! এমন চাপাচাপি দেখলে চাপের আবিষ্কর্তা প্যাসকেল সাহেবেরও চাপা ঝুলে যেত। আমি শুধু দুই হাত দিয়ে দুই ঠ্যাং-এর কাঁপুনি প্রতিরোধ করে চলেছি।
এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম মহামাণ্য স্পীড ব্রেকারের জন্য। ঢাকা শহরের স্পীড ব্রেকারের গুণাগুণ আশাকরি সবাই জানেন; এ বস্তু সময়কেও থামিয়ে দিতে পারে! সি.এন.জি.-র স্পীড কমে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার হল। তবে এ নির্মল শান্তির স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র কয়েক মিনিট! শুরু হল এ জার্নি থ্রু ফ্লাইওভার। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে চলার সময় মনে হল যেন এটা এক্ষুণি ফ্লাই করবে। বাতাসে ভেসে ভেসে কেমন যেন হেলেদুলে ছুটছে। কী বিপদে পড়লাম রে বাবা! ভেবেছিলাম বুড়ো মানুষ, মহিষের গাড়ির মত ঢুলতে ঢুলতে যাবে। কিন্তু চাচা তো মনে হয় নিজের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েই রাস্তায় নেমেছে। একটু নয়-ছয় হলে এই সি.এন.জি চালিত বাক্স যে কোথায় গিয়ে পড়বে তা গুগল-এ সার্চ দিয়েও পাওয়া সম্ভব না! গাড়ির জেল-হাজতের মত শিকগুলো জাপটে ধরে বসে আছি। সৌভাগ্যবশত: গাড়ি উড়ল না।
খানিক বাদেই ক্যাপ্টেন’স ওয়ার্ল্ড-এর সামনে গিয়ে আমাদের গাড়ি বাম দিকে এমন একটা মোড় নিল যে আমার পেটেও মোচড়ানি শুরু হল! এ দৃশ্য দেখলে ফর্মুলা ওয়ান রেসের প্রতিযোগীরাও বেলআউট (ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান থেকে প্যারাসুটের সাহায্যে অবতরণকে বেলআউট বলে) করার সিদ্ধান্ত নিত। একটু পর সিগন্যাল পড়াতে জানে পানি ফিরে পেলাম।
: চাচামিয়া, এই বয়সে গাড়ি চালাচ্ছেন কেন?
: পোলাগুলা খাওন নিয়া খোঁটা মারে। তাই আইজকা পুরান ট্যাক্সি দিয়া খ্যাপ মারতাছি। দম থাকতে ওগোর কাছে ফিরুম না। বাবা, মাইন্ড খাইয়েন না। চোখে কম দেহি বইল্যা চালাইতে একটু প্রোবলেমে ভুগতাছি।
এসব শুনে আমার মাথায় তো সিরিজ বর্তনীতে লাল বাত্তি জ্বলল! ওদিকে সিগন্যালে জ্বলল সবুজ বাতি। গাড়ির দৌড় আবার শুরু। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। ভাঙাচোরা রাস্তায় চলতে গিয়ে আমার টিবিয়া-ফিবুলা-ফ্যালাঞ্জেস হাড্ডিগুলোর নাট-বল্টু লুজ হয়ে খুলে যাওয়ার দশা। বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আকস্মাৎ এক পথচারীকে সামনে দিয়ে রাস্তা পার হতে দেখলাম। ড্রাইভার আঙ্কেল মারল হার্ড ব্রেক। মুহূর্তেই আমি পরিণত হলাম হিপজয়েন্টহীন একটি প্রাণীতে! ট্রাফিক জ্যামের কালো থাবা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই মামার বাসায় ছুটির দিনে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন শিরায়-উপশিরায়-ধমনীতে-কৈশিক জালিকায় উপলব্ধি করতে পারছি যে যানজট আমাদের দেশের জন্য কত্ত প্রয়োজনীয়। রাস্তায় জ্যাম না থাকলে বেপরোয়া চালকেরা গাড়ি-ঘোড়া সব জনগণের কাঁধের ওপর তুলে দিত!
শ্যামলীর কাছে এসে জ্যামে পড়লাম। অল্প বৃষ্টিতেই যানজটের উৎপত্তি। জ্যাম লেগেছে দুই দিক থেকে দুই বাস এসে কোলাকুলি করার কারণে। রাস্তায় ছোট-খাট গর্তে পানি জমে নদীমাতৃক দেশে আরো খাল-বিল-হাওড়ের উদ্ভব হয়েছে। এই জলপথে ম্যানহোলের ব্ল্যাকহোলে একটি রিক্সা আত্মবিসর্জন দিল। যানজটেও কী শান্তি আছে! গাড়ির মাথাটা ঢুকাতে পারলেই হল, বডি কিভাবে ঢুকবে সেটা ড্রাইভাররা ভাবে না। হঠাৎ জ্যাম থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের গাড়ি রীতিমত উড়তে শুরু করল! গাড়ি উড়ছে আর আমি জীবনে যত ধর্ম-কর্ম শিখেছি সেগুলো মনে করার চেষ্টা করছি। আচমকা সামনের এক গলির মুখ থেকে একটি রিক্সা বেরিয়ে এল। বুড়ো আঙ্কেল মারল মহাব্রেক। আমার নাক গিয়ে বাড়ি খেল খাঁচায়। রিক্সার পাইলট এমনভাবে তাকালো যেন দোষটা আমাদেরই! ইদানীং রিক্সাওয়ালারা রিক্সার ব্রেক মারতে চায় না, এতে মনে হয় তাদের প্রেস্টিজ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়! নাকের আকার-আকৃতি কতটুকু চেঞ্জ হল বাসায় গিয়ে চেক করতে হবে।
অবশেষে হোম, সুইট হোম। ভাড়া মিটিয়ে উঠেছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশেও সি.এন.জি.-র ডিটিজাল মিটারগুলো ঠিক হবে কিনা সন্দেহ। রুমে ঢুকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখছি। বেঁচে আছি! শুধু ছুটির দিনে না, এইভাবে প্রতিটা দিন বাসায় ফিরি আর মনে হয় আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরলাম। ধরেই নিয়েছি, বোনাস লাইফের ওপর চলছি। এই যুগ আসলে সুপারম্যান, ব্যাটম্যান অথবা স্পাইডারম্যানদের জন্য। আমাদের মত জেনারেল পাবলিক আতঙ্ক আর বোনাস লাইফের অঙ্ক কষে জীবন পার করছে।