এক ছোট ভাইয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। লেখাটা একটু বড়, আশা করছি আপনারা লেখাটি ধৈর্য্য নিয়ে পড়বেন এবং আপনাদের মতামত জানাবেন(অবশ্যই ভদ্রভাবে)। স্ট্যাটাসটা ছিলো এমন-
"আউটডোর এ রুগী দেখার সময় বাইরে অপেক্ষারত রোগীটি বলেন, "শালার ডাক্তার এত লেইট করে কেন? সকাল থেকে খাড়ায়ে আছি!" আর যিনি ভিতরে থাকেন তিনি বলেন, "আমাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনার ভাল করুক!!"
গালি আর দোয়া দুই মিলিয়ে খুব সুন্দর ব্যালেন্স হতে থাকে।"
রোগে-শোকে বা সামান্য অসুস্থতায় যে মানুষটির কাছে আমরা দিনের যেকোন সময় দৌড়ে যাই, সেই ডাক্তারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগের শেষ নেই। বলা বাহুল্য-এসব অভিযোগের বেশির ভাগ-ই অযৌক্তিক। আজকের লেখায় এসব অযৌক্তক অভিযোগগুলোকে খন্ডানোর কিছুমাত্র চেষ্টা করছি, আম-জনতার শুভবুদ্ধি উদয়ের লক্ষ্যে।
অভিযোগ-১ : "ছোটবেলায় তো খুব কইতা আর রচনা লিখতা- 'আমি বড় হয়ে ডা: হইব জনসেবা করিব & গরীবদিগকে বিনামূল্যে...ডট ডট...।" তা এখন টাকা চাও ক্যান?"
-খুবই গুরুতর এবং common একটা অভিযোগ। কিন্তু ডাক্তার হয়ে জনসেবা করার মানে তো এই না যে আপনাকে আমার বিনামুল্যে চিকিৎসা দিতে হবে। Every service has a cost..আপনি ৪-৫দিন অভুক্ত থাকার পর কোন হোটেল বা রেষ্টুরেন্টে গেলে কি আপনার অভুক্ত থাকার কষ্ট দেখে কেউ আপনাকে বিনামূল্যে খেতে দিবে? হোটেল বাদ, কোন দোকানে গিয়ে এক মুঠো চাল চাইলেও তো কেউ আপনাকে মাগনা দিবে না। এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ঐ অনাহারী লোকটি নিজেও এদের কারো কাছ থেকেই বিনামূল্যে কিছু পাবে বলে আশা রাখে না এবং তা নিয়ে তার কোন অভিযোগও নেই বা তাদেরকে সে কোন গালিও দিবেনা।
মানুষের পাচটি মৌলিক চাহিদা -অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা। ১ম চারটির মূল্যের ব্যাপারে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য না করলেও চিকিৎসা সবারই বিনামুল্যে বা নামমাত্র মুল্যে চাই। Who cares about the Doctors? আপনাদের আর সবার মতো ডাক্তারেরও যে একটা উদর আছে, সেই উদরে আপনাদের মতই ক্ষুধা লাগে, ক্ষুধা নিবারেনের জন্য তারও যে টাকা দিয়ে খাবার কিনতে হয় (কারন ডাক্তার বলে তো আর আসমানী খাবার খোদার তরফ থেকে নাজিল হয়না) কেন যেন এই অতি সাধারন ব্যাপারটা খুবই যত্ন সহকারে এবং সচেতনতার সাথে আপনারা ভুলে যান বা ভাবতেই চান না।
আর আপনি কি জানেন, অনেক ডাক্তার সপ্তাহের একদিন গরীব রোগীদের জন্য বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা দেন? অনেকে ২/৩ মাস পরপর নিজের গ্রামের বাড়িতে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করেন। অনেকে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে গরীব রোগিকে ঔষধ কিনে দেন। যেকোন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের থেকে বেশী রক্তদান করেন এবং অতিঅবশ্যই বিনামুল্যে। আমি জানি- এগুলো আপনারা জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না বা জানলেও কেউ যখন ডাক্তারকে গালি দেয় তখন চুপ করে বসে থাকেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্লজ্জের মতো গলা মেলান।
অভিযোগ-২ : ডাক্তার রোগি ধরার আগে প্যাথলজির স্লিপ ধরায় দিব এবং ৪০% কমিশন মারিবে।
-খুবই গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন-ডাক্তাররা কেন কোন নির্দিষ্ট টেস্টের জন্য নির্দিষ্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের কথা বলেন? ডায়াগনোসিস এর উপর চিকিৎসার অর্ধেক অংশ নির্ভর করে। আপনি ভালো ডাক্তারের কাছে গেলেন, কিন্তু ডায়াগনোস্টিক সেন্টার আপনাকে ভুল রিপোর্ট দিলো, আপনি কি ভালো হবেন? এটা কি আপনার ভিজিট নেওয়া ডাক্তারটির দোষ? কিন্তু সে হয়তো নির্দিষ্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে আপনাকে পাঠাচ্ছে, কারন তার পূর্ব অভিজ্ঞতা হয়তো বলে- এই সেন্টারের রিপোর্ট তুলনামূলকভাবে নির্ভুল। আপনারা সেটা একবারও চিন্তা করতে পারলেন না। আপনারা ভেবেই নিলেন, এই ব্যাটা শিওর কমিশন খায়।
আর ১০০ জন ডাক্তারের মধ্যে খুব বেশি হলে ৪/৫ জন অসাধু ডাক্তার রোগী না দেখেই বা কথা না শুনেই প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় টেষ্ট করতে দেয়। বাকি সব পেশার মতোই এখানেও একশ্রেনীর অসাধু মানুষ আছে এবং তারা এই MALPRACTICE করে থাকে, দু:খজনক হলেও সত্য। কিন্ত আমজনতা এব্যাপারটাকে Rationalize করে ফেলে এবং একজনের দোষে সব ডাক্তারকে একই চোখে দেখতে থাকে। কিন্তু একথা অবশ্যই আপনাদের মাথায় রাখতে হবে যে, প্রতিটা রোগ নির্ণয়ের জন্য কিছু টেষ্ট করা জরুরী, কারনটা আগেই বলেছি। ডাক্তার তো আর যাদু জানে না যে, আপনি গেলেন আর আপনার নূরানী চেহারাখানায় নূরের অভাব দেখেই বলে দিবে আপনার কি হয়েছে না হয়েছে। মস্তিষ্কের মধ্যে কার্যক্ষম হলুদ অংশ পরিমান মতো থাকলে এবং আয়োডিন স্বল্পতায় না ভুগলে ব্যাপারটা আপনাদের বোঝা উচিত। আর ৪০% এর ব্যাপারটা ডায়গনষ্টিক সেন্টার ডিল করে। ডাক্তারদের জন্য এটা তাদের এক প্রকার সম্মানী বিশেষ, কেউ কম দেয়, কেউ বেশি দেয়, কেউ দেয়ই না। তাই বলে উল্টা-পাল্টা টেষ্টের রিপোর্ট হয় এমন ডায়গনষ্টিক সেন্টার থেকে শুধুমাত্র ৪০% কমিশনের জন্য কোন ডাক্তারই( ঐ ৪/৫ জন বাদে) টেষ্ট করতে দেয়না কারন একজন ডাক্তারের কাছে রোগীর জীবন এবং ডাক্তার হিসেবে নিজের সুনাম অনেক বড় ঐ ৪০% কমিশন থেকে।
আপনারা হয়তো এখন বলবেন- "তাইলে স্কয়ার থেকে টেষ্ট করালে এ্যাপোলো তো মেনে নেয়না। এটা ঐখানকার ডাক্তারের ধান্দা।" ভাই থামেন, এটা হাসপাতালের বিজনেস পলিসি ছাড়া আর কিছুই না, এখানে ডাক্তারের কোন দোষ নাই। কারন ডাক্তার ঐখানে চাকরী করেন মাত্র। এবং কোথাও চাকরী করতে গেলে প্রতিষ্ঠানের পলিসি মেনে নিতে হয়(অনিচ্ছা সত্ত্বেও)। আর পলিসি তৈরী করে MBA পাশ করা হাসপাতাল পরিচালনা কমিটি, ডাক্তাররা না।
এখন আপনারা হয়ত বলবেন- "তাইলে পুলিশের সাথে ডাক্তারের কি পার্থক্য? পুলিশ ঘুষ খায় আর ডাক্তার কমিশন খায়।আমরা অসহায়।" ভাই, আবার থামেন, পুলিশ হয়ত ঘুষ না দিলে কাজ করবে না। কিন্তু ৪০% কমিশন না দিলেও ডাক্তার ঐসমস্ত ডায়গনষ্টিক সেন্টারে ঠিকই টেষ্ট করতে পাঠাবেন, যাদের রিপোর্টের উপর তার আস্থা আছে।
অভিযোগ-৩ : ৩২ টা কোম্পানীর সেইম অসুধ ঘুরায় ফিরায় দিবে
-একই কোম্পানীর সব ঔষধ দিলে তো আপনারাই আবার বলবেন- "হালায় ঐ কোম্পানীর কাছ থেইক্কা কমিশন খায়।" আর কোন কোম্পানীর ঔষধ দিবো না দিবো সেটা আমার ব্যাপার,আপনি সুস্থ হলেই তো হলো। যাই হোক, আমি আমারটুকু আগে বলি- বাংলাদেশে দুই শতাধিক ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানির ওষুধের দামও সমান না, গুণগত মানও সমান না। কোন কোন কোম্পানির হয়তো ওষুধ তৈরি করতে খরচ বেশি পড়ে। তাদের কাঁচামাল হয়তো ভালো। তাদের ওষুধের দামটাও তাই বেশি। আবার কোন কোন কোম্পানি হয়তো কাঁচামাল তেমন একটা দেয়না। তাদের ওষুধের দাম কম। দাম কম দেখে বাজারে চলে বেশি। কোন কোন কোম্পানি হয়তো কাঁচামাল ভালো দেয়, কিন্তু দাম রাখে তুলনামুলক কম। তারা লাভও করে কম, এরকম।
এখন ধরুন, আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে যদি জানি যে- এই কোম্পানির এই ওষুধটি তুলনামুলক ভালো, এবং আমি যদি সেটা প্রেস্ক্রাইব করি, তার মানে কি এই- যে আমি ওষুধ কোম্পানির কমিশন খাচ্ছি? আমি হয়তো অন্য আরেকটি ওষুধ অন্য আরেকটি কোম্পানির লিখছি- কারন সেটি ভালো। তাহলে তার মানে কি এই যে আমি দুই কোম্পানিরই কমিশন খাচ্ছি? আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে অবশ্যই চাইবো আমার রোগীটা যাতে ভালো ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে ওঠে। তাই নয় কি? কেউ কি তার নিজের রোগীর খারাপ চায়? আমরা কি আপনাদের শত্রু? আর একটা প্রেস্ক্রিপশনে কখনো একই ঔষধ দুই বা ততোধিক কোম্পানীর থাকে না, যদি থাকে তাহলে বুঝতে হবে আপনি কোন MBBS ডাক্তারের শরনাপন্ন হননি।
অভিযোগ-৪ : রেইট বেধে দিব ফি
-এটা আমার পারিশ্রমিক। বাজারে চাল,ডাল, তরকারীর বাজার দর যদি বেধে দেয়া থাকে, আপনার পরিহিত পোশাকের যদি একটি নির্দিষ্ট মূল্য থাকতে পারে, আপনি যেখানে বাস করেন সেখানে যদি প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে থাকতে হয়, আপনার শিক্ষার জন্য যদি একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ ব্যায় করতে হয় তাহলে আপনার জীবন বাচাতে বা সুস্থ করতে যিনি এগিয়ে আসেন, তাকে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হলো আমরা কম ঝামেলায়, কম খরচে সেবা চাই। অথচ আপনি, আমি, কেউই চিকিৎসার জন্য নতুন পাশ করা ডাক্তারদের কাছে যাই না। আমরা অসুখ হলে বিশেষজ্ঞ খুঁজি। বাংলাদেশে এই মুদ্রাস্ফীতির যুগে একজন বিশেষজ্ঞ এর পারিশ্রমিক বেশি না। অবাক হলেন? আবারো বলছি- বাংলাদেশে, এই মুদ্রাস্ফীতির যুগে একজন বিশেষজ্ঞের পারশ্রমিক আসলেই বেশি না। গত ১০ বছরে চালের দাম কতো বেড়েছে বলেন তো? ডালের দাম? নুনের দাম? তেলের দাম?
একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভিজিট কতো বেড়েছে?
ভিজিট বাড়ে নাই। এতো অল্প খরচে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৃথিবীর আর কোন দেশে পাবেন না। সারা পৃথিবী ঘুরে পরখ করে দেখতে পারেন। অথবা ঘরে বসেই গুগল করে খোঁজ নিতে পারেন। দাম বেড়েছে ওষুধের। হ্যা, দাম বেড়েছে ইনভেস্টিগেশনের। নিত্য নতুন টেকনোলজি আসছে ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে। এটা কিন্তু চিকিৎসকের দোষ নয়। এখন আপনি যদি ২ টাকা দিয়ে লেটেস্ট টেকনোলজি পেতে চান, তাহলে আপনার আসলে টেকনোলজি সম্পর্কে আরও বেশি আপডেটেড হওয়া প্রয়োজন।
তারপরেও বলি, ডাক্তারদের ভিজিট দিতে সমস্যা হলে সরকারি হাসপাতালে যান, ওখানে অনেক কম খরচে চিকিৎসা পাবেন।
অভিযোগ-৫ : সরকারী মেডিকেলে চাকরী নিয়া প্রাইভেট চেম্বার চালাইবে
-প্রতিটা সরকারী চাকরীর ন্যায় সরকারী হাসপাতালে কর্তব্যপালনকারী ডাক্তারদেরও একটা নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা আছে। সরকারী চাকরিজীবিদের অফিস যেমন সপ্তাহে ৫ দিন ৯টা-৫টা, তেমনি সরকারী হাসপাতালে কর্তব্যপালনকারী ডাক্তারদের কর্মঘন্টা সপ্তাহে ৬দিন ৯টা-২.৩০টা। এই সময়সীমার বাইরে সরকারী হাসপাতালে কর্তব্যপালনকারী ডাক্তার বাড়তি ইনকামের জন্য চেম্বার করলো না মেয়ে মানুষ নিয়ে ফূর্তিবাজী করলো তা দেখার দায়িত্ব আমার আপনার কারোর-ই নয়, কারন এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর সরকারী হাসপাতালে চাকরী করেন বলে উনি এমন কোথাও বন্ড সই দিয়ে আসেন নাই যে নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার বাইরে উনি চেম্বার করতে পারবেন না। আমার কথা বিশ্বাস না হলে উপরিউক্ত সময়ে আপনি DMC, SSMC বা যেকোন সরকারী হাসপাতালে খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। আর একদিন/দুইদিন ডাক্তার না পেলেই যে এরকম ঢালাও অভিযোগ করবেন, ব্যাপারটা এমনও না....আপনাকে দেখতে হবে উনি নিয়মিতই এরকম করছেন কিনা, কেবলমাত্র তখনই আপনি অভিযোগ করতে পারবেন,তার আগে নয়। উল্লেখ্য, ০.৫% ক্ষেত্রে আপনাদের এ অভিযোগ সত্য, কারন হাতের পাঁচ আঙ্গুল কখনই সমান হয়না।
অভিযোগ-৬ : সিজারিয়ান ছাড়া কোন বাচ্চা হইতেই দিবনা
-অভিযোগ অনেকাংশেই সঠিক। কিন্তু এখনো যদি আপনি সরকারী হাসপাতালগুলোতে খোজ নেন, তবে দেখবেন সিজারিয়ান থেকে নরমাল ডেলিভারিই বেশি হচ্ছে, তবে এ হার ৮০ বা ৯০ দশকের থেকে কম। এর পেছনে অতি মুনাফা লোভী ডাক্তার যেমন দায়ী,ঠিক তেমনি আমাদের আম-জনতাও কম দায়ী নয়। সমাজের একশ্রেনীর মানুষ, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মায়েরা সামাজিক অবস্থান বা প্রসব বেদনা সহ্য করতে না পারার কথা চিন্তা করে আগে থেকেই ঠিক করে রাখেন যে তারা সিজারিয়ান করাবেন। ডাক্তারও এখানে ঝামেলা এড়াবার জন্য তাদের কথায় রাজী হয়ে যান। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে একচোখা ভাবে শুধুমাত্র ডাক্তারকে দোষারোপ করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি।
অভিযোগ-৭ : ডাক্তার গ্রামে থাকতে/যেতে চায় না
-যেকোন চিকিৎসকেরই স্বপ্ন থাকে বড় একজন চিকিৎসক হবার। স্বপ্ন দেখার মাঝে তেমন কোন পাপ নেই। স্বপ্ন সবাই দেখে। হয়তো আপনিও কোন না কোন কিছুর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচেন। স্বপ্ন দেখা তখনই পাপ, যখন সেটাকে পাওয়ার জন্য অন্যায়ভাবে চেষ্টা করা হয়।
আমাদের মন্ত্রী বলেছেন- দুই বছর বিসিএস ডাক্তারদের গ্রামে থাকতেই হবে। (এখন মাঝে মাঝে অবলীলায় ৩ বছরও বলেন।) আর আপনারাও হুংকার ছাড়েন- শালারা গ্রামেই যেতে চায় না।
আমি ভদ্রলোকের সন্তান। ধরে নিলাম, এটা জেন্টেলম্যান্স এগ্রিমেন্ট। আমি গুনে গুনে দুই বছর (তার মানে- ৩৬৫ দিন+ ৩৬৫ দিন= ৭৩০ দিন) গ্রামে থাকবো। কিন্তু মন্ত্রী সাহেব, আপনিও কথা দিয়েছিলেন- আপনি দুই বছর শেষ হওয়া মাত্রই আমাকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিবেন। আপনার সেই কথা মনে থাকে না। যারা যায়, তারা আর ফিরে আসে না। দুই বছর কেন, চার বছর চলে যায়, দশ বছর চলে যায়। তারা তো আর ফিরতে পারে না উচ্চ শিক্ষার জন্য।
মন্ত্রী সাহেব, এই আপনার জেন্টেলম্যান্স এগ্রিমেন্ট? হু ইজ প্লেয়িং ডার্টি হিয়ার?
আপনি আমার বন্ড সই নিবেন? আমি দিবো। কিন্তু আপনারও বন্ড সই দিতে হবে, যে দুই বছর হওয়া মাত্রই আমাকে ট্রেনিং পোস্ট দিবেন। রাজী? যদি রাজী না হন, তাহলে আপনারও কোন অধিকার নেই হুংকার ছাড়ার। আপনি একজন মানুষকে দুই বছরের জায়গায় ৫ বছর গ্রামে রাখার চেষ্টা করলেও সেও তো একই ভাবে দুই বছরের জায়গায় এক বছরে ফিরে আসার চেষ্টা করবে। দুইজনের দাঁড়িপাল্লাই তো তখন সমান ভারী!
আপনার বিসিএস এর কি সুযোগ সুবিধা? কতো টাকা পারিশ্রমিক দেন একজন চিকিৎসককে? ১৭৩১০ টাকা।
ঢাকায় থেকে যে কোন বেসরকারি হাসপাতালে আবেদন করলে চাকরী মিলবে। ওরা বেতন দেয় কতো? ১৮০০০-২০০০০ টাকা।
তাহলে আমার গ্রামে যাওয়ার পিছে যুক্তিটা কি?
গ্রামে গেলে সেই দুই বছর/তিন বছর/ চার বছর/ অনির্দিষ্ট বছর আমি ট্রেনিং করতে পারবো উচ্চশিক্ষার? না।
বেসরকারি চাকরী নিলে আমি কি তার সাথে সাথেই উচ্চশিক্ষার ট্রেনিং নিতে পারবো? হ্যা।
তাহলে আমার গ্রামে যাওয়ার যুক্তিটা কি?
তবু চিকিৎসকরা সরকারী চাকরী নেয়। বিসিএসে। তারপর গ্রামে যায়। বেসরকারি চাকরীর তুলনায় তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই, তেমন আহামরি কোন বেতনও না। অথচ অস্ট্রেলিয়ার মতো জায়গায়, যে যতো গ্রামের দিকে যায়, তার পারিশ্রমিক ততো বেশী। শহরের তুলনায় দ্বিগুণ, তিনগুন। কারন, তারা গ্রামে যাচ্ছে কষ্ট করে, তাদের সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আমাদের দেশে এরকম কোন ব্যাবস্থা নাই। তাহলে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে মেয়েগুলি গ্রামে যেয়ে কেন পড়ে থাকবে? চিরকাল অবিশেষজ্ঞ থাকার জন্য? নাকি তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গ্রামের পাঠশালায় মানুষ করার জন্য?
আমরা তবু যাই। কেন, জানেন? একটু সম্মানের জন্য। একটা সরকারী চাকরীর সম্মান। আর কিছু না।
আর আপনারা কি না আজ আমাদের মারছেন।
অভিযোগ-৮ : নিজে অসুস্থ হইলে এদেশের হাসপাতাল অথবা কলিগ ডা: থেকে সেবা না নিয়া বিদেশ গমন করিবে চিকিৎসা নিতে
- একদম মরনাপন্ন বা শেষ চেষ্টা হিসাবে বিদেশ গমন, এই ক্ষেত্রেই কেবল আমি ডাক্তারদের বিদেশে যেতে দেখেছি ,অন্যথায় নয়। কারন তারা এদেশের চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর যথেষ্ট আস্থাবান। উচ্চবিত্ত, রাজনীতিবিদ বা কাচা পয়সার মালিকেরাই কেবল হাচি দিলেই দাদাদের দেশ বা মাউন্টএলিজাবেথে গিয়ে দেশের ডাক্তারদের দূর্নাম করে। আমাদের দেশে মুলত: দুই শ্রেণীর মানুষ খুব ভালো চিকিৎসা পায়। এক- খুব উচ্চশিক্ষিত, ডাক্তার যা বলে তাই করে। দুই- অশিক্ষিত গরীব রোগী। ডাক্তার যা বলে তাই করে। ডাক্তার ছাড়া সাহায্য করার মতো যার কেউ নাই।
এখন আপনারা বলতে পারেন, ডাক্তাররা এভাবে বুঝিয়ে কখনো কিছু বলে নি। হ্যা, দোষটা কিছুটা আমাদেরও বটে। আমরা সেভাবে কাউন্সেলিং করি না রোগীদের সাথে, যেটা চিকিৎসার সবচেয়ে বড় অংশ। কাউন্সেলিংয়ে ভালো করা আমাদের জন্য এখন খুব জরুরী।
পরিশেষে বলতে চাই,আমরা সমস্যা নিয়ে অনেক উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করি, সাংবাদিকরা সরকারী হাসপাতালের ভুল ধরার জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে, কিন্তু আমরা কখনো মূল সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারি না। এতো এতো মিডিয়া, এতো এতো সংবাদপত্র, কই- কোথাও তো রোগীদের সেরে ওঠার কোন খবর নেই তেমন। পত্রিকায় কয়টা ব্যাবসা করা, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ক্লিনিকের কথা লেখা হয়? পত্রিকায় তো দেখি- ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু। অথচ একটা চিকিৎসা ভুল নাকি সঠিক, এটা চিন্তা করতেও ৩-৪ জন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। পৃথিবীর দুর্বার সব রহস্যেদের মধ্যে জীবন-মৃত্যু রহস্য চিরকালই অধরা। আমরা শুধুমাত্র ঈশ্বরের ভৃত্য হয়ে চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু আমরা আমাদের শরীর থেকে মানুষের ছাঁচটা টেনে খুলে ফেলতে পারি না। আমাদের ঐশ্বরিক কিছু করার কোন ক্ষমতা নেই। আমার রোগী মারা গেলে, আমারও খারাপ লাগে। আমাকে পাথর দিয়ে বানানো হয় নি। আমিও ভাই আপনার মতো একজন মানুষ, মাটি দিয়ে তৈরি।
যতো যাই বলি না কেন, যতো যাই করি, যতো শক্ত কথাই বলি না কেন -আপনাদের জন্য আমার খারাপই লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ রাত ১:১৬