পরবাসে ঈদ আনন্দ (৫ম অধ্যায়)
আফ্রিকার পাহাড়ী অরণ্য মনে করিয়ে দেয় নিজ দেশের পার্বত্য চট্রগ্রামের অরণ্যর কথা । আফ্রিকার মাইলের পর মাইল বিস্তৃত বিশাল এই অরণ্য যেন এক অচেনা জগৎ। এই একুশ শতকের বিশ্বে ভাবতে অবাক লাগে এই অরন্যে এখন ও এমন গোত্র আছে যারা মানুষের মাংশ খেতে পছন্দ করে অর্থাৎ সোজা বাংলায় নরখাদক । এই গোত্রটি লেংদু নামে পরিচিত। বিগত গৃহযুদ্ধে এই গোত্রটি নৃশংসতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
আফ্রিকার কংগোর এই গভীর অরন্য আর পাহাড়ে পৃথিবীর দুর্লভ MOUNTAIN গরিলাদের বসবাস। ।গরিলার কথা যখন এসেই গেল তখন এদের সম্পর্কে একটা কথা না বললেই না। এরা সাধারনত শান্তিপ্রিয় তবে শত্রুকে ভয় দেখাবার জন্য এরা বুকে জোরে জোরে আঘাত করে ঢাকের মত শব্দ করে ,এরা দলের নেতার প্রতি ভীষন অনুগত এবং দলের নেতা দলকে নেতৃত্ব দেয় ,বিভিন্ন বিপদ আপদে দলকে রক্ষা করে। বর্তমানে এই গরিলার সংখ্যা খুব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে অবৈধ শিকারীদের কারনে।ন্যশনাল জিয়োগ্রাফি , বন্যপ্রানী সংরক্ষনের জন্য কিছু সংস্হা এখানে দূর্গম পরিবেশে কাজ করে যাচ্ছে এই গরিলাদের রক্ষায়।
আফ্রিকার অরণ্য মনে করিয়ে দেয় এগডার রাইজ বারোজের সেই কালজয়ী উপন্যাস টারজানের কথা যার পটভূমিকা এই কংগোর বনকে ঘিরে রচিত হয়েছিল।বনের ভেতরে বিশাল বড় বড় গাছ আর সেগুলোর ডাল থেকে নেমে আসা বিশাল লতানো ঝুরি দেখে মনে হয় এই বুঝি কৈশোরে দেখা টারজান রুপী জনি ওয়েসমুলারকে দেখবো সেই রক্ত হিমকরা আওয়াজে লতানো ঝুরি বেয়ে কোন এক বিশাল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসবে শত্রুকে বধ করার জন্য । অরণ্যর পাশ দিয়ে বয়ে চলা কংগো নদীর গভীর কালো জলে আরো এক ভয়ংকর বিপদ সে হল কুমীরের বাস। এ প্রসংগে একটি গল্প আমি শুনলাম আমার দোভাষী জর্জ মোবোয়ুর কাছ থেকে।
আমাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কংগো নদী থেকে এক বিশাল আকৃতির কুমির নাকি এখানে আমার আসার কয়েকদিন আগে নদী থেকে উঠে এসে নদীর পাড়ে ঝোপঝাড়ের ভেতরে চুপচাপ শুয়ে ছিলো ২/১ দিন ধরে । দূর থেকে লোকজন দেখে মনে করেছিলো পানিতে ভেসে কোন বিশাল আকৃতির গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে সেখানে। একদিন সকালে স্থানীয় এক ব্যক্তি প্রাতঃকৃত্য সারতে যেই নদীর পাড়ে যায় সেই কুমির সুযোগ বুঝে তার পা কামড়ে চেষ্টা করে নদীর জলে টেনে আনতে। সেই ব্যক্তির চীৎকারে আশেপাশের লোকজন এসে কোনক্রমে ঐ ব্যাক্তিকে কুমিরের হাত থেকে রক্ষা করে আর সেই বিশাল আকৃতির কুমির কে সকলে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
আফ্রিকার নদীতে এরা ক্যানু (আফ্রিকান পল্লীর মানুষদের ব্যবহৃত গাছের গুড়ির খোল কেটে তৈরী এক ধরনের সরু ডিঙি নৌকা) ব্যবহার করে । যদিও ক্যানু শব্দটার সাথে আমরা সবাই কমবেশী পরিচিত সেবা প্রকাশনীর টারজান বা অভিযান কাহিনীর সুবাদে । কিন্ত এখানে এসে আমার প্রথম পরিচয় হলো চাক্ষুসভাবে এই ক্যানুর সাথে । এরা অত্যন্ত নিপুনভাবে বিশাল বিশাল সব গাছ কেটে তার কান্ড চেঁছে খোল তৈরী করে নৌকা তৈরী করে, এগুলোকেই তারা ক্যানু বলে । এখানকার স্থানীয়দের যাতায়াতের জন্য এই ক্যানু বেশ সস্তা, সময়সাশ্রয়ী এবং বেশ উপযোগী একটি নৌযান। কংগোতে অধিকাংশ এলাকায় কোন উন্নতমানের সড়ক ব্যবস্থা নেই এবং কংগো নদী ছাড়া অধিকাংশ এলাকায় নেই তেমন কোন উল্লেখযোগ্য নদী । ফলে দূরবর্তী কোন স্হানে বিশেষ করে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাওয়ার একমাত্র আকাশপথই সম্বল । আকাশপথ ব্যয়বহুল হওয়ায় সেটিও কেবলমাত্র অবস্থাপন্ন ব্যক্তি ছাড়া সকলের পক্ষে সম্ভব নয় ব্যবহার করার । এই বিষয়ে একজন স্থানীয় ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে উত্তরে বলেছিলো জেনারেল মুবুতু তার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কংগোর প্রদেশগুলো একতাবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য এই স্বৈরচারী শাসক জেনারেল মুবুতু শুধু রাজধানী কিনশাসা আর গুটিকয়েক এলাকা ছাড়া বাকী সব প্রদেশগুলোর জন্য কোন আন্তঃযোগাযোগ সড়ক ব্যবস্থা তৈরী করেননি । আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে কংগোর সাধারন জনগনকে এই দূর্দশা বহন করতে হয়েছে ।
ছবি:জেনারেল মুবুতু
এখানকার লোকদের বেশীরভাগের ধর্ম খ্রীস্টান ক্যাথলিক কিছু আছে মুসলমান তবে ১০% থেকে ১৫% এর বেশি হবেনা । আমি যেই প্রদেশ ছিলাম অর্থাৎ বান্দাকা প্রদেশেও একই রকম অনুপাতের খ্রিষ্টান এবং মুসলমানদের বাস । তবে ইদানীংকালে এই এলাকায় বেশ কিছু মুসলিমের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে । এই কংগোতে লোকমুখে জানা যায় সর্বপ্রথম সাদা চামড়ার লোক হিসেবে ডিয়াগো কাউ নামে পর্তুগীজ এক ব্যক্তি আনুমানিক ১৪৮২ খ্রীষ্টাব্দে কংগোতে প্রথম অভিযান পরিচালনা করে । তার অভিযানে পর থেকে কংগোতে শুরু হয় খ্রীষ্টান ধর্মের প্রসারণ তবে সেটা বিস্তৃত লাভ করে ব্যাপকভাবে ১৮ শতকের দিকে ভ্যান কুভার নামে এক শ্বেতাংগ বেলজিয়াম মিশনারী আগমন করার পর থেকে । তার সাথে আগত মিশনারী দল এখানে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচার করা শুরু করে এবং সেই সময় রাজা ২য় লিওপোল্ডের আমলে ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে কংগো পরিনত হয় প্রথমে রাজা ২য় লিওপোল্ডের ব্যক্তিগত সম্পদের অংশ হিসেবে পরে ১৯০৮ সালে একটা পুতুল প্রশাসন তৈরী করে মুলত শাসন ক্ষমতা বেলজিয়ামের হাতে রেখে কংগো পরিনত হ্য় কলোনীতে । সেসময় হতে ১৯৬০ পর্যন্ত বেলজিয়ামের কলোনী হিসেবে কংগো শাসিত ও শোষিত হয়ে এসেছে ।
ছবি: রাজা ২য় লিওপোল্ড
অবশেষে ১৯৬০ সালে প্যাট্রিক লুবুম্বার নেতৃত্বে কংগো উপনেবেশিক শাসন হতে মুক্তি লাভ করে কিন্ত পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে তারই নির্বাচিত সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মুবুতু দ্বারা তিনি উৎখাত ও নিহত হন। এরপর কংগোর নামকরন করা হয় জায়ার এবং সুদীর্ঘ ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মুবুতু আমেরিকার ছত্রছায়ায় একনায়ক ও স্বৈরচারী শাসনের মাধ্যমে দেশ কে শোষন করেন । অবশেষে ১৯৯৭ সালে লরেন্ট কাবিলা এক অভ্যুথানের মাধ্যমে তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে পুনরায় এর নামকরণ করেন গনপ্রজাতন্ত্রী কংগো নামে । কিন্ত ২০০১ সালে আততায়ীর নিকট এই নেতা নিহত হলে তার ছেলে জোসেফ কাবিলা হন দেশের প্রেসিডেন্ট এবং গৃহযুদ্ধের কারণে পরবর্তীতে আবার ২০০৬ এ জাতিসংঘের তত্বাবধায়নে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি পুনরায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ।
ছবি: বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা
বেলজিয়ামের কলোনী হিসেবে কংগো যখন তার যাত্রা শুরু করে সেসময় থেকেই বেলজিয়াম খুব চাতুর্যের সাথে এই কংগোর জনসাধারনের মনকে শাসন আর শোষনের থেকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখার জন্য এদের হাতে তুলে দেয়া হল বিয়ার আর প্রাথর্না সংগীতের মাধ্যমে এদের প্রথমে ধর্মীয়ভাবে মগজ ধোলাই করে স্বস্তা আর সহজলভ্য বিয়ারের মাধ্যমে নেশায় বুঁদ করা হল । পরবর্তীতে প্রাথর্না সংগীত এর স্থানে জায়গা দখল করল উদ্দাম মিউজিক আর যথেচ্ছার যৌনভ্যাস । এই ভাবে একটি জাতিকে যুগ যুগ ধরে নেশায় বুঁদ করার জন্য প্রায় প্রতিটি প্রদেশে তৈরী করা হয়েছে বিয়ারের ফ্যাক্টরী । এই ফ্যাক্টরীগুলোতে উৎপাদিত বিয়ারের মূল্য পানি থেকে অনেক স্বস্তা আর সহজলভ্য । এই বিষয়টি আমি বান্দাকায় অবস্থানকালে সরেজমিনে পর্যবেক্ষন করে দেখতে পাই যে স্থানীয় বাজারে অথবা এলাকায় পরিষ্কার সুপেয় পানির একেতো অভাব আর যেসকল পানির বোতল মার্কেটে পাওয়া যেত তার থেকে বিয়ারের ক্যানের মূল্য অনেক স্বস্তা । আর সে কারনেই এই কংগোর সহজসরল অধিবাসীদের স্বস্তা বিয়ারের নেশায় বুঁদ করে রেখে খুব সহজেই যুগ যুগ ধরে শাসন এর চেয়ে বেশী শোষন করে আসছিলো এই বেলজিয়ানরা ।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশসমূহ একসময় ব্রিটিশ, ফরাসী আর বেলজিয়ামের উপনেবেশিক রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়ে আসছিলো বিশেষ করে ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত । এর মধ্যে ঔপেনিবেশিক শাসক হিসেবে ব্রিটিশরাই অন্য শাসকদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাল ছিলো । কারন দেখা গেছে যে সকল দেশে ব্রিটিশরা রাজত্ব করেছিলো তারা তাদের রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য স্থানীয়দের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছিলো । এমনকি প্রশাসনকে পরিচালনার জন্য তারা মধ্যম স্তর পর্যন্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের তারা স্থানীয়দের মাঝ থেকে নিয়োগ করেছিলো । কিন্ত অপরদিকে ফ্রেন্চ বা ফরাসী এবং বেলজিয়াম শাসকরা কখনোই ব্রিটিশদের মত এতটা উদার ছিলোনা তারা যেটা করেছিলো তারই প্রতিচ্ছবি দেখা যায় আফ্রিকার এই কংগোতে । যদিও অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে এই কংগো যখন একের পর এক রক্তের সাগর অতিক্রম করে আজকের এই বর্তমানে এক অশান্ত পরিস্হিতিতে দাড়িয়ে অপেক্ষায় আছে এক স্হিতিশীল দেশে পরিনত হওয়ার জন্য । অথচ তখনও পর্দার অন্তরাল থেকে একদিকে যেমন পশ্চিমাবিশ্বের লোভাতুর দৃষ্টি অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ উগান্ডা , রুয়ান্ডার শেন্যদৃষ্টি এই কংগোর মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের উপর এখনও মূর্তিমান আতন্কের ন্যায় এই দেশকে অস্হির করে রেখেছে। প্রতিনিয়ত এখানকার রাজনীতিতে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছে অদৃশ্য শত্রুর দল। এক মূর্তিমান অভিশাপের এই গৃহযু্দ্ধ যেন জগদ্দল পাথরের ন্যায় সাধারন কংগোলিজদের বুকে চেপে বসে আছে ।
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১২:৪৬