ইউএনের এই শান্তিরক্ষা মিশনটি কংগোতে মোনুক ( MONUC) নামে পরিচিত। এই মোনুকের আওতায় সম্পূর্ন কংগো দেশটি মোট ছয়টি সেক্টরে বিভক্ত যেমন, বান্দাকা, কিসাংগানী, কানাংগা, কালিমি , কিন্দু ,বুনিয়া এবং মোনুক তথা ইউএনের মূল সদর দপ্তর ছিলো রাজধানী শহর কিনশাসাতে। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল আফ্রিকা মহাদেশে মূলত দুটি দেশের নাম কংগো তবে পার্থক্য হচ্ছে আমি যেই কংগোর কথা বলছি সেটি আকারে বিশাল প্রায় ভারতবর্ষের সমান আর তার সম্পূর্ন নাম হচ্ছে ডেমোক্রটিক রিপাবলিক অব কংগো সংক্ষেপে এই দেশকে কনংগো ( ডি আর সি) বলে আর এর রাজধানীর নাম কিনশাসা । এই কংগো (ডিআরসি) পাশে আরেকটি দেশ সেই দেশের ও নাম কংগো তবে আকারে বেশ ছোট এবং এই দেশের রাজধানী নাম ব্রাজাভিল।এবং এই ব্রাজাভিল শহরটি কংগো (ডিআরসি) এর রাজধানী কিনশাসার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কংগো নদীর ঠিক অপর পাশেই অবস্থিত।
বান্দাকা শহরের মধ্যে এই ইউএনের দোতালা কম্প্লেক্সটি বেশ আকারে বড় । এই অফিসে আছে ইউএনের বেশ কটি অফিস যেমন ইলেক্টোরাল অফিস, কমিউনিকেশন অফিস, সাপ্লাই অফিস, আইটি অফিস এছাড়া দোতালায় আছে আমাদের মিলিটারী পুলিশের অফিস আর আমাদের পাশেই আছে মিলিটারি অবজারভারদের অফিস। একই ফ্লোরে আছে সিকিউরিটি অফিস , সিভিল পুলিশ অফিস এবং স্থানীয় জনসাধারনের জন্য আছে ইউএন এর একটি নিজস্ব লোকাল রেডিও স্টেশন। এই ইউএনের অফিস বিল্ডিংটি আমার কাছে যেন সপ্তম আশ্চর্যের একটি । এই ক্ষুদ্র পরিসরে পৃথিবীর প্রায় ৫০ টির অধিক দেশের মানুষরা এক সাথে কাজ করছে। যাদের ভাষা, আচার আচরন, চলাফেরা খাবারের মাঝে অনেক বৈচিত্র্য । সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে যে কোন ফোরাম যেন এক একটি জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনের একটি ক্ষুদ্র রেপ্লিকা বলে মনে হত আমার কাছে। আমাদের এই ইউএনের অফিসে একই ছাদের নীচে বিভিন্ন দেশের সামরিক পোশাক পরিহিত ব্যাক্তিরা কাজ করত আবার বৈচিত্রময় বিভিন্ন পোশাকে অনেক বেসামরিক ব্যাক্তিরাও কাজ করত । বিষয়টি দেখতে যেমন ভাল লাগত তারচেয়ে বেশী ভাল লাগত আমাদের সবাইকে একই লক্ষ্যে কাজ করার মনোভাব আর এই সুন্দর কাজ করার পরিবেশ দেখে। অফিসের পেছনে ছিলো বিশাল আকৃতির একটি ব্যাঙ ছাতার মত ভিস্যাট যার নীচে প্রায়ই দেখা মিলত পাগড়ি আর শ্রশ্মুমন্ডিত ইন্ডিয়ার সিং জীর সাথে উনি একজন শিখ ছিলেন । তারচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন অতন্ত্য ভাল মানুষ ছিলেন, তার সাথে ছায়ার মত আরেকজন সহকারী ছিলো রমেশ যোশী। তাদের দুজনকে সবসময় দেখতাম একসাথে যে কোন কাজ করতে।
কম্পিউটার সম্পর্কিত যে কোন সমস্যা হলে ছুটে যেতাম আইটি ডিপার্টমেন্টের ইউএন স্টাফ ইন্ডিয়ার শেখ রিয়াজ আর পাকিস্তানের রেজওয়ান ভাই এর কাছে । তাদের কে দেখে প্রায় মজা করে বলতাম তোমাদের দেখে কিছু শিক্ষা নেয়া উচিত তোমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের, একই ঘরে কি সুন্দর ভারত আর পাকিস্থানের সহবস্থান। ইলেক্টোরাল সেক্টরে ছিলো মেক্সিকান সুন্দরী এ্যানা যে কিনা প্রায়ই আমার অফিসে এসে অফিসে রাখা কফিমেকারে কফি বানিয়ে এক কাপ নিজে আরেক কাপ আমার জন্য তৈরী করে লান্চ আওয়ারে অথবা কাজের অবসরে ৫/১০ মিনিটের আড্ডা দিত। মনে পড়ে আমাদের অফিসের ইউএনের প্রধান হেড অব অফিস , ভদ্রলোক ছিলেন সেনেগালের বাসিন্দা । তিনি ছিলেন এমন কালো মনে হত তার গায়ে যেন চকেচকে তেল মাখানো রয়েছে। অথচ দেখা হলে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরতেন আর হ্যান্ডশেক করতেন খুব ভাল লাগতো। নীচের তলায় ছিলো আমাদের এফ ও এম বা ফিল্ড অপারেটিং ম্যানেজার ইমাদ আযমী যে কিনা ছিলো আফ্রিকান আর ইউরোপের এক সেতুবন্ধন। ইমাদের মা ছিলেন সুইস আর বাবা ছিলেন মরক্কোর নাগরিক। যদিও ইমাদের বেশীরভাগ ছাপই হচ্ছে ইউরোপের সাথে সামন্জস্যপূর্ন। ইমাদ আযমী ছিলেন একহারা গড়নের চোয়ালভাংগা একজন শ্বেতাংগ যার গালভরা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পূর্ন। তবে সবসময় তাকে দেখা যেত অফুরন্ত প্রানশক্তিতে ব্যস্ত একজন ফিল্ড অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে। তার অবস্থান ছিলো হেড অব অফিসের পরেই । এই ইউএনের সকল কার্যক্রম মূলত তার সরাসরি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালিত হত। যেকোন বিষয়ে তিনি হচ্ছেন হেড অব অফিসের দক্ষিন হস্তের ন্যায়। এছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিনের সকালে সেন্ট্রাল বিফ্রিং তার সভাপতিত্বে পরিচালিত হত। এই বিফ্রিং এ মুলত প্রতি সেকশনের চীফ যারা তারা তাদের প্রতিদিনকার কাজের পরিকল্পনা এবং যে সকল কাজ ইতিমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ননা দিতে হত। এছাড়া যেকোন জরূরী পরিস্থিতিতে তিনি মিটিং কল করলে আমাদের সেই মিটিং এ অংশ নিতে হত।
একেকটি সেকশনের যিনি সিনিয়র তাকে এখানে স্থানীয়রা চীফ বলে সম্বোধন করত। আর একেকটি সেকশনের চীফ ছিলো একেক দেশের যার ফলে আমাদের সেন্ট্রাল ব্রীফিং হত বেশ মজার আর দেখার মত একটি পরিবেশ। আমাদের ইউএনের পরিবেশে মূলত আমরা সকলেই ইংরেজীতে কথা বলে থাকি । তবে এখানকার বান্দাকার রিজিওন হেডকোর্য়াটারে আবার বেশীরভাগ ফ্রেন্চভাষীদের সংখ্যা বেশী থাকায় আমরা কজন বাদে বাকীরা নিজেদের মধ্যে ফ্রেন্চ ভাষায় কথা বলত। এই কারনে সেন্ট্রাল ব্রিফিং এ সবসময় আমরা দু একজন বাদে সকলেই তাদের ব্রিফিং ফ্রেন্চ ভাষায় দিত আর একজন আমাদের জন্য তার সারসংক্ষেপ ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিত। একবার সেন্ট্রাল ব্রিফিং এ কোন একটি বিষয় নিয়ে ফ্রেন্চভাষীদের মধ্যে তাদের নিজস্ব ভাষায় মানে ফ্রেন্চে আলোচনা চলছিলো এবং বিষয়টা সম্ভবত কোন হাসির ছিলো, আর সেকারনেই দেখলাম সবাই কিছুক্ষন পর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আমরা যারা ইংরেজভাষী তারা কোন কিছু না বুঝে সবাই বোকার মত তাদের সাথেও হাসিতে ফেটে পড়লাম কারন হাসি যে সংক্রামক ব্যাধি । আমাদের কিছুক্ষন পর মনে হল আমরা যারা ইংরেজভাষী তারাই শুধু হাসছি আর বাকী ফ্রেন্চভাষী তারা হাসি বন্ধ করে আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমরা হাসি বন্ধ করে কারন জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় আমরা কিভাবে ফ্রেন্চ ভাষায় হাসির বিষয়টা বুঝতে পারলাম। কারন তারা আমাদের হাসি দেখে ধরেই নিয়েছে আমরা বিষয়টা বুঝেই হেসেছি। পরে আমাদের না বুঝে হাসার বিষয়টা তাদের ব্যাখ্যা করে বলার পর তারা আবার হাসতে শুরু করলো আমরা তখন বোকার মত হাসতে শুরু করলাম। অবশেষে আমরা শেষ এবং তৃতীয়বারের মত হাসলাম যখন বিষয়টা আমাদের ইংরেজীতে অনুবাদ করে বলা হল।
এইভাবে আমাদের দিনগুলি কেটে যেত পরিবার ছেড়ে, দেশ ছেড়ে সেই আফ্রিকার কংগোর বান্দাকা শহরের ইউএনের অফিস করিডোরে আর ব্যস্ততার মাঝে। আমরা যারা বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে বান্দাকা শহরের ইউএন অফিসে কাজ করতাম তাদের কে নিজ নিজ কাজের প্রয়োজনে বের হতে হত শহরের বিভিন্ন অংশে অথবা শহর ছেড়ে দূরের প্রত্যন্ত অন্চলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে। বিশেষ করে ইউএনের মিলিটারী অবজারভার বা সামরিক পর্যবেক্ষকদের কাজ ছিলো মূলত ইউএনের তত্ত্বাবধায়নে শান্তিপ্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে বিভিন্ন গেরিলা দলের অস্ত্রবিরতি কার্যকর করা । তাদের অস্ত্র জমা নেয়া এবং তাদের পুর্নবাসনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া । এই বিষয়গুলি ইউএনের বিভন্ন সংস্থার সম্বন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে বিষয়গুলি কার্যকর করা হয়ে থাকে। যদিও বর্ননার সাথে বাস্তবতার বেশ ফারাক থাকে বিশেষ করে প্রায়শই দেখা যায় গেরিলা দলগুলির একে অপরের প্রতি যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠা অবিশ্বাস আর সন্দেহের কারনে বিষয়গুলি কার্যকর করা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা অনেক সময় বেশ দূরুহ হয়ে পড়ে। এবং এই ক্ষেত্রে দেখা যায় আপোষকারী হিসেবে ইউএনের সামরিক অথবা বেসামরিক কর্মীরা হয় আপোষরফা করতে গিয়ে কখনো নিজেরাই নিহত অথবা আহত আবার কখনওবা হতে হয় কিডন্যাপড মোটা মুক্তিপণের জন্য। আর এইসব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যেতে হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে । আর এইভাবে প্রতিনিয়ত হাসি আর আনন্দ ভাগাভাগি করে সূদুর আফ্রিকার কংগোতে কেটে যায় আমাদের শান্তিরক্ষী আর ইউএন কর্মীদের জীবন।
ইউএনের জীবন আসলেই বৈচিত্র্যময় একেকটি সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের সন্ধ্যায় আমাদের ইউএনের নীচতলায় ক্যাফেটেরিয়ায় হত হ্যাপী আওয়ার নামে একটি গেট টু গেদার টাইপ অনুষ্ঠান।এখানে মূলত কয়েকঘন্টা আমরা সবাই ইউএনের সেকশনের চীফরা সাথে অন্যান্য স্টাফরা এবং লোকাল ইউএনের স্টাফরা এসে জড়ো হত । কখনও চড়া মিওজিকের সাথে সবাই নাচতো গাইতো আবার কেওবা দল বেঁধে টেবিলে বসে মদপান করত আর অতীতের কোন সুখদুঃখের ঘটনা নিয়ে কান্নাকাটি করত। তবে এই সব অনুষ্ঠানে একটি বিষয়ে সবার লক্ষ্য থাকতো তার নিজস্ব ব্যক্তিগত কারনে কেউ যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। এই ছিল আমাদের বিশেষ করে যারা ইউএনের সেক্টর হেডকোর্য়াটারে কাজ করতাম তাদের জীবনের ধারাবাহিকতা। তবে এরচেয়ে আরো কঠিন জীবন ছিলো তাদের , যারা বেশ প্রত্যন্ত অন্চলে মিলিটারী অবজারভার হিসেবে অবস্থান করত। এবং বেশ মোটা অংকের ঝুঁকিভাতা ইউএন এই জন্য তাদের প্রদান করত। দায়িত্ব পালন এবং কাজের সময় ব্যাতীত অবসরের কিছু সময় এভাবেই আমাদের কেটে যেত ইউএন সেক্টর হেডকোর্য়াটারে নিজেদের সুখ আর দূঃখগুলো নিজেদের মাঝে ভাগাভাগি করে। এই দোতালার ইউএনের অফিসটি নিউইয়র্কের মূল জাতিসংঘ ভবনের চেয়ে কোন অংশে কম ছিলনা।
চলবে