রচনা: এপ্রিল ১৯৯৭,
পশ্চিম চানপুর, গয়ামবাগিচা রোড,
কুমিল্লা।
চন্দ্রিমা বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে কিংবা আনন্দ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সামনেই প্রায় দিনই আড্ডা দেয় শান্তি আর মান্নান। আর শহরের প্রতাপ গলি থেকে বের হয়ে পূজা চক্রবর্তী কলেজে যাওয়ার মুখেই প্রায় দিনই এই দুই বখাটে শান্তি আর মান্নানের কবলে পড়ে।
শান্তি পূজাকে দেখে দেখে মান্নানকে বলে, আমার শালী তো বড় হইছেরে মান্নান। তোরও বিয়ার বয়স যায়। বিয়া করবি কবে?
মান্নান বলে, বিয়া করছি না বলেই তো আমার এতো অশান্তি। তোর শালীর বাহুলতা আমাকে একেবারে পাগল বানাইয়া ছাড়ছেরে শান্তি। তার জন্যই তো আমি এমন কলেজগেটে মাছরাঙ্গা হয়ে বসে থাকি। কিন্তু মাছ তো আর ধরতে পারি না। মাছ তো টুপ কইরা ডুব দিয়া ফালায়। কথাগুলো মান্নান পূজা চক্রবর্তীকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলে। কিন্তু পূজা না শোনার ভান করে প্রতিদিনই কলেজে চলে যায়।
শান্তি বলে, মান্নানরে, আমার শালীকে তো কানের ডাক্তারের কাছে নেওয়া দরকার। কানে যে সে একেবারেই শুনে না। মান্নান বলে, এমন সুন্দরীর কানে না শুনলে, চোখে না দেখলে আমার কোনোই সমস্যা নাই। আমার শুধু দরকার তার বাহুলতা আর...।
চন্দ্রিমা বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে কিংবা আনন্দ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সামনে শান্তি আর মান্নানের এই উৎপাত দিনদিন বেড়েই চলে। কমে না কোনোভাবেই। মাস্তান শান্তি আর বখাটে মান্নানকে কেউ ভয়ে কিছু বলে না। ওদের নামে দায়ের হওয়া সব ফৌজদারী মামলা আজও শেষ হয়নি। কিন্তু এসব মামলায় জামিন ওরা পায়ই পায়। তাই জেলের ভয় ওদের তেমন নেইও। এ অবস্থায়ও কলেজগামী পরমাসুন্দরী পূজা চক্রবর্তী হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, উৎপাতের কারণেও কলেজে যাওয়া বন্ধ করবে না সে। বরং মুসলিম অনেক বান্ধবীর মতো বোরকা পরেই কিছুদিন কলেজে যাবে। তারপর দেখবে কী হয়। এ সমস্যা কি আর সব সময় থাকবে! তাঁর মনোভাব এমনই। এমনকি এ পরিকল্পনায় পূজা চক্রবর্তী তার মা ধরিত্রী চক্রবর্তীরও সমর্থন পায়।
সমস্যার কথা শুনে পূজার বান্ধবী খালেদাই প্রথম তাকে এ পরিকল্পনার কথা বলে। খালেদা নিজেও বোরকা পরে কলেজে আসা-যাওয়া করে। কিন্তু খালেদা আর পূজার বোরকা পরার অর্থ যে এক নয়, সেটা কে কাকে বলবে!
পূজার বাবা শ্যামল চক্রবর্তী এ ঘটনায় ভীষণতর আতঙ্কিত হন। তার মনে হয়, এ বোরকা পরাতেই সমস্যার সব সমাধান হয়ে যাবে না। বরং এতে আরও ঝামেলা বেড়ে যেতেও পারে।
আনন্দ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক রফিক উদ্দিনও পূজার মুখে এ সমস্যার কথা শুনে উৎকণ্ঠায় পড়েন। নানা কারণে পুলিশ ডেকে সব সময় সমস্যার সমাধান হয় না। এদিকে শান্তি আর মান্নান উভয়েই শহরের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের পান্ডা হিসেবেও চিহ্নিত। এর আগেও তারা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সামনে অনেক অঘটন ঘটিয়েছে। এক রিকশাওয়ালাকেও একবার বেশ মারধোর করেছে। জেলও খেটেছে ওরা কয়েকবার করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আবার ছাড়া পেয়ে যায়।
শান্তি একবার এক কিশোরীকে দেখে মুখে শিষ বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির ভাই শান্তিকে কষে থাপ্পড় দেয়। এক মুহূর্ত দেরী না করে শান্তি তখন মেয়েটির ভাইয়ের পেটে ছুরি মেরে বসে।
শান্তি আর মান্নানের মধ্যে মান্নানের বেশি চলে মুখ। এতো শত অশালীন কথা জানে সে, এগুলো বলাও সুস্থ মানুষের পক্ষে অসাধ্য।
শান্তি আর মান্নানের এমন উপদ্রবে বাধা দিতে গিয়ে রেলওয়ে কলোনীর রকিব উদ্দিনও মার খেয়েছেন একবার। রকিব আছমার বড় ভাই। আছমা চন্দ্রিমা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল তখন। সেসব থেকেই সহজে আর শান্তি-মান্নানের বিরোধিতা করে না এলাকার তেমন কেউ। আরেকবার ওদের উৎপীড়নের কারণে ভ্যাদার মা-র বস্তির দমকা বিবির যুবতী মেয়ে কুনিও বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো। জুতাপট্টির শামীমার ছোটবোন ফুলঝুরি বেগম, হাফেজার ছোটবোন কুলসুম, মাসুকের শ্যালিকা শিখা...এমন কতো মেয়েকে যে ওরা আজ অবধি উপদ্রব করেছে, তার শেষ নেই। একবার তো এই শান্তি কলেজগেটের কাজের মহিলা ফিরোজার নানীকে জোর করে ফুচকা দেয় যেন তারা নানী-নাতনী মিলে খায়। নানী কমলা বিবি তেজী মহিলা। গুন্ডাপান্ডাদের আমলে নেওয়ার তার যেন সময় কিংবা বয়স নেই। শান্তির বদ মতলব বুঝতে পেরে রাস্তার পাশের ডোবায় ফেলে দেয় সেই ফুচকা। আর তারপর যে কতো কান্ড গেলো! তার শেষ নেই।
অন্যদিকে ইদানিং আবার কোতয়ালী থানায় চুরির মামলাও হয়েছে মান্নানের নামে। আর শান্তির নামে ইদানিং হয়েছে আরেকটি মাদক মামলা। তারপরও ওরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায়।
শীতকালের পড়ন্ত বিকেলে পরম স্বাদে কুল ফল খাচ্ছিলো শান্তি। মান্নান সিগারেট ধরিয়ে কাছে এসে বললো, ভাই শান্তি, পূজা মাইয়াটা অনেকদিন আর কলেজে আইয়ে না। ঘটনা কী! শান্তি বললো, মাইয়ারে এভাবে প্রতিদিন পথেঘাটে পোন্দাইলে কলেজে কিভাবে আইবো? মান্নান বললো, না, মাইয়াটারে অনেকদিনই আর চোখে পড়ে না। তবে কি তাইর বিয়া হইয়া গেল নাকি! শান্তি বললো, মনে হয় তুই পূজার প্রেমে ডুইবা গেলি! মান্নান বলে, আরে না। ভাবছি মাইয়াটা হারাইলো কই? সচরাচর তো এমন ঘটনা ঘটে না! আপেলের মতো এমন ভালো জাতের মাইয়াটা আমাদের অত্যাচারে হারাইয়া যাইবো! কলেজে আইবো না! লেখাপড়া ছাইড়া দিবো...আমরা কি এতো খারাপ নাকি! সুন্দরী মাইয়াগুলা মূর্খ থাকার পক্ষে তো আমরা নই। শান্তি মান্নানের কথা শুনে বেদম হাসে। বলে, মনে হয় পূজারে হারাইয়া তুই ছ্যাঁকা খাইছস? প্রকৃত গুন্ডাপান্ডারা কিন্তু এভাবে ভাইঙ্গা যাইতে পারে না। বুঝলি, পাতিগুন্ডা হওয়ারও তোর যোগ্যতা নাই। শোন মান্নান, মাইয়া মানুষ হইলো পোন্দানোর জিনিস। হের লাইগা কান্দন বা কোন্দানোর কিছু নাই। পোন্দাইয়া ছাইড়া দে। শান্তি পাবি। আমার সামনে দাঁড়াইয়া, আমার লগে থাইক্কা মাইয়া মাইনসের লাইগা কোন্দাইস না। এতে আমার বমি আসে। গা ঘিনঘিন করে।
শান্তির এতো ছোটলোকমার্কা কথায় মান্নান নিজে গুন্ডাপান্ডা হয়েও আজ সহসা মনে ভীষণই চোট পায়। তাই শান্তিকে মান্নান বলে, তোর নিজের মা-বোনও কি তোর নিজের দ্বারা পোন্দানোর জিনিস খানকির পুত! মান্নানের এ গদার বারির মতো ভারি কথায় আরও অনেক বেশি চোট খায় শান্তি। কোনো কথা না বলে খুব কাছে এসেই মান্নানের ডান গালে ঠাস করে এক চড় কষে দেয়। মান্নান শান্তভাবেই শান্তির এ শক্ত চড়টি হজম করে। চড় খেয়ে তার গালে শান্তির শুধু বৃদ্ধ আঙ্গুল ছাড়া, বাকি চার আঙ্গুলেরই দাগ বসে যায়। তারপর শান্তি মান্নানের সঙ্গে আর কোনো কথা না বলেই দ্রুত চলে যায়। হাতের কাগজের পোটলার কুল ফলগুলো লবণশুদ্ধ রাস্তার পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়। যেতে যেতে শান্তির মনে হয়, অনেক সময় শুয়াপোকা কুল গাছের কচিপাতা থেকে শুরু করে বয়স্ক পাতাও খেয়ে গাছকে নিস্পত্র করে ফেলে। কিন্তু এ পোকাকে তো দেখা যায়। শান্তির হঠাৎ-ই মনে হয়, মান্নান যেন কোনো শুয়াপোকাও নয়, সে যেন আরও ভয়ঙ্কর কোনো কিছু। তবে কি তাকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলবে? মানে খতম করে ফেলা...!
মান্নানের শেষ কথাটি কোনোভাবেই বহন করতে পারে না শান্তি। ‘তোর নিজের মা-বোনও কি তোর নিজের দ্বারা পোন্দানোর জিনিস খানকির পুত’ এই কথার বিষে সারারাত আর শান্তি একটু শান্তিতেও ঘুমোতে পারেনি। তার বারবার মনে হয়েছে, কিছু পোকা যেমন ফল ছিদ্রকারী, ফলের ভিতরে বসে ফলটি এবং ফলের বীজটি কুরে কুরে খায়, মান্নানও ঠিক তেমনি। ওসব পোকার এমনই কারবার যে, বাহির থেকে ফলের গায়ে ক্ষত করার কোনো দাগও রাখে না। এ অবস্থায় মান্নানকেও তার সে রকমই মনে হয়। অথচ তাকে এ শান্তি জীবনে কতো বিদ্যাই না দিয়েছে। অথচ কুত্তার বাচ্চা বললোটা কী! তাকে আর কোনোভাবেই বাড়তেই দেয়া যায় না। এতোদিন সে দুধ-কলা দিয়ে বিষাক্ত সাপ লালন করেছে। সুতরাং...।
এদিকে মান্নানও বুঝতে পারে শান্তি এখন কী পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। শহরে এ পর্যন্ত খুন যে দুইটা করেছে শান্তি, পুরোপুরিই মদ গেলা অবস্থায়। ধরা খেলেও বলবে, মাতাল অবস্থায় কী করে ফেলেছি...। এতে শাস্তি তার কমেও যেতে পারে। সুতরাং ব্যবস্থাটা তাকেই আগে নিতে হবে। তাছাড়া যে ৩০ হাজার টাকা শান্তির কাছে পাবে মান্নান, সেটাও যে শান্তির কাছ থেকে আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেটাও সে অনেক আগেই বুঝতে পারে। সুতরাং...। মান্নান মনে মনে বলে সুতরাং...।
অবশেষে মান্নানের‘সুতরাং’ই জয়ী হয়। তাই ফজরের আজান দেওয়ার আগে তার বাড়িই ঘেরাও করে পুলিশ। যেন মান্নান বড় অবুঝ বালক, খুন করে নিজ বাড়িতে এসে লুকিয়েছে, যদিও ততোক্ষণে লাপাত্তা মান্নানকে ধরতে অন্যদিকেও হানা দিয়েছে তাদের গোয়েন্দা দল। তারপর রিকশা গ্যারেজের কাছ থেকে শান্তির গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ নিয়ে যায় পুলিশ।
পরদিন পূজা চক্রবর্তী নিজের কলেজে যাওয়া শুরু করলো আবার ঠিক আগের মতোই এবং বোরকা ছাড়াই।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:২৬