রচনা: ডিসেম্বর ১৯৯৮, কুমিল্লা।
================
পূর্ব নোট:
মৃত্যুর পূর্বে লক্ষণবাবু বিড়বিড় করে কী যেন বলেছিলেন। শুধু নাকি বুঝা গিয়েছিলো ‘মা মালতী, মা তাবাসসুম ... মা মালতী ... মা ...।
================
লক্ষণবাবুর দুর্ভাগ্য, অকালে তার বাবা মোহিনীমোহনের মৃত্যু। জীবনে অনেক এগিয়ে যেতে পারতেন বাবা বেঁচে থাকলে। সে আর হলো না। লক্ষণবাবুর বাবার ছিল এক রেডিও। সেটা ১৯৪৩ সালের দিকের ঘটনা। তখন এলাকার সকল মানুষ রেডিওতে আতঙ্কের সঙ্গে সোভিয়েত-জার্মান ফ্রন্টে লড়াইয়ের খবর শোনার জন্য লাইন ধরে থাকতো। তখনই মোহিনীবাবুর বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘কংগ্রেস বাড়ি’।
মোহিনীমোহন বাবু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এক লোক। যদিও তার অনেক হিন্দু প্রতিবেশীই ছিলো মুসলিম বিদ্বেষী। অথচ লক্ষণবাবুদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক কোনোকালেই খারাপ হয়নি।
মালতীর এক ঘনিষ্ঠ মুসলিম বান্ধবী রয়েছে। তাবাসসুম। ঠিক যেন মালতীর মতোই দেখতে। লক্ষণবাবু ভাবেন, ভারতে চলে গেলে এই তাবাসসুমের জন্য কি মন কাঁদবে না মালতীর কিংবা মালতীর জন্য তাবাসসুমের? এই তাবাসসুমের পিতা নুরুল ইসলাম একটি হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। প্রতি রমজানের ঈদেই তিনি মালতীর জন্য তাবাসসুমকে নিয়ে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী কিনেন। নিজের বাড়ির কোনো ফলই খান না মালতীদের বাদ দিয়ে। ভারতে চলে গেলে তাবাসসুমকে ভুলতে পারবে মালতী!
============================
আলোকচিত্র: জসীম অসীম: ১৯৯৮।
============================
খড়ের গাদার পাশেই এমন সুন্দরী মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলো বারেক, যাকে অনেকেই বলে বারিক্কা। হিন্দু মেয়েরা এতো সুন্দরী হয় কিভাবে? বারেক মনে মনে ভাবে।
অবশ্য মেয়েটির যে বাড়ি, তার সবটাই বাঁশঝাড়ে ও অন্যান্য বৃক্ষে ঢাকা। রোদ ওই বাড়িতে দুপুরেও তেমন যেতে পারে না। মেয়েটির নাম মালতী। মালতীকে বারেক দ্বিতীয়বার দেখেছিলো ওদেরই পদ্মপুকুরে জল নেওয়ার সময়। একা একা পুকুরঘাটে এসে জল নিয়ে যায় মালতী। দূরের ঝোপে লুকানো বারেককে একটুও দেখতে পায় না।
পাশের গ্রামের রাজনীতি করা লোক এক পেশাদার দুষ্কৃতকারী ফরাজীর দলে আছে এই বারেক। তার চোখে মালতীর মতো যুবতী নারী আটকে পড়া আর সেই যুবতীর জানের-মানের-প্রাণের নিরাপত্তা না থাকা...ওই একই কথা।
মালতীদের গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ নেই। সন্ধ্যা হলে গহিন হয়ে যায় পুরো বাড়ি। বাবা তার স্কুল শিক্ষক। বর্তমানে অসুস্থ দশ বছর আগে তার হার্টে রিং বসানো হয়েছে। বর্তমানেও আবার হার্টের ব্লকেজ ধরা পড়েছে। আরো দুইটি রিং বসাতে হবে।
মালতীদের সারাবাড়ি চালতা গাছেও ভরপুর। ভারতের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ এলাকায় উনিশশ’ বিরানব্বই সালে রামমন্দির তৈরি করা নিয়ে সৃষ্ট দাঙ্গার জের হিসেবে তাদের বাড়ির চালতাগাছেও দুর্বত্তদের দায়ের কোপ পড়েছিলো। ওই ঘটনার পর থেকে মালতীর বাবা আর কোনো জাতীয় নির্বাচনেই ভোট দিতে যাননি।
মালতীর দিদি কল্পনা রায় সেই ঘটনার পর থেকেই ভারতের স্থায়ী বাসিন্দা।
তাঁর এক কাকা আছেন। চাকুরি করেন ঢাকায়। টিকাটুলির কে এম দাস লেনে। তিনিই কখনো কখনো কল্পনাকে ভারতে গিয়ে দেখে আসেন এবং দেশে এসে চোখের জলে কল্পনার ওখানকার সব গল্প বলেন। মালতীও সেই দিদির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয় তারই বান্ধবী তাবাসসুমের কাছে।
মালতীদের পদ্মপুকুরে অনেক কচ্ছপ। ওই পুকুরের বাচ্চা কচ্ছপগুলো মা কচ্ছপের পিঠে বসে থাকে। আর এসব দেখতে দেখতে বারেক ভাবে, হিন্দুরা কেন কচ্ছপের মাংস খায়?
থুথু ফেলে বারেক। ‘ওয়াক’ করে ওঠে। এতো সুন্দরী মালতী। সেও কি কচ্ছপের মাংস খায়?
মালতীদেরই প্রতিবেশী পরান বাবুর চোখে পড়ে বারেককে। জোর গলায় বলে, তুই ওখানে কী করস বারিক্কা? পরানবাবুর ডাক শুনে বারেকের সারা শরীরে বিরাট এক কম্পন হয়। বলে, পরান কাকু, আমার পোষা ডুহি পাখিটা খাঁচা থেকে বাহির হইয়া তোমরার বাঁশবনে ঢুকছে।
ততোক্ষণে পরানের বড়দাদা নীরদবাবুও এগিয়ে আসে। বারেককে বলে, তুমি আবার ডুহি পালছিলা কবে? আর তোমার ডুহি সাত বাড়ি পার হইয়া কল্পনারার বাড়ির বাঁশবনে আইছে, কেমনে বুঝলা?
বারেক বলে, আলমগীর কইছে। সে নাকি লাকরি খোঁজতে আইয়া দেখছে। নীরদবাবু গম্ভীরকন্ঠে বারেককে বলে, বাড়িত যাও-বাড়িত যাও। বনে-বাদাড়ে ঘুইরো না। রূপকথার পইখা ভূতের কথা হুনছো যে, ওই বাদামী বুন্যা ফল গাছটায় একটা থাহে। রাইতে যেমনে ডাহে, হুনলে আর মালতীদের বাড়ির ধারেকাছেও আসতা না।
নীরদবাবুর কথা শুনে বারেক বড়দিঘীর পাড় ধরে চলে যায়। পরান আর নীরদবাবুকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসেন বৃদ্ধ রমাকান্ত চক্রবর্তী। জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে?
পরান উত্তর দেয়, মালতীর দিকে চোখ পড়ছে ল্যাবরেটরী বাড়ির মনসুরের ভাতিজা বারিক্কার। ওই মনসুরের বড় ভাইটাইতো মুক্তিযুদ্ধের সময় শম্ভুর বইনেরে পাকিস্তানী আর্মির হাতে তুইল্যা দিছিলো। নীরদ বলে, শুধু কি বইনেরে? জয়ন্তরেও মারছে। সোমেশ পালাইয়া বাঁচছে। মুকুলদের ঘরে আগুন দিছে। ভাবছিলো, দেশটা পাকিস্তানই থাকবো।
রমাকান্ত বলেন, বাংলাদেশ হইছে বইলা এতো খুশির কিছু নাই। রাজাকাররা তো এই দেশেই আছে এবং ভালোই আছে। তবে হ্যাঁ, মনসুরের এক মামা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। সেই রফিক মামা যুদ্ধের সময় আমাকে এক ভয়াবহ বিপদ থেকেও উদ্ধার করেছিলেন।
রমাকান্তদের এই আলাপে এসে শরীক হোন চুনীলাল। চুনী রমাকান্তের ছোটভাই। সব শুনে চুনীলাল বলেন, মালতীর বাবা লক্ষণবাবুর শরীরটাও খুব ভালো নাই। তার মা কৃষ্ণা বৌদিও অল্প বয়সে মরলো। এর মধ্যে বারিক্কার চোখ পড়ছে মালতীর দিকে। খবরটা আবার লক্ষণরেও জানানো যাইবো না। তার আবার হার্টের অসুখ। শুনছি, বারিক্কা কিছুদিন আগে জেলখানা থেকে জামিনে ছাড়া পাইছে। এতো মস্ত বড় ঝামেলার কথা। মালতীর জ্যাঠাতো ভাই অসিতকেও সব জানানো দরকার।
এইসব বিষয় নিয়ে প্রায় আধা ঘন্টা আলাপের পর সবাই এক সময় যে যার বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু তারা যে দেখেছিলেন বড় দিঘীর পাড় ধরে বারেক চলে গেছে, আসলে যায়নি সে। অন্যপথে ঘুরে এসে ঝোপে লুকিয়ে সব শুনেছে। সবাইকে চিনেছে। তাতে তার মাথার রক্ত আরও চড়ে বসে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে সে রীতিমতো উন্মাদ হয়ে যায়। লোকেও এসব জানে। তাই অনেকে তার সুন্দর নামটাকে বিকৃত করে ডাকে ‘বারিক্কা’। অথচ তার দুইবাড়ি পরের আরেক বারেককে লোকে ঠিকই বারেক বলেই সম্বোধন বলে। আর ফরাজীর এই চেলাকে বলে ‘বারিক্কা’।
বারিক্কার স্কুলজীবনে এক হিন্দু সহপাঠি ছিল। নিত্য। নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দকে প্রায়ই মনে পড়ে বারিক্কার। কিন্তু এখন তার সাথে যোগাযোগ নেই।
হঠাৎ বারেক মালতীদের বাঁশবনে কয়েকটি পেঁচা দেখতে পায়। নিজে সে নিষ্ঠুর হলেও পেঁচাকে ভীষণরকম ভয়ই করে। কারণ সে মনে করে ভূতেরাই দিনের বেলা পেঁচার রূপ ধরে। অথচ এটিকে আবার হিন্দুরা তাদের সম্পদের দেবী লক্ষীর বাহন মনে করে। আর এসব কারণেই হিন্দুদের সে মোটেও দেখতে পারে না। কিন্তু শরৎকালে দুর্গাপূজার সময় হিন্দুপাড়াগুলোতে অবিকল দুর্গাদেবীর মতো সুন্দরী যুবতীদের ঢল যখন নামে, তাদের দেখলে বারিক্কার মাথা ঠিক থাকে না। পার্থক্য শুধু এই: দুর্গাদেবীর হাত দশটি, আর হিন্দু যুবতীদের শুধুমাত্র দুটি করে মানুষের মতোই হাত।
দুর্গাদেবীর কেন দশটি হাত, তার রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি কখনো বারিক্কা। যদিও তার সহপাঠি ছিল নিত্যানন্দ, তার কাছেও সব প্রশ্নের উত্তর ছিল না। নিত্যানন্দও বারিক্কার মতো খারাপ ছাত্রই ছিল। দুর্গার হাতে কেন এতো অস্ত্র, সিংহের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক কিংবা বিদ্যাদেবী সরস্বতী কেন রাজহংসের পিঠে দাঁড়িয়ে থাকেন, এসব বারেক জানে না, জানতে চায় না। বরং সে এসব নিয়ে মজা করে। সহপাঠি নিত্যকে সে বলতো, ইন্ডিয়া যদি সব গরু আমাদের ফ্রি দিতো, তাহলে আমরাও সব কচ্ছপ ওদের ফ্রি দিয়ে দিতাম। নিত্য এসব কথা শুনে মুচকি হাসতো।
নবম শ্রেণির বাংলার শিক্ষক অবনীবাবু কখনো কখনো ক্লাস শেষে মহাভারতের কথা বলতেন। তাঁর বাড়ি ছিল অজন্তাপুর। কিন্তু এই পান্ডব আর কৌরবদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনী শুনতে কখনোই ভালো লাগেনি বারিক্কার। ভালো তার অনেক কিছুই লাগে না। ভালো লাগে না লোকাল ট্রেন। ভালো লাগে না পুলিশ-হাতকড়া। তবে পিস্তলকে সে খুবই ভালোবাসে, যদিও এ বস্তুটি তার এখনও নেই। ফরাজী বলেছে, তার ব্যবস্থাও হবে। আর ভালো লাগে মধুসূদন বাবুর পরমাসুন্দরী কন্যা রোহিণীকে এবং ভালো লেগে গেলো আজ অবশেষে লক্ষণবাবুর মেয়ে মালতীকেও।
এই রোহিণী কিংবা মালতীদের সে কিভাবে শিকার করবে? অবশ্য তার গুরু ফরাজীর কাছে এটা কোনো বিষয়ই নয়। তবু ফরাজীকে আপাতত এ খবর বলতে চায় না বারিক্কা। কারণ? ফরাজী বলে, মহিলাদের হাতের বেলোয়াড়ি চুড়ি যা, পুরুষদের হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাফ বা হাতকড়াও তা। ফরাজীর দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা মদ্যপ অবস্থায় অনেক জায়গা থেকে চাঁদা তুলে আনতে পারে। কিন্তু একা বারিক্কার এতো সাহস নেই।
ফরাজীর কথা হলো ‘মানুষের একমাত্র সাহসটাই পুঁজি’। আর বারিক্কাও জানে বাংলাদেশের অনেক হিন্দুর এই একটি জিনিসই নেই। আর তা হলো সেই সাহস। কোনো বড় ক্ষতি হয়ে গেলেই ইন্ডিয়ায় ওরা পালায়। ছোট ক্ষতি হলে প্রতিবাদ বা মানববন্ধন অথবা মামলা-মোকদ্দমা করে।
বারিক্কা কিছুদিন বেবীট্যাক্সিও চালাতো। এখন ওসব একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে ফরাজীর বিভিন্ন কাজ করে কিছু টাকা পায়। সেই ফরাজী আজ বারিক্কাকে দায়িত্ব দিয়েছিলো শিবাশিস বাবুর বাড়িটার একটু খবর নিতে। বাড়িটার নিচেই যে জমিটা, তার সঙ্গে ফরাজীর এক লোকের জমি। শিবাশিস আর প্রিতমরা দীর্ঘদিন এ জমি নিয়ে বিরোধ করছে, যদিও মামলায় এখনও যায়নি তারা। এখন এই জমিও জালিয়াতি করতে চায় ফরাজী। এর আগেও সে আরেকবার এমন জমি জালিয়াতি করে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তাই এখন শিবাশিসের জমি নেওয়ারও সাহস দেখাচ্ছে। আর ওই জমি ছিল সিদ্ধার্থের। ওটা হজম করে শহরে পাঁচ শতক জমি কিনে বাড়ি করেছে ফরাজী। সিদ্ধার্থও খুব চেষ্টা করেনি। কারণ জমি হারানোর আগেই এক রাতে তার বউ আর দুই মেয়ে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলো।
কান্তমণি ডিগ্রি কলেজের একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল তার দুই মেয়ে। রাত তিনটার দিকে গোয়ালঘরের মশা তাড়ানোর ধোঁয়ার কুন্ডলী থেকেই নাকি সেই আগুনের সূত্রপাত। ঘটনার রাতে কী এক কাজে সিদ্ধার্থ ছিল শহরে। অগ্নিদগ্ধ মা-মেয়েদের মনমোহন ও ফুলমতিরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত নিয়েছিলো। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। পরদিন সিদ্ধার্থ শহর থেকে ফিরে এসে তার জীবনের শেষ বড় কান্না কেঁদেছিলো। থানার এস. আই. এসে বাড়ি ঘুরে গিয়েছিলেন। কোনো রকম ষড়যন্ত্রের কোনোই গন্ধ পাননি। অবশেষে দুর্ঘটনার নোট নিয়েই ফেরত গিয়েছিলেন।
জমি নিয়ে ফরাজীর সঙ্গে জোর চাপাচাপি করেছিলো যতীন্দ্রনাথ। বারণ করেছেন সিদ্ধার্থ নিজেই। বলেন, ফরাজীর বড় ভাই ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে চাকরি করে। তাদের সঙ্গে লড়ে টেকা যাবে না। ১৯৮৫ সালে একবার এই জমি নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিলো। তখন সেটেলমেন্ট অফিসে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমার জুতা ক্ষয় হয়েছিলো। এখন আর শরীরে কিংবা মনেও জোর নেই। এই কথার ঘোর বিরোধিতা করেছিলো যতীন্দ্রের ছেলে তাপসও। কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজেই হাল ছেড়ে দেয়।
জেলখানাকে নিজের বাড়ির মতোই মনে করা যুবক বারিক্কা আজ ঘরেই ফিরেনি। সন্ধ্যা নাগাদ আবারও সে মালতীদের বাড়িতে হানা দেয়।
সন্ধ্যায় রান্নাঘরে ধনিয়া বাটাবাটি করছিলো মালতী। বিকেলে তার বাবাকে সুজি আর রুটি খেতে দিয়েছে। এখন চলছে রাতের রান্নার প্রস্তুতি। রান্না ঘরের কুপির আলোতে মালতীর দুই গালের গোলাপী ছাপ কেমন মোহনীয় দেখাচ্ছে। আর দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তা দেখে বারিক্কার বুক ধকফক করছে। অথচ সে খবর মালতীর কল্পনাতেও নেই।
ঢাকা থেকে ডাক যোগে সাপ্তাহিক ‘একতা’ পত্রিকাসহ আরও কিছু বইপত্রিকা আসে মালতীর বাবার নামে। সন্ধ্যায় মালতীর বাবা সেসব তন্নতন্ন করে পড়েন। এখনও তিনি সেই পত্রিকাই পড়ছেন। যৌবনকালেও হ্যান্ড কম্পোজে টাইপে মুদ্রিত বিভিন্ন বই-পত্রিকা পড়তেন। অভ্যাস আজও যায়নি।
ধনিয়া বাটাবাটি রেখে হাত ধুয়ে মালতী তার বাবাকে একটি ক্যাপসুল খেতে দিয়ে এসে আবারও রান্নাঘরে ঢুকে। বারিক্কা তখন মালতীদের জবাফুলের বাগানের পেছনের ঝোপে লুকিয়ে দেখে মালতী কেবল যে দেখতেই সুন্দরী, মুখমন্ডলই তার দেবীর মতো, তা নয়, তার শরীরের সার্বিক গঠনও অকল্পনীয় নজরকাড়া। মাথা ঘুরে যায় বারিক্কার। এই মেয়েকে তার চাই-ই চাই।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মালতীর পিসীর বাড়ি। পিসী আসবে দুই-তিনদিন পরে। চিঠি লিখে জানিয়েছেন। তাই মালতীর মনে এখন অনেক আনন্দ।
বারিক্কার ধারণা ফরাজী তার আর এ মালতীর কোনো খবরই পায়নি। কিন্তু ফরাজী জানে ওই হিন্দু পাড়া দিয়ে গেলেই যে কারোরই নারী-সংশ্রব কামনা জেগে উঠতে পারে। তাছাড়া বারিক্কার নারীলোভের কথাও জানে ফরাজী। তাই বারিক্কাকে অনুসরণ করতে দেলোয়ারকেও তার পিছু পিছু পাঠিয়েছিলো।
দেলোয়ার ফরাজীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর। ফিরে এসে দেলোয়ার ফরাজীকে বলেছে, বারিক্কা কংগ্রেসবাড়ির লক্ষণ্যার মাইয়ার প্রেমে পড়ছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ফরাজীর কী উচ্চকন্ঠে হাসি।
ভারত ভাগ হওয়ার আগে থেকেই লক্ষণবাবুর পিতা মোহিনীমোহন বাবু ভারতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। ওই থেকে বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘কংগ্রেস বাড়ি’। কিন্তু দেশভাগের আগেই বীরভূমের একটি অনুষ্ঠান থেকে কলকাতায় ফেরার সময় মোহিনীবাবু মারা যান।
মোহিনীবাবুর অনেক আত্মীয়স্বজন দেশভাগের পর উলুবেড়িয়া, শ্রীরামপুর, তমলুক, বাঁকুড়া যে যেখানে পেরেছে, চলে গেছে। লক্ষণবাবুরা যাননি।
লক্ষণবাবু ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এখন আর রাজনীতিই করেন না।
বারিক্কা মালতীর হলুদ এবং মরিচ বাটা দেখে। আরও দেখে শরীরের দোল, উন্নত বক্ষ এবং। তারপর বারিক্কার মাথায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়।
লক্ষণবাবু এরই মধ্যে মালতীকে নিকোলাই অস্ত্রভস্কির ‘ইস্পাত’ উপন্যাসটি পড়তে দিয়েছেন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পাভেল করচাগিন মালতীকে মুগ্ধ করেছে ভীষণ। লক্ষণবাবুর মুখে অনেক বিদগ্ধ কমিউনিস্টেরও গল্প শুনে মালতী। এসব শুনেছে বলেই দু’হাতে মুদ্রা উপার্জন করা মানুষদের দেখে সে আবেগাপ্লুত হয় না, যেমন আবেগাপ্লুত হয় চট্টগ্রামের ‘বনফুল মিষ্টি’ দেখলে।
মালতী যে কলেজে পড়ে, ওখানে তার প্রিয় এক বান্ধবী রয়েছে, শর্বরী। সে ভালো গান গাইতে পারে। হারমোনিয়ামও চমৎকার বাজায় শর্বরী। শর্বরীদের বাড়ি ভরা কবুতর। নৃত্যকলায়ও তার দক্ষতা রয়েছে। রথযাত্রা উৎসবে ও মেলায় শর্বরী থাকে বেশ ধুমধামের মধ্যে। আর দুর্গাপূজায় তো কোনো কথাই নেই। বর্ণিল সাজে এমনই ভাবে সে সাজে, সে শুধু মালতীই ভালো জানে। তবে শর্বরী মালতীর মতো এতোটা সরল চরিত্রের নয়।
লক্ষণবাবু জীবনে অনেকবারই ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছেন, কিন্তু হিসাব মেলাতে পারেননি। বিভিন্ন লাঞ্ছনা-বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণের পথ কি ইন্ডিয়া চলে যাওয়া? এই চলে যাওয়াকে সমাধান মনে করেন না লক্ষণবাবু।
লক্ষণবাবুর এক পিসাতো বোন প্রায়ই তাকে সব বিক্রি করে ভারতের যাদবপুরে চলে যেতে বলেন। সেই বোনের নাম ফুলমতি। এক সময় বাংলাদেশেই ছিলেন। এখন যাদবপুরের স্থায়ী বাসিন্দা।
ফুলমতি বলেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের জীবন ঝুঁকিমুক্ত নয়। বাংলাদেশকে ইরান কিংবা আফগানিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখে কিছু ইসলামি জঙ্গি সংগঠন। ওরা ওই কাজ পারুক না পারুক, ওদের প্রথম বলি হবে যে কোনো সময়েই বাংলাদেশের হিন্দুরা। সুতরাং ওখানে পড়ে মরার কোনোই কারণ নেই।
ফুলমতী শিক্ষিত নারী। ১৯৭৯ সালের ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাসও তিনি জানেন। তিনি লক্ষণকে সেই ভয়ও দেখান। বলেন, সিরিঞ্জে বিষাক্ত ইনজেকশন দিয়ে ওই জঙ্গিরা তোমাকে হত্যা করে ফেলবে। কাউকেই তোমার পরিবার দায়ী করতে পারবে না। ওই জঙ্গিরাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রূপচাঁদের বোন ইপ্সিতাকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিলো। রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের সন্তানদের তো কোনো সাজা হবে না। আর ওরা ভয়ানক হিংস্র সাপের বাচ্চা। ওদের ছোবলে পড়লে বুঝবে ওরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে কোনোভাবেই কম নয়। ওরা সেই পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভণরের সাময়িক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীরই বাচ্চা। বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার আগুনে সুযোগ পেলেই ঘি ঢেলে দেবে ওরা। আর ওদেরকে ইঙ্গিত দেওয়ার মতো এখনো অনেক দেশই রয়েছে পৃথিবীতে।
কিন্তু লক্ষণবাবু ওসব কথা কানে নেন না কিংবা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। আর এ জন্য তার প্রতি ফুলমতি ভীষণই নাখোশ। ফুলমতি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠি তামিলরা পৃথক স্বদেশভূমির দাবিতে ১৯৭২ সাল থেকে লড়াই চালিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের সেই প্রেক্ষাপটও নেই। তাদের সামনে একটিই পথ খোলা: আর সেটা হলো ভারতে পালিয়ে আসা। বিকজ বাংলাদেশ অলওয়েজ উইনস টু নেশন থিওরি।
কিন্তু লক্ষণবাবু বলেন, বাংলাদেশে এতো খারাপ অবস্থা হবে না কোনোকালেই। তার মনে ভেসে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা: ‘হেথায় আর্য-হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন, শকহুনদল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’
লক্ষণবাবু মনে করেন মানুষের নিরাপত্তার সমস্যা কিংবা সাম্প্রদায়িকতা সব দেশেই রয়েছে। মহাত্মা ইন্দিরা কিংবা রাজীব গান্ধীরাই তো ভারতে স্বাভাবিক মৃত্যু পাননি। সুতরাং ওখানে গেলেই যে সব সমাধান হয়ে যাবে, তাও ঠিক নয়।
তবে লক্ষণবাবুর ইদানিং মাঝে মাঝে মনে হয়, তাদের হিন্দুপাড়ার কাছাকাছি ঘেঁষে এখন যে একটি দাখিল মাদ্রাসা হয়েছে, তাও খুব সুখের আলামত নয়। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে সেদিন মাদ্রাসার কিছু ছাত্রকে কথা বলতেও তিনি নিজ কানেই শুনেছেন। ওরা নাকি আবার তলে তলে যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীরও ভক্ত।
লক্ষণবাবুর দুর্ভাগ্য, অকালে তার বাবা মোহিনীমোহনের মৃত্যু। জীবনে অনেক এগিয়ে যেতে পারতেন বাবা বেঁচে থাকলে। সে আর হলো না। লক্ষণবাবুর বাবার ছিল এক রেডিও। সেটা ১৯৪৩ সালের দিকের ঘটনা। তখন এলাকার সকল মানুষ রেডিওতে আতঙ্কের সঙ্গে সোভিয়েত-জার্মান ফ্রন্টে লড়াইয়ের খবর শোনার জন্য লাইন ধরে থাকতো। তখনই মোহিনীবাবুর বাড়ির নাম হয়ে যায় ‘কংগ্রেস বাড়ি’।
মোহিনীমোহন বাবু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এক লোক। যদিও তার অনেক হিন্দু প্রতিবেশীই ছিলো মুসলিম বিদ্বেষী। অথচ লক্ষণবাবুদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক কোনোকালেই খারাপ হয়নি।
মালতীর এক ঘনিষ্ঠ মুসলিম বান্ধবী রয়েছে। তাবাসসুম। ঠিক যেন মালতীর মতোই দেখতে। লক্ষণবাবু ভাবেন, ভারতে চলে গেলে এই তাবাসসুমের জন্য কি মন কাঁদবে না মালতীর কিংবা মালতীর জন্য তাবাসসুমের? এই তাবাসসুমের পিতা নুরুল ইসলাম একটি হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। প্রতি রমজানের ঈদেই তিনি মালতীর জন্য তাবাসসুমকে নিয়ে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী কিনেন। নিজের বাড়ির কোনো ফলই খান না মালতীদের বাদ দিয়ে। ভারতে চলে গেলে তাবাসসুমকে ভুলতে পারবে মালতী!
লক্ষণবাবুর সহপাঠিনী শরৎচন্দ্রিকা প্রায়ই তাকে বলতেন, আমরা বাংলাদেশের হিন্দুরা খুব বেশি অবহেলার শিকার। এটা অবশ্য তারও কখনো কখনো মনে হয়েছে। অথচ লক্ষণবাবুর মুসলিম বন্ধু ওয়ালি খানের কোনো তুলনাই হয় না। ওয়ালি সারাটা জীবনই তাঁর পরম বন্ধু হয়ে পাশে পাশে থেকেছেন। কিন্তু এমন দু’চার-পাঁচজন ওয়ালি খানদের নিয়ে তো একটি রাষ্ট্র চলে না।
এলাকার হিন্দুদের জমি জালিয়াত চক্রের মূল হোতা ফরাজীর সঙ্গেও ওয়ালি খান এক-দুইবার লড়েছেন। ওয়ালি খানের স্ত্রী রেহানা ইয়াসমিন মালতীকে মায়ের মতোই স্নেহ করেন। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। কংগ্রেসবাড়ির তিনশ গজের মধ্যে দুর্ধর্ষ ক্যাডার নাজমুইল্লার বাড়িও। সেই বাড়িতে মধ্যরাতে বসে জুয়ার আসর। এই মদখোর নাজমুইল্লা তার বউকেও ভীষণ মারে। একবার নাজমুইল্লা তার এক প্রতিবেশী বিধবার শ্লীলতাহানি করে ধরা পড়ে গিয়েছিলো। জুতা-ঝাঁটার পিটাতেও তখন শেষ রক্ষা হয়নি তার। হাতে পুলিশের হ্যান্ডকাফ লেগেছিলো। কিন্তু এখন দিব্যি স্বাধীন এই নাজমুইল্লা। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। জেল খেটে খেটে অনেক পুলিশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তার। এসব খবর লক্ষণবাবুর কানে ঠিকই আসে। কিন্তু তিনি কী করবেন?
বিধবা এবং দুস্থ নারীদের দিকে চোখ তাক করে রাখে যেই নাজমুইল্লা, সে যে এতো কাছে থেকেও হিন্দুবাড়িকে টার্গেটে রাখেনি, এটা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? নাজমুইল্লার জুয়ার আসর নিয়ে এলাকায় কয়েকবারই সালিসি বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কিভাবে যেন নাজমুইল্লা আবার তা চালু করে দেয়।
ইদানিং সবচেয়ে মর্মান্তিক আরেক ঘটনা ঘটেছে। দাশ বাড়ির পান্নালালের যুবক ছেলে বিক্রম গিয়ে নাজমুইল্লার সঙ্গে ভিড়েছে। বিক্রম যে নাজমুইল্লার সঙ্গে গেলো, ওটার চেয়ে বড় বিষয় হলো কিছুদিন পরেই বিক্রমের গন্ধ নিয়ে হিন্দুপাড়ায় হানা দেবে নাজমুইল্লা।
মনোরঞ্জন পান্নার বড় ভাই। তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছেন লক্ষণবাবু। কিন্তু বিক্রমকে ফেরানো যায়নি। এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত হন তিনি। তার ছাত্র সৌগত শেষবার লক্ষণবাবুকে দেখতে এসে যে কোনোভাবেই টেনশন করতে বারণ করেন। কিন্তু এতো কিছুর পরও কি বিনা টেনশনে থাকা যায়? বিনা টেনশনে থাকার কারণও কখনো ছিল না।
তবে লক্ষণবাবু এত সচেতন হয়েও জানেন না আজ যে স্বয়ং তাঁর নিজের বাড়িতেই বাঘের ছাপ লেগেছে। বারিক্কার উষ্ণ নিঃশ্বাস লেগেছে তাঁর বাড়ির রক্তিম জবা ফুলে।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠে বাইরের টয়লেটে যাওয়ার সময় বুকে ছুরি ধরে খুব চেপে মালতীর মুখ বেঁধে ফেলে বারিক্কা। মালতীর আর শব্দ করারই সুযোগ থাকেনি কোনো। জবাফুলের গাছের সামনেই মালতীফুলের বাগান ধুমরেমুচরে মালতীকে ধর্ষণ করে বারিক্কা। হঠাৎ মালতীর গোঙানী খেয়াল করে চিৎকার করে ঘর থেকে বের হন মালতীর বাবা লক্ষণবাবু। এমনভাবে চল্লিশ বছর আগেও সেই পাকিস্তান আমলে হিন্দুপাড়ায় মধ্যরাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো ভারতী রানী দাস। লক্ষণ রীতিমতো চিৎকার শুরু করেন। তার চিৎকারে পাশের বাড়ির চিত্রাঘোষ, প্রদ্যুৎ, কার্তিক, সমর ও গৌরিহরিরা লাঠি, দা-রামদা ও ছোরা হাতে লক্ষণের বাড়িতে আসে। ততক্ষনে ঝোপের ভিতরে দৌড়ে লুকিয়ে যায় বারিক্কা। কাশীনাথ, প্রসেনজিৎ, তরুণ ও লালুও অন্যবাড়ি থেকে ততক্ষণে ছুটে আসে। ননীবাবুর ছেলে ইন্দ্র মারাত্মক সাহসী ছেলে। ঝোঁপে ঝাঁপ দিয়ে ছুরির পোচ খেয়েও বারিক্কাকে জাপটে ধরে ফেলে।
চিত্রার বোন মায়া রাগে উত্তেজিত অবস্থায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সব্বার সামনেই বারিক্কার মাথায় দা দিয়ে দেয় এক শক্ত কোপ। জিহ্বা বের করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বারিক্কা। রক্তে ভেসে যায় তার আর ইন্দ্রের শরীর। ইন্দ্র ততক্ষণে বারিক্কাকে ছেড়ে দশহাত দূরে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা বৌদি মালতীকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তখন কারো মুখে কোনো কথাই নেই। ততক্ষণে চুনীলাল বাবুও আসেন। সব শুনে বলেন, শুনো এতক্ষণে হয়তো মুসলিমবাড়ির কেউ না কেউ থানার দিকেও চলে গেছে। চুপ। মালতীর দুর্ঘটনার কথা তোমরা কেউ বলবা না। বলবা যে, চুরিতে ধরা খাইয়াই সব্বার লাঠি পিটায় ও দায়ের কোপে মারা গেছে বারিক্কা। লক্ষণের হার্টের অসুখ। মালতীরে থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারির মুখোমুখি তোমরা কইরো না।
ভোর না হতেই লক্ষণবাবুর বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ। বারিক্কার লাশ পাঠিয়ে দেয়া হয় ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদরে। লক্ষণবাবু, ইন্দ্র, সমর ও কার্তিককে হাতকড়া পরিয়ে একটি বেবীট্যাক্সিতে তুলে পেছন পেছন আরেকটি বেবীটেক্সী নিয়ে থানায় চলে যায় পুলিশ। ওরা এখন ‘বারেক খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামী’। পুলিশ ওদের বিরুদ্ধে আদালতে রিমান্ড আবেদন করবে।
এরই মধ্যে এ চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড নিয়ে পুলিশ সুপারও কয়েকবার খবর নিয়েছেন। অন্যদিকে হিন্দুপাড়ার কাছে গড়ে ওঠা নতুন দাখিল মাদ্রাসার ছাত্ররা বিভিন্ন তান্ডবও শুরু করেছে। হিন্দুবাড়িতে মুসলিম খুন হওয়ার জের ধরে ওই শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। ঢিল ছোঁড়ে লক্ষণবাবুদের বাড়ির মন্দির লক্ষ্য করেও। মুকুলকেও ধাওয়া করেছে সন্ধ্যায়। খবর পেয়ে পুলিশও গেছে হিন্দুপাড়ায়। আর বারিক্কা যে চুরি করতেই গিয়েছিল মালতীদের বাড়িতে, কোনো মুসলমানের মুখ থেকেই এ কথার পক্ষে সে রকম সায় পায়নি পুলিশ।
এদিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মালতীকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদিকে অসুস্থ অবস্থায়ও লক্ষণবাবুসহ বাকি আসামীদের জামিন হয়নি। বরং কোর্ট তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। এরই মধ্যে এ মামলার তদন্তভার জেলা গোয়েন্দা পুলিশকে দেন পুলিশ সুপার রহমান জাহিদ। দুঃখের বিষয় জেলহাজতে থাকা অবস্থাতেই লক্ষণবাবু হার্টফেল করে মারা যান।
মৃত্যুর পূর্বে লক্ষণবাবু বিড়বিড় করে কী যেন বলেছিলেন। শুধু নাকি বুঝা গিয়েছিলো ‘মা মালতী, মা তাবাসসুম ... মা মালতী ... মা ...।’
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:০৭