জুন ১৯৭১। এখনো ভারতে যাওয়ার সুযোগ করতে পারেননি অতুল চন্দ্র রায়। তাঁর তিন যুবতী কন্যাকে নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তই আতঙ্কে কাটাচ্ছেন। অসিতবরণ এমন স্ত্রী-কন্যাসহ পালানোর সময়েই পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা খেয়ে মারা পড়েছে। অতুল বাবুদের বাড়িও প্রায় খালি। সারাবাড়ি দিনের বেলাতেও কেমন যেন ভৌতিক হয়ে থাকে। রাত হলে তো আর কথাই নেই। তাছাড়া অতুল বাবুদের এই বাড়িতে পুরনো পুরনো গাছপালার সংখ্যা এতোই বেশি যে, দিনের আলোতেও অর্ধেক আলো মাটিতে নামতে বাধা পায়।
অতুল চন্দ্রের বড় ভাই চাকুরি করেন বরিশালের কাশীপুরে। তিনিও ভারতে চলে গেছেন। আর দিন দিন পরিস্থিতি যতো খারাপ হচ্ছে, অতুল চন্দ্রেরও না গিয়ে যেন আর বাঁচার উপায় নেই। দুই গ্রাম সামনের এক মুসলিম বাড়িতে গত কয়েকদিন আগে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ওরা। মিনার্ভা-র সুবীরের মুখে এই ঘটনার বিবরণ শুনে অতুলবাবুর দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে একা ফেলে তারও পালানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া এই অতুল ডাক্তারের কাছে এখনো যে প্রতিদিন ১০/ ১৫ জন রোগী আসে, তাদের সঙ্গে তার শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্কই নয়, এক ধরনের আত্মীয়তাও হয়ে গেছে। তাদের এবং তার হোমিওপ্যাথিক চেম্বার ফেলে যুবতী কন্যাদের নিয়ে শরণার্থী হয়ে কোথায় কিভাবে ঘুরে বেড়াবেন অতুল চন্দ্র, সেই পথও তার মাথায় আসে না।
সেদিন বাজারে সেলুনে শেভ করতে গেলে অতুল চন্দ্র রায়কে নাপিত যুধিষ্ঠির বলে, বাবু দাড়িটা এখন রেখে দেন। ধুতি পরাও ছাড়েন। বাজার পর্যন্ত যখন আসেন, তখন আমার এ কথাটি রাখেন। এদিকে বাড়িতে ফেরার পথে তহশিলদার মোখলেছ বললো, ডাক্তার বাবু, পাঁচ কলেমা শিখেছেন? না শিখলে দ্রুত শিখে নেবেন। বিপদে কাজে আসবো । কলেমা মুখস্থ করলেই তো আর মুসলমান হয়ে যাবেন না। সেদিন সুদেব কামার তার শ্বশুরবাড়ি থেকে একা ফিরছিলো। কপাল মন্দ তার। পড়লো আর্মির হাতে। কলেমা জিজ্ঞেস করেছিলো ওরা। পারেনি। অথচ সেদিন বৈদ্যের বাজারে সুদেবের কাকা কলেমা পড়ে আর্মির হাত থেকে দিব্যি বেঁচে গেলো।
গত কয়েকদিন টানা বৃষ্টিতে হাওড়া জলার অতুল বাবুর পাটক্ষেতটাও ডুবে গেছে। বীজ বুনেছিলেন দেরীতে। পৈত্রিক সূত্রে একতলা একটি বাড়িতে বসবাস করলেও আজকাল অতুলবাবুর দিনকাল খুব খারাপই যাচ্ছে। সংসার জীবনের প্রথমদিকে ঢাকার ঠাটারীবাজারে চাকুরি করতেন অতুলবাবু। পরে চাকুরি ভালো না লাগায় বাড়িতে চলে আসেন। শুরু করেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি। এখন বাড়ির এ চেম্বারে বসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা-রাশিয়া এবং চীনের ভূমিকা নিয়ে রোগীদের সঙ্গে আড্ডায় বসেন। যারা কোনোদিন গোমতি ছাড়া আর কোনো নদীকেই জীবনে দেখেননি, তাদেরকেও নিজের পড়া জ্ঞান থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের গল্প শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। অশোক নন্দী তো বলেই বেড়ান যে, অতুলের এই বকবকানির কারণেই তার জীবনে চাকুরিতে উন্নতি করা সম্ভব হলো না। কিন্তু এক্ষুণি সব্বাই তারা তাকে ভারতে পালাতে বলছে। আরও বলছে, কলেমা শিখে নিতে, দাড়ি রেখে দিতে। এগুলো তাহলে কিসের লক্ষণ? শাস্ত্রে আছে, ‘য পলায়তি, স্ব জীবতী।’ যে পলায়ন করে, সে বেঁচে যায়। এখন কি তার পলায়নই একমাত্র পন্থা?
অতুল চন্দ্র রায়ের স্কুল জীবনের বন্ধু জহির বিন আলম বলেছেন, ঘরে তোমার যুবতী কন্যা থাকাতে ভয়টা আরও বেড়েছে। বিশ্বজিৎ মজুমজার খুব সাহসী লোক। ইদানিং তিনিও বলছেন, অতুলদা’ আগেভাগে ইন্ডিয়ায় না গিয়ে খুব ভুল করে ফেলেছো। ইদানিং তো যাওয়া আরও কঠিন হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে রূপগঞ্জ বাজারে পাকিস্তানী আর্মি কয়েকটি দোকান পুড়েছে। তার মধ্যে সুষমার বাবার ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ অন্যতম। সুষমার বাবা কার্তিক রায় বাজার থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু সেদিন রাতেই গোপনে নিজের সেই ছোট্ট ফ্যাক্টরীতে ঢুকে আগুনে পোড়া ময়দা, ডালডা, চিনি, দুধ দেখে এসে সারারাত বিলাপ করেছেন। ভোরে সুষমা তার বাবার হাত ধরে দুটি চিড়ার লাড্ডু আর এক গ্লাস জল খেতে অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু এতো বড় অঘটনের পর কার্তিক বাবুর গলা দিয়ে আর খাওয়া নামছে না। কার্তিক বাবুর মা শৈলবালা রায়ও ছেলেকে বুঝিয়েছেন, প্রাণ রক্ষাই যেখানে এতো কঠিন, সেখানে দোকানপাট-ব্যবসার কথা ভেবে কী হবে! কিন্তু কার্তিক রায় স্ত্রী গীতা রায়ের কথায়ও আর তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। সারারাত কান্নাকাটির পর থেকে এখন একেবারেই মূর্তি হয়ে বসেছেন। কিন্তু এই মূর্তিরূপে থাকলেও হয়তো শেষ রক্ষা হতো। অথচ তার দুদিন পর থেকে আবারও যথারীতি ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ তে যাওয়া শুরু করলেন কার্তিক রায়। দুই গ্রাম দূরের আর্মি ক্যাম্পে সেই খবর যেতে দেরী হলো না। এর একদিন পরেই আর্মি এসে কার্তিক রায়কে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেলো। শুরু করলো তার প্রতি অকথ্য অত্যাচার। অপরাধ: কার্তিক রায় হিন্দু। তাই ভারতের দালাল। গাছে ঝুলিয়ে চাবুক দিয়ে তাকে অনেক পেটানোও হলো। সেই চাবুক আবার সাইকেলের টায়ার ছিঁড়ে বানানো। পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে চাক চাক রক্ত উগলে বের হয়ে এলো। তারপর তার নাভিতে ধান রেখে বুটের গোড়ালি দিয়ে পিষে দিলো পাক-আর্মি।
কার্তিক রায় তার বাবা সুধীর রায়ের কাছে বাংলার জলদস্যুদের তান্ডবের গল্প অনেক শুনেছেন। কিন্তু এই জনপদে এ কেমন দস্যুর উপদ্রব দেখা দিলো এখন? এই গল্প তার জীবনে শোনা সকল গল্পকেই হার মানিয়ে দিলো।
দুইদিন পর রেজু খাল এবং সাবের খালের সংযোগস্থলে রশি দিয়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কার্তিক রায়ের লাশ পাওয়া গেলো। ‘স্বদেশী ব্রেড এন্ড বিস্কুট ফ্যাক্টরী’ পোড়ার পর আর ঘুমাতে পারেননি কার্তিক বাবু। লাশ হয়ে এখন নিবিড়ে ঘুমাতে লাগলেন।
অতুল চন্দ্র রায়দের গ্রামের নাম মহাদেবপুর। এই গ্রাম এখন প্রায়ই ফাঁকা। দেশে যে যুদ্ধ চলছে, তাঁকে অনেকে মুক্তিযুদ্ধ না বলে ‘হিন্দু-মুসলমান কিংবা ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ’ বলেও প্রচার করছে। সেই কাতারে মীর্জা লোকমান হোসেনও রয়েছেন। তিনি এলাকার মেম্বার। ইদানিং তিনি অতুল চন্দ্র রায়ের হোমিওপ্যাথিক চেম্বারেও রোগী হয়ে আসছেন। রমেশ পোদ্দার বলেছেন, মীর্জা লোকমান হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানী আর্মিরও যোগাযোগ রয়েছে। এই কথা শোনার পর এখন অতুল চন্দ্র রায়ের চোখেও ঘুম নেই। রাত হলেই ভগবানকে স্মরণ করেন আর বারবার চোখ মুছেন।
ইদানিং আর শেভও করছেন না অতুলবাবু। সারা মুখেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ব্লেড-রেজর-শেভিং ক্রীম ঘরে থাকলেও শেভ করতে আর ইচ্ছে হয় না তার। এরই মধ্যে কেটে গেলো কিছুদিন। দাড়িটাও অতুলের আরেকটু বড় হলো। একদিন সকালে হাত ব্যথার কথা বলে অতুলের চেম্বারে এলেন মীর্জা লোকমান হোসেন। এসেই অতুলের দাড়ি দেখে হাসাহাসি শুরু করলেন। এ হাসি সত্যিই ভয়ংকর।
অতুল বললেন, হাসির ঘটলো কী লোকমান ভাই! লোকমান বললেন, অতুলবাবু আপনার দাড়ি দেখে হাসছি। মন্দ লাগছে না। দাড়িটা সাহস করে রেখে দিন। রবীন্দ্রনাথের মতো। আবার হাসতে লাগলেন মীর্জা লোকমান। অতুলবাবু বললেন, এটা সাহস আর ভয়ের বিষয় নয়, শেভ করার সময় পাইনি কিছুদিন। এই হলো ঘটনা। লোকমান বললেন, ঘটনা যা-ই হোক, দাড়িটা রেখে দিন দাদা। আপনাকে খুব মানিয়েছে।
মীর্জা লোকমানের সত্যিকার পরিচয় পাওয়া গেলো দুইদিন পর মধ্যরাতে। যখন তিনি সূত্রধর বাড়িতে সত্যি সত্যিই হানা দিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যসহ হামলা করে নিরঞ্জন সূত্রধরের যুবতী কন্যা রেখাকেও তুলে নিলেন। যাওয়ার সময় কালীমন্দিরের সামনেই নিরঞ্জনকে গুলি করে মারলেন। ভাঙলেন কালীমন্দিরের প্রতিমা। নিরঞ্জনের স্ত্রী গৌরীরানী ও তার কিশোরী কন্যা সংগীতা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না বলেই বেঁচে যান।
রেখার পরনে ছিলো শাড়ি, কানে ছোট্ট সোনার দুল। ফর্সা হাতে লাল টকটকে চুড়ি। তাকে দেখেই সুখানুভূতিতে ভরে যায় পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রাণ। তারা তাকে টানতে টানতে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে যায়। রেখার হাত স্পর্শ করেই সৈন্যরা ভীষণ কামার্ত হয়ে পড়ে। নীল রঙের সুতি শাড়িতে জড়ানো রেখা তখন ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। চোখ দিয়ে তার টলটল করে বের হচ্ছিল জল।
সুঠাম দেহের অধিকারী মীর্জা লোকমানের ছোটভাই নুরুল ইসলাম একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি মীর্জা লোকমানকে বললেন, আপনার এই কাজের পরিণাম একদিন আমাদের সবাইকে বহন করতে হবে বড় ভাই। নিরঞ্জনের ছোটভাই শ্যামাচরণ সূত্রধর কোনো না কোনোদিন এর শোধ নেবে। যুদ্ধ তো আর সারাজীবনই চলবে না। পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞও একসময় বন্ধ হবে। প্রফুল্ল আর শেফালীদের পরিবার কিংবা সুবোধ মল্লিকরাতো চিরতরেই ইন্ডিয়া যায়নি। যুদ্ধ থামলেই দেশে ফিরবে। তখন কি হতে পারে, এখন কি ভাবা যায়?
মীর্জা লোকমান বলেন, ওরা আর ফিরবে না। হীরেন বাবুরা তো যুদ্ধের আগেই গিয়েছে। ফিরেনি আর। এখন এই যুদ্ধে পাক-আর্মির পেটা খাওয়া হিন্দুরা কখনোই আর এখানে ফেরার সাহস পাবে না।
এমন যুদ্ধের দিনে অতুল চন্দ্র রায়ের কন্যা তুলসী, অপর্ণা, করুণার বাড়ির বাইরে যাওয়া প্রায় নিষেধই। তারপরও বিশেষ প্রয়োজনে ওরা এ বাড়ি-ও বাড়ি যায়। ওদের মা মারা গেছেন অসুখে বছর দুয়েক হলো। কোনো ছেলে নেই অতুলের। বড় মেয়ে তুলসীর যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছিলো, ঠিক তখনই শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। ছেলের পরিবারও এখন ইন্ডিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে।
তুলসী মেয়েটা ভীষণই ভীতু প্রকৃতির। পাকিস্তানি আর্মির নাম শুনলেই তার শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। এই তো সাত-আটদিন আগে অতুলের বাড়ির পাশের ঝোঁপে একটি গেছো বাঘের ছানা দেখে প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। সুবীর ও দুলাল এই খবর শুনে ঝোঁপ-জঙ্গল তছনছ করেও কোনোকিছুর দেখা আর পায়নি।
সুবীর পাশের বাড়ির রমেশবাবুর ছেলে। তুলসীকে ভীষণ পছন্দ করে। কিন্তু তুলসী তার ছায়াটাও দেখতে পারে না। অথচ সুবীর তুলসীদের ঘরের আঙ্গিনায় ছড়ানো তুলসীর শাড়ি দেখেও মুগ্ধ হয়। ছোট ছোট ফুল আর বহুবর্ণের কাজে সমৃদ্ধ তুলসীর একটি শাড়ির ছড়ানো আঁচলের কথা কোনোদিনও ভুলতে পারবে না সুবীর। এই মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হলো বাংলাদেশ। কারণ পূর্ব-পাকিস্তান যে বাংলাদেশ হয়ে যাচ্ছে, তার পেছনে ভারত এবং পূর্ব-পাকিস্তানের হিন্দুদের হাত রয়েছে মনে করেই পাকিস্তানি আর্মি হিন্দুদের ওপর এভাবে শোধ নিচ্ছে। ভারতকে তো আর ধরা যাচ্ছে না। তবে পূর্ব-পাকিস্তানের অসংখ্য হিন্দুকে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং ...।
অপর্ণা ভীষণই রসিক মেয়ে। তুলসীকে বলে, বাড়িতে পাকিস্তানি আর্মি চলে এলে আমাদের বড় ট্রাঙ্কে তোকে ঢুকিয়ে পুকুরপাড়ের জঙ্গলটায় ফেলে আসবো। ট্রাঙ্কটার কোনা ভাঙ্গা। তোর শ্বাস নিতে কোনো সমস্যা হবে না।
আর করুণা আছে সারাদিন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে। এখন পড়ছে ‘শ্রীকান্ত’। তাদের মা প্রিয়বালা রায়েরও এমন উপন্যাস পাঠের নেশা ছিলো। আর ছিলো সন্ধ্যার আগে বারান্দার সিঁড়িতে বসে বাড়ির ওপর দিয়ে অসংখ্য বুনোহাঁসের ঘরে ফেরা দেখার নেশা। অনেক রাজহাঁস পোষতেন প্রিয়বালা। তার মৃত্যুর পর এখন আর হাঁস পোষে না তুলসীরা।
এদিকে পাকিস্তানি আর্মিদের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার গল্প শুনতে শুনতে অতুল চন্দ্র রায় এখন প্রায় অর্ধমৃত। তার এক আত্মীয় হরিমোহন রায়কে পিঠমোড়া করে বেঁধে সমানে পেটাতে থাকে পাক আর্মি। উলঙ্গ করে গোপনাঙ্গ বুট দিয়ে পিষে দেয়। মাটিতে পড়ে গেলে একজন সেনা কর্মকর্তা তার বুকে বুট দিয়ে ইচ্ছেমতো লাথি মারে। মুমূর্ষু অবস্থায় হরিমোহন তার মা পূর্ণিমা রায় আর ভগবানকে যখন বিড়বিড় করে ডাকছিলো, তখনই চালায় গুলি। এই হরিমোহন যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন আগেই পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ছিঁড়েছিলো। তাকে পাকিস্তানী আর্মি অফিসার ঘটনাটি সত্য কী না জিজ্ঞেস করেছিলো। হরিমোহন ঘটনাটি সত্য বলে স্বীকারও করেছিলো। অস্বীকারের উপায়ও ছিলো না। ঘটনার সাক্ষী একজন আর্মিদের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলো। মঞ্জু। মঞ্জু রাজাকার। তাকে এ ঘটনার তথ্য দেওয়ার জন্য পাক-আর্মি অফিসার একটি বন্দুক উপহার দিয়েছে।
অতুল চন্দ্র রায় সারারাত আর ঘুমোতেই পারেন না। এই কি কাল এলো এই দেশে! কী হবে ভবিষ্যতে! পাল-সেন-মোগল-পাঠান-বৃটিশের বিরুদ্ধে এতো রক্ত খরচ করার পরও এখন পাকিস্তানীদের এতো রক্ত দিতে হবে! এমন শ্বাসরোধী-মৃত্যুগন্ধী সময়কে কবে পার হয়ে যাওয়া যাবে কে জানে। আর এসব শুনে সব দেখে স্থবির হয়ে গেছেন অতুল চন্দ্র রায়।
আগষ্টের এক গনগনে দুপুর। হঠাৎ রামপুরের দিকে গুলির শব্দ শোনা গেলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে অতুলবাবুদের বাড়ির সবাই দেখলো রামপুরের কয়েকটি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। ঠিক তখনই হরিদাসের ছেলে প্রফুল্ল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো রামপুরের দিক থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমাদের গ্রামে আর্মি আসতে পারে। সবাই গিয়ে পশ্চিমের পাটক্ষেতগুলোতে লুকিয়ে থাকো। প্রফুল্লের বাজারে একটি টং দোকান রয়েছে। ওখানে সে ফল বিক্রি করে।
জিতেন্দ্র অতুলবাবুকে বললো, কাকু তুমি দ্রুতই তোমার মেয়েদের নিয়ে এই গ্রাম ছাড়ো। অতুল চন্দ্র রায় তার মেয়েদের নিয়ে পাটক্ষেতে গেলেন না। তবে অনেকেই গেলেন।
ভারত ভাগ হওয়ার পরও যে ভারতবর্ষে এমন রক্তপাত চলবে, তা আগে ভাবতেও পারেননি তিনি। যুদ্ধের আগে তার ভারতে যাওয়ার অনেক সুযোগই ছিলো। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এখনো যেমন সিদ্ধান্তহীন তিনি। স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব হারালে স্বাধীনতাকে উপভোগই বা করবে কারা? এরই মধ্যে এক খবর রটে গেলো। মীর্জা লোকমান সরাসরি পাকিস্তানি সৈন্যসহ আজকাল ঘুরে বেড়ায়। যুদ্ধের বাজারে তার দারুন কামাই। অনেকের জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে তবেই ছাড়ছেন। তার সঙ্গে জহুর আহমেদও রয়েছেন। জহুর হাজ্জাম। সে এক দুই হিন্দু পুরুষকে নাকি এ পর্যন্ত মুসলমানিও করিয়েছে। যে হিন্দু পুরুষ মুসলমানি করানোর বিষয়ে সম্মত নয়, তার শাস্তি আগে লিঙ্গ হারানো এবং তারপর গুলি খেয়ে মরা। আর যদি হিন্দু নারী হয়, তাহলে তার ক্ষেত্রে মুসলমানি বা খৎনার ব্যবস্থা নেই সুদানের মতো। তাকে তখন পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পে গিয়েই শুদ্ধ মুসলিম হতে হয়।
অতুলের মেয়েদের দিকে মীর্জা লোকমানের ব্যক্তিগত লোভ দিন দিন লকলক করে বেড়ে যায়। তাই এখানে পাকিস্তানি আর্মিদেরও আনছেন না। যুবতী নারী যে কয়েকজনের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাদের পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে তুলে দিতে হয়। নিজের জন্য কোনো অবশিষ্টই থাকে না। তাই অতুলের মেয়েদের শরীরের লোভে রাতভর লোকমান আর ঘুমোতেও পারেন না। কিন্তু কী উপায়ে এবং কখন যে হামলা দেবেন অতুলের পরিবারে, নির্ধারণ করতে পারেন না। নিরস্ত্র অতুলকে যে কোনো সময়েই হত্যা করতে পারেন। কিন্তু ওপথে যাওয়ারও ইচ্ছে নেই মীর্জা লোকমানের। তাই এ জন্য ভালো কোনো বুদ্ধিও দরকার। কী হবে সেই বুদ্ধি?
একদিন রাতে ডা. অতুল চন্দ্র রায়ের বাড়িতে আসেন মীর্জা লোকমান। সঙ্গে তার একজন বন্দুকধারী বাঙালি যুবক। অতুল আঁৎকে ওঠেন। মীর্জা লোকমান অতুলবাবুকে বলেন, অতুলবাবু আমি পাকিস্তানের সঙ্গেই আছি। মিলিটারীর সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। কিন্তু তাই বলে আপনার ভয়ের কিছু নাই। আমি আপনার কাছের মানুষ। আপনার কোনো ক্ষতি হতে দেবো না আমি। কিন্তু আপনাদের এই হিন্দুপাড়ায় তো পাক-আর্মি কালকেই হামলা করবে।
অতুলবাবু বললেন, তাহলে উপায়! লোকমান ভাই আপনি আমাদের রক্ষা করুন। অসুস্থ মা আর যুবতী মেয়েদের নিয়ে এখন কোথায় যাবো আমি! মীর্জা লোকমান বললেন, আমি কি রক্ষা করবো? রক্ষা করবেন আল্লাহ-ঈশ্বর-ভগবান। আপনি এখনই তিন মেয়ে আর ঘরের সোনাদানা সব নিয়ে হাওড়া জলার শাহজাহান সর্দারের বাড়িতে উঠবেন। আপনার বৃদ্ধ অসুস্থ মাকে বাড়িতেই রেখে যাবেন। দুদিন পরেই আবার ভিটায় ফিরবেন। বৃদ্ধ মহিলাকে পাকিস্তানি আর্মি মারবে না। আর্মি সবই পুড়ে দিতে পারে। এ পাড়ায় কিচ্ছু রাখবে না বলেছে। আর ঐ অপরাধ করেছে আপনাদের মনিন্দ্রবাবুর ছেলে। সে পাকিস্তানি এক সিপাহীকে জবাই করে ধরা খেয়েছে। তাই পালানো ছাড়া এখন আর কোনোই মুক্তি নেই আপনাদের। সময়ের খারাপ লগ্নে আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাললাহু ওয়ালাইআসসালামও হিযরত করেছিলেন।
অতুল ডাক্তার বললেন, পাড়ার সবাইকে না বলে শুধু নিজের প্রাণ নিয়ে পালাবো! আমি এতোটা স্বার্থপর নই লোকমান ভাই। শাস্ত্রে পালানোর কথা আছে ঠিক। কিন্তু প্রতিবেশীকে ফেলে দিয়ে ঠিক এভাবে নিশ্চয়ই নয়।
মীর্জা লোকমান বললেন, আমি আপনার কতোকালের আপন মানুষ অতুলবাবু। অসুখেবিসুখে সবসময় আপনি আমাদের পাশে থেকেছেন। আপনাকে আমি মরতে দেবো না। জোর করেই ধরে নিয়ে যাবো। এই এলাকায় আপনার মতো দামি মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। আপনি মরলে রাতবিরাতে চিকিৎসার জন্য কোথায় যাবে মানুষ? চলুন। আপনার মেয়েদের নিয়ে এক কাপড়ে এক্ষুনি চলুন।
অতুল ডাক্তার বললেন, আমার একটি শর্ত আছে অতুলবাবু। লোকমান বললেন, কী শর্ত! অতুল রায় বললেন, আমি আমার মাকে কোলে করে হলেও নিয়ে যাবো। পাক-আর্মিকে বিশ্বাস করি না আমি। মীর্জা লোকমান হাসলেন। বললেন, হায়...আমি আগেই জানতাম। মা পাগল অতুলবাবু ইন্ডিয়া যেতে পারলেন না মাকে ফেলে! আর এখন মাকে ফেলে হাওড়া জলার শাহজাহান সর্দারের বাড়িতে যাবেন!
আর দেরি নয়অতুলবাবু। বটগাছের গোড়ায় আমাদের নৌকা বাঁধা আছে। লোক জানাজানি হলে ঝামেলা আরও বাড়বে।
খুব দ্রুতই রওয়ানা হয় অতুলের পরিবার। কোথা থেকে যেন অতুলের শক্তি-সাহস বেড়ে যায়। এতো সাহস আগে দেখালে তিনি এখন ভারতের উত্তর ত্রিপুরার কৈলাশশহরেই বসবাস করতে পারতেন।
মা-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে নৌকায় বসলেন অতুলবাবু। পাটক্ষেতের ফাঁক দিয়ে নৌকা নিয়ে এগিয়ে গেলো লোকমানের আরেক সহযোগী মনজুর। হাওড়া জলার সীমানায় পৌঁছেই মিহি জ্যোৎস্নার আলোতে জলে একটি মেয়ে মানুষের লাশ ভাসতে দেখলেন অতুলবাবু। চিৎকার করে বললেন, হায় ভগবান...এ কি দেখছি আমি লোকমান ভাই!
লোকমান ধমক দিয়ে বললেন, চুপ। কোনো শব্দ করবেন না।দেশে এখন যুদ্ধ চলছে না। কোথা থেকে ভেসে এসেছে কে জানে। ঈশ্বরের কাছে শুকরিয়া করেন যে বিপদ থেকে আপনি সপরিবারে দূরে সরে এসেছেন।
অতুল ডাক্তার বললেন, লোকমান ভাই, বেঁচে থাকলাম ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হয়ে। আমাদের পাড়ার কাউকে পাক-আর্মি আসার খবরটা বলে আসতে পারলে কমপক্ষে ওরা পালাতে তো পারতো।
মীর্জা লোকমান বললেন, খবরটা আমিই ওদের দেবো। আগে তো আপনাকে রক্ষা করি। আমার মায়ের বাতের ব্যথা আপনার ওষুধে ভালো হয়েছে। সে কথা মা এখনো বলেন। অতুল ডাক্তার বলেন, মাসি এখন আছেন কেমন! কতোদিন দেখি না তাকে। মীর্জা লোকমান বলেন, মা এখন কমপ্লিট সুস্থ আছেন।
পানি আর পাটক্ষেতবেষ্টিত শাহজাহান সর্দারের দ্বীপবাড়িতে পা রেখেই হোঁচট খেলেন অতুল ডাক্তার। শাহজাহান সর্দাররা কোথায়? বাড়ি যে শূন্য!
মীর্জা লোকমান বললেন, তারা চলে গেছে অনেক পশ্চিমে। মেঘনা নদীর কাছাকাছি তাদেরই এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সর্দারের দুই যুবক ছেলেই ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। পাকিস্তানী আর্মি তাদেরও ছাড়বে না। তাই শাহজাহান সর্দাররা এখন পাক আর্মির ভয়েই বাড়ি ছাড়া।
জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুলটি যে করে ফেলেছেন অতুল চন্দ্র ডাক্তার, হায়...এতক্ষনে এখন এটা মনে মনে ধরতে পারলেও তার আর এখান থেকে সহজে ফেরার কোনোই উপায় নেই।
অতুলের অসুস্থ মা তার কানে কানে বললেন, তুই সারাটি জীবনভরই শিশু থাকলি রে অতুল। এ তুই কী করলি! অতুল ডাক্তার চিৎকার করে বললেন, মা গো, আমি শিশু নই গো মা। আমি ওই গোখরো সাপটিকে বিশ্বাস করেছিলাম।
এরই মধ্যে অতুল ডাক্তার টর্চ লাইটের আলোতে দেখতে পেলেন শাহজাহান সর্দারের বাড়ির উঠানে লাল নীল বর্ণের মেয়েদের কিছু জুতো। আর ততোক্ষণে মীর্জা লোকমান আপন সুখে ধরিয়েছেন কিংস্টক বা কুইনস্টক এক সিগারেট এবং তার চামচারা সব্বাই বিড়ি।
অতুল ডাক্তারের চোখ দিয়ে তখন টলটল করে বেরুচ্ছে তপ্ত জল। তার হাতঘড়িতে তখন রাত্র তিনটা তিরিশ। তার তিন মেয়েই সেই সময়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৬