কাহিনী ১
বৃত্তের বাইরে থেকেও ভিতরে
কথার কথা আমি এখন বড় বড় কথা বলছি, দেশের পরিবর্তন দরকার-কিভাবে পরিবর্তন করা যায়, সরকারের গুষ্টিকিলাই গালাগালি দেই। এভাবে দেখতে দেখতে পাশ করে বের হই সুযোগ খুঁজছি চাকরীর, বললাম ভাই আমাকে চাকরী দেন। অনেক ধরপাকড় চাচা/মামার পর চাকরী দিলো তো পরিবেশ পছন্দ হলো না নিজের মতো কাজ করার সুযোগ কম। একসময় দেশ ছেড়ে বাইরে যাবার প্রচেষ্টা।
কয়েক বছর চেষ্টার পর প্রথম সুযোগ পেতেই বাইরে উড়াল, একটা মোটামোটি চাকরী পেলাম সে দেশে, আয় বাংলাদেশের টাকায় মোটামোটি ভালো হলেও সেদেশের তুলনায় মাঝারি, আয় এবং ব্যায়ের সামঞ্জস্য আনা কঠিন। সেই দেশে থাকার সময় মাঝে মাঝেই মনে হয় দেশে থাকলেই হয়তো ভালো হতো, অন্যের দেশে চাকরের মতো কামলাগিরি তো করতে হতো না। কিন্তু দেশের মানুষকে এই কথা জানালেই বলে বাইরে আছো বাইরেই থাকো।
আরও দুএক বছর পর দেশে আসলাম (অথবা সেই দেশেই) সুন্দরমতো মেয়ে দেখে বিয়ে করলাম। খরচ ও সুন্দর জীবনের কথা চিন্তা করে আবারও সেই বাইরের দেশে চাকরের কাজে চলে গেলাম এখন কেবল দেশের কথা ভাবলে হবে না। এখন পরিবারের কথা ভেবে মুখ গুঁজে সেই দেশে পরে থাকো। বাবা-মা বুড়ো হচ্ছেন তাদের দেখাশোনা করা দরকার, কিন্তু সময় কোথায়? আমরা পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্রুত জীবনযাপনে অভ্যস্থ। আমাদের এখন সময় কোথায় দেশে গিয়ে দুদন্ড বাবা-মাকে সঙ্গ দেয়ার? মাঝে মাঝে এখানকার বাংলাদেশী বন্ধুদের সাথে ছুটির দিনের আড্ডার সময় উত্তপ্ত বিষয় হিসেবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠে আসে। দেশের নেতাদের গাল দেই। দোষারোপ করি আমাদের নতুন প্রজন্মকে, দেশ উচ্ছন্নে যাচ্ছে আর অকর্মন পলায়নপর নতুন তরুণ প্রজন্ম দেশ ছেড়ে ভাগছে বলে তপ্ত আলোচনা করি। দিন শেষে ঘরে ফেরার সময় মনের কোণে একটি অপরাধবোধ জাগে আমিও তো দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি, এই নতুন প্রজন্মের দোষ কিভাবে দেই? তারা তো তাদের পূর্বসূরীদের প্রদর্শিত পথই অনুসরণ করছে।
সন্তান হলো, এখন তাদের লালন পালনের জন্য আরও বেশি খাটতে হবে, তাদেরকে এই দেশের আধুনিক পরিবেশে বেড়ে তুলতে হবে। তারা বড় হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, আমরাও চাই না তারা দেশের নোংরা পরিবেশ নিয়ে কিছু জানুক। আমাদের দেশ অতীত, অতীত নিয়ে চিন্তা করে আর লাভ কী? আমরা চাই না আমাদের সন্তান দুর্নীতি-অন্যায়ের নগ্ন চেহারা দেখুক। বাংলাদেশ সম্পর্কে আলোচনা পারতপক্ষে তাদের সামনে করি না। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন পালাপর্বণে লোকদেখানো অনুষ্ঠান করি। পয়লা বৈশাখ একুশে ফেব্রুয়ারী ইত্যাদি ঘটা করে উদযাপন করি। এরকম অনুষ্ঠান-পার্বনে ছেলেমেয়েদের উৎসাহ উদ্দীপণা দেখে ভালো লাগে, সেই সাথে মনটা উদাস হয়ে পরে, মনে পরে ছেলেবেলার কথা। ইশ কতো সুন্দরই না ছিলো আমাদের ছেলেবেলা আমাদের ছেলেমেয়েরা এই কৃত্রিম জীবণের মাঝে মুক্ত জীবণের স্বাদ আর পাচ্ছে না, আমরা কি ভুল করলাম?
এরপর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠছে উঠে নিজেদের মতো চলার পথ ধরতে চায়। অন্তর্দ্বন্দ কলহ প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা, ছেলেটা তার বন্ধুদের সাথে মদ-নেশা ধরছে, ঘন ঘন ক্লাবে যাচ্ছে না বলে কয়েকদিন উধাও হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির বন্ধুবান্ধবের বহর দেখে মনে ভয় লাগে, অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে। আমাদের বাংলাদেশী মন মেনে নিতে চায় না পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঔদ্ধ্যতা। তবে কী দেশে গেলেই ভালো হতো? প্রায়ই মনের কোনায় এই প্রশ্ন জেগে উঠে।
জীবনের শেষ সায়াহ্ন, বয়স হয়ে গেছে এখন মৃত্যুর জন্য দিন গোনা। দেশে গিয়ে আর কি হবে? এই দেশে যে সুযোগ সুবিধা উন্নত চিকিৎসা তা কি দেশে পাবো? থেকেই যাই এই দেশে।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে। জীবনে কি পেলাম? দেশ ছেড়ে ভিনদেশে এলাম, সেই চাকরের হাড়ভাঙ্গা চাকরী করলাম। কোনকিছু কি পরিবর্তন করতে পারলাম? আমার এই জীবনের অর্থ কি হলো? আমি যে এই বিশাল পৃথিবীতে এসেছিলাম তা কয়জন জানলো? আমি যে মারা যাবো তাই বা কয়জন জানবে? এই জীবনের কোন মূল্য কী থাকবে শেষ পর্যন্ত? দেশ থেকে বহু দিগন্ত দূরে শেষ শয্যায় জীবনটা নতুন করে শুরু করার আগ্রহ হয়, জীবনের যতো ভুল তা শোধরানোর ইচ্ছা। আচ্ছা সেই ভুলের মধ্যে কি দেশ ছেড়ে এই বিদেশবিভূইয়ে আসা পরে? কে দেবে এর জবাব?
কাহিনী ২
বৃত্তের মাঝে
আমি এখন বড় বড় কথা বলছি, দেশের পরিবর্তন দরকার-কিভাবে পরিবর্তন করা যায়, সরকারের গুষ্টিকিলাই গালাগালি দেই। এভাবে দেখতে দেখতে পাশ করে বের হই সুযোগ খুঁজছি চাকরীর, বললাম ভাই আমাকে চাকরী দেন। অনেক ধরপাকড় চাচা/মামার পর চাকরী দিলো তো পরিবেশ পছন্দ হলো না নিজের মতো কাজ করার সুযোগ কম। কিন্তু উপায় কি নিজের কথা তো ভাবতে হবে? পরিবারের কথা ভাবতে হবে। যেভাবেই হোক মানিয়ে চলো। আর বসকে একটু তেল মারলেই হলো, মাঝে মধ্যে না-বলা কিছু কাজ করে দেয়া, বসকে খুশি রাখা তাহলে আর কে উন্নতি হওয়া ঠেকাবে? আর একবার ম্যানেজার হতে পারলেই তো হলো তখন আর আমায় কে পায়? প্রায়ই কলিগদের সাথে-বন্ধুদের সাথে ছুটির দিনে আড্ডায় বসের গুষ্টিউদ্ধার করি, গালাগাল দেই দেশের নেতাদের, দোষারোপ করি শিক্ষাব্যবস্থাকে, ছুটির দিন ফুরিয়ে গেলে আবারও নাকমুখ গুজে কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাই। প্রজেক্টগুলো ঠিকভাবে করতে পারলে আর কিছুদিন অপেক্ষা এরপরেই তো পদোন্নতি, তখন আর আমায় পায় কে?
কয়েক বছর কেটে গেলো, ছোটখাটো কয়েকটি পদোন্নতি হয়েছে। বেশ বড় পোস্টে না উঠতে পারলেও এখন আমার কাজের কিছুটা স্বাধীনতা এসেছে। আমার নিচে এখন বেশ কয়েকজন কাজ করছে। এরা সবসময়ই চাচ্ছে আমাকে টুপি পড়িয়ে পদোন্নতি করতে। কিন্তু বেটারা জানে না তাদের পথ আমিও পাড়ি দিয়ে এসেছি, দাড়াও আবার আসুক দেখাচ্ছি মজা। ছুটির দিনে সময় হয়না পরিবারকে দেবার জন্য। ছুটির দিনে জমানো কাজ করি। তাও মাঝে মধ্যে হঠাৎ পুরানো কোন মুখের সাথে দেখা হয়ে গেলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, সেই আলোচনার একটা অংশে উঠে আসে আজকের প্রজন্ম। পুরা উচ্ছন্নে যাওয়া ফাঁকিবাজ প্রজন্ম। কাজ না করেই মাস শেষে টাকাটা তুলে নিতে চায়। আর প্রায়ই তেল দিয়ে কাজ আদায়। এই আলোচনা উত্তপ্ত হয়ে উঠে শেষ হয় প্রজন্ম ও পশ্চিমা সংস্কৃতি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের উপর দিয়ে।
আরও কয়েকবছর কেটে গেলো। এখন আমার অবস্থা বেশ ভালো। এই সুযোগে হুট করে একদিন বাবা মা বয়সের দোহাই দিয়ে বিয়ের জন্য ধরলেন। একদিন মেয়ে দেখেটেখে বিয়েও দিয়ে দিলেন। বউ আমার বেশ সুন্দরী লক্ষীময়ী। আরও দ্রুত উন্নতি হতে থাকলো আমার।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তান হলো। বাবা মা তো মহা খুশি সারাদিন এই নতুন শিশুটি নিয়ে থাকেন। আমার আর সময় নেই দম ফেলার সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হবে না? ছেলেমেয়েকে তো যেখানে সেখানে দেয়া যায় না। তাদের জীবনে কোন নোংরা যাতে না লাগে তা দেখতে হবে। দেশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে তাদেরকে আড়াল করে রাখতে চাই যে।
ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। বহু কষ্ট করে ভালো একটা স্কুলে দুজনকেই ঢুকিয়ে দিতে পারলাম। কিন্তু তারপরও মনের মাঝে কোথায় যেনো খোঁচাতে থাকে। এরা ভালো থাকবে তো? এরা কাদের সাথে মিশছে, কি করছে? কিভাবে এদেরকে সঠিক পথ দেখাবো? প্রায়ই বাসায় অশান্তি হচ্ছে, ছেলেটা বন্ধুদের সাথে চিটাগং যেতে চায় মেয়েটা যেতে চায় কনসার্টে। নাহ এখন কি তাদের ছাড়া যায়? পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে নতুন প্রজন্মটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। সন্তানদেরকে আর ছাড়া সম্ভব নয়, কঠোর অনুশাসনে রাখতে হবে যে।
ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। নিজেদের মতো চলতে শিখেছে, নিজেদের চলার মতো বোধবুদ্ধি হয়েছে। ছেলেটা একটা ভালো কোম্পানিতে ম্যানেজারের চাকরী পেয়েছে কয়েক বছরে ভালো পদন্নতি আছে এরপরই বিয়ে দিয়ে সুন্দর একটা বউ আনতে হবে। মেয়েটাও বেশ চটপটে হয়েছে। বন্ধুদের সাথে মিলে নিজের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। কি করছে তা ঠিক বুঝতে না পারলেও খারাপ যে করছে না তা বুঝতে পারছি। মেয়েটারও বিয়ের ব্যবস্থা এবার করতে হবে যে। যেমন তেমন হলে তো চলবে না। এই একটা ক্ষেত্রে যে আর দশটা সাধারন পরিবারের মতো হলে চলবে না।
বয়স হচ্ছে ছেলেমেয়েরা যার যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যেই অতীত নিয়ে রোমন্থন করি। কি হলো কিভাবে হলো? জীবনে কি পেলাম? যৌবণে কতোকিছু ভাবলেও সেই চাকরের হাড়ভাঙ্গা চাকরী করলাম সারাজীবন। কোনকিছু কি পরিবর্তন করতে পারলাম? আমার এই জীবনের অর্থ কি হলো? সাধারন একটি জীবনযাপন করে চলে গেলাম। আমি যে এই বিশাল পৃথিবীতে এসেছিলাম তা কয়জন জানলো? আমি যে মারা যাবো তাই বা কয়জন জানবে? এই জীবনের কোন মূল্য কী থাকবে শেষ পর্যন্ত? শেষ শয্যায় জীবনটা নতুন করে শুরু করার আগ্রহ হয়, জীবনের যতো ভুল তা শোধরানোর ইচ্ছা। আচ্ছা সেই ভুলের মধ্যে কি কোনকিছু পরিবর্তনের চেষ্টা না করাটা পরে? কে দেবে এর জবাব?
কাহিনী ৩
বৃত্তের বাইরে- যদি এমন হতো?
(অসমাপ্ত......... মনটা খারাপ পরে শেষ করবো।)