---------------------------------------------------------------------------
এই পর্বটি পড়ার আগে -
দ্যা লস্ট গস্পেল (The Lost Gospel) -১
দ্যা লস্ট গস্পেল (The Lost Gospel) -২
দ্যা লস্ট গস্পেল (The Lost Gospel) -৩
পড়ে নিন ।
-----------------------------------------------------------------------------
এ পোস্ট পড়ার আগে কিছু বিষয় সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান...
ঈসা (আ) এর সময়, ইসরাইলের এহুদিয়া অঞ্চল (ঈসার জন্মভূমি) ছিল একটি রোমান প্রদেশ। তাই ইহুদীদেরকে রোমান নিয়ম কানুন মেনে চলতে হত।
ঈসা (আ) এর নবুয়াতের সময় এহুদিয়ার রাজা ছিলেন হেরোদ।
আজকের পর্বে ২ জন ইসরায়েলি নবীর নাম আসবে, এরা হলেন হযরত ইয়ারামিয়া (আ) আর আরেকজন হযরত মিকাইয়া (আ)। এদের সময় ভণ্ড নবীর প্রকোপ বেড়ে গিয়েছিল।
হযরত ইয়ারামিয়া (আ) ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৬৫৫ সাল থেকে ৫৮৬ সাল পর্যন্ত। মারা যান মিসরে।
হযরত মিকাইয়া (আ) ছিলেন ইসরাইলের বাদশাহ আহাব এর সময়, এর মানে সালটা হবে, খ্রিস্টপূর্ব ৮৫০ সাল এর দিকে।
ইসরাইলের আশপাশের মানুষ (এমনকি কিছু পথভ্রষ্ট ইসরায়েলিও) যেসব দেবতার উপাসনা করত তাদের মধ্যে প্রধান ছিল দেবতা বা’আল। বা’আল এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন নবী ইলিয়াস (আ)।
কুরআন বলছে-
“নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল রসূল। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বললঃ তোমরা কি ভয় কর না ? তোমরা কি বা’আল দেবতার এবাদত করবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে ?? যিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনকর্তা। অতঃপর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। অতএব তারা অবশ্যই গ্রেফতার হয়ে আসবে ... ইলিয়াসের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক!” (কুরআন, ৩৭:১২৩-১৩০)
প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে দেবতা বা'আলের মূর্তি-
যাক, আমরা বারনাবাস এর ইঞ্জিলে ফিরে আসি... আগের পর্বের পর থেকে...
অধ্যায় ২৬
ঈসা বললেন, “আমি যা বলি সত্য বলি। কারণ, আমার কথা আসে আল্লাহর কাছ থেকে, যিনি আমাকে ইসরাইলের জন্য নবী করে পাঠিয়েছেন। তাই আমি বলছি, যা কিছু তোমাদের আছে সবই আল্লাহর দেয়া উপহার। এখন বল, উপহার বেশি দামী নাকি উপহারদাতা ? যদি তোমার বাবা মা আল্লাহর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তাদের ত্যাগ কর। আল্লাহ কি ইব্রাহিমকে বলেননি, তোমার পিতৃগৃহ ত্যাগ কর এবং আমি আমি তোমাকে যে পবিত্র ভূমি দিচ্ছি সেখানে এসে বাস কর ? আল্লাহ এ কারণেই বলেছিলেন যে, ইব্রাহিমের বাবা দেবমূর্তি বানাতো, আর পূজা করত। ছেলেকে পোড়াতেও তাঁর কোন আপত্তি ছিল না।” পিটার বলল, “আপনার কথা সব সত্য। অনুগ্রহ করে ইব্রাহিম আর তাঁর বাবার কাহিনী আমাদের বলুন।”
ঈসা বললেন, “ইব্রাহিমের বয়স ছিল ৭, যখন তিনি আল্লাহকে খোঁজা শুরু করেন। একদিন ইব্রাহিম তাঁর বাবাকে বললেন, ‘বাবা, মানুষকে বানিয়েছে কে?’ বোকা বাবা উত্তর দিল, ‘মানুষই মানুষকে বানিয়েছে। আমি তোকে বানিয়েছি, আমার বাবা আমাকে বানিয়েছে।’ ইব্রাহিম বললেন, ‘না বাবা, আমি এক বৃদ্ধকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুনেছি, হে দেবতা! তুমি কেন আমাকে কোন সন্তান দিলে না !’
বাবা বলল, ‘এটা সত্য যে, দেবতারা মানুষকে কিছু সাহায্য করেন। এজন্য, আমাদেরকে কিছু মেষ উৎসর্গ করতে হয় দেবতার জন্য।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘বাবা, দেবতা কত জন?’ বাবা বলল, ‘অসংখ্য আছে ।’
তখন ইব্রাহিম বললেন, ‘বাবা, আমি যদি এক দেবতাকে পূজা করি, তাহলে যদি অন্য এক দেবতা নারাজ হয়ে আমার ক্ষতি করতে চায় তাহলে কী হবে ?? তাহলে তো দেবতা দেবতায় যুদ্ধ লেগে যাবে। ঐ দেবতা যদি আমার দেবতাকে মেরে ফেলে ? এরপর তো আমাকেও মেরে ফেলবে।’
বাবা হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয়ের কিছু নেই। দেবতারা নিজেদের মধ্যে কলহ করেন না। দেখিস না, বড় মন্দিরে আমাদের ১০০০ দেবতা আছে, অথচ কেউ কাউকে আক্রমন করে না? ওদের সাথে দেবতারাজ বা’আল আছেন... আমার বয়স ৭০ হতে চলল, আজ পর্যন্ত এমন কিছু হয়নি। আর, এক এক মানুষ এক এক দেবতাকে পূজা করে। সবাই একজনকে না।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘ও, তাহলে উনাদের মধ্যে শান্তি বিরাজ করছে ?’ বাবা বলল, ‘হ্যাঁ।’
এরপর ইব্রাহিম জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা, দেবতারা দেখতে কেমন?’ বাবা ধমক দিল, ‘বোকা কোথাকার!! প্রতিদিন আমি একটা করে দেবতা বানাই, আর বিক্রি করি। অথচ, তুই জানিস না দেবতা দেখতে কেমন!!’ ঐ মুহূর্তে বাবা একটা দেবমূর্তি বানাচ্ছিল। ওটা দেখিয়ে বলল, ‘এই যে এটা পাম কাঠে বানানো। আর ঐ যে ওটা জলপাই কাঠে। আর ঐ ছোট্টটা আইভরি। দেখে মনে হচ্ছে না, এরা যেন জীবিত? আহা, কেবল শ্বাসটাই নেই!’
ইব্রাহিম বললেন, ‘ও, তাহলে দেবতাদের শ্বাস নেই? বাবা, তাহলে তারা বাঁচে কেমন করে? যারা নিজেরাই জীবিত না, তারা জীবন দান করে কীভাবে? তাহলে তো এরা দেবতা না।
এইবার বাবা রেগে গিয়ে বলল, ‘তোর যদি বয়স বেশি হত, তাহলে এই কুড়াল দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিতাম।’
ইব্রাহিম আবার বললেন, ‘বাবা, দেবতা মানুষ বানালে, মানুষ আবার দেবতা বানায় কেন? আর, দেবতাদেরকে যেহেতু কাঠ দিয়ে বানানো হয়, তাহলে কাঠ পোড়ান তো গুনাহ। অথচ কাঠ দিয়া আমরা আগুন জ্বালাই। আচ্ছা বাবা, তুমি এত্ত এত্ত দেবতা বানালে অথচ তোমাকে দেবতারা বেশি সন্তান দিল না কেন? তোমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ বানাল না কেন?’
বাবা এসব শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। ইব্রাহিম বলেই চলল, ‘বাবা, এমন কি সময় ছিল যখন দুনিয়াতে মানুষ ছিল না?’
বাবা বলল, ‘হ্যাঁ। কেন?’
ইব্রাহিম বললেন, ‘কারণ, আমি জানতে চাই প্রথম দেবতাকে কে বানিয়েছিল?’
বাবা বললেন ‘যা তো আমার সামনে থেকে! আমার এ দেবতাটা তাড়াতাড়ি বানাতে হবে। কথা বলিস না।’ বাবা বলল।
ইব্রাহিম বললেন, ‘কী এমন দেবতা! তুমি যেভাবে চাও সেভাবেই কাটতে পার, নিজেকে রক্ষা পর্যন্ত করতে পারেনা!’
বাবা রেগে বলল, ‘সারা দুনিয়ে বলে এটা দেবতা, আর তুই পিচ্চি বাচ্চা বলিস এটা দেবতা না! দেবতাদের কসম, তুই সাবালক হলে আমি তোকে মেরেই ফেলতাম !’ এ কথা বলে বাবা ইব্রাহিমকে লাথি দিল আর পলায়নরত ইব্রাহিমের পিছু পিছু তাড়া করতে লাগল...”
অধ্যায় ২৭
সাহাবীরা এ কাহিনী শুনে হাসতে থাকলেন, অবাক হলেন ইব্রাহিমের বুদ্ধির কথা শুনে। কিন্তু ঈসা বললেন, “তোমরা কি ভুলে গেছ সেই নবীর কথা যিনি বলেছিলেন, ‘এখনের হাসি অনাগত কান্নার পূর্বাভাস। এত হেসো না, বরং কাঁদ, কারণ এ জীবন তো দুঃখ ভরা। সুখ তো পরকালে।’ ...
(এরপর ঈসা সেই কাহিনী বর্ণনা করলেন যেখানে ইব্রাহিম মন্দিরে সব মূর্তি ভাংচুর করেন আর কুড়াল রেখে দেন দেবরাজ বা’আল এর মূর্তির কাছে। এরপর ঈসা শোনান ইবাহিমকে শাস্তি হিসেবে আগুনে ফেলে দেয়ার ঘটনা...)
অধ্যায় ৫১
সাহাবীরা ঈসার কাছে এলেন আর বললেন, “প্রভু, আমাদের দুটো জিনিস জানান। একটা হল, শয়তানের সাথে আপনার যে কথোপকথন হয়েছিল সেটা। আরেকটা হল, হাশরের ময়দানে শেষ বিচারের দিন কী কী হবে।”
ঈসা বললেন, “আমি সত্যি বলছি, শয়তানের প্রতি আমার আসলেই অনেক সহানুভূতি ছিল তাঁর পতনকাহিনী জেনে। আর সেসব মানুষের প্রতিও আমার সহানুভূতি যাদেরকে সে প্রলুব্ধ করে পাপের প্রতি। আমি রোজা রেখে আল্লাহে কাছে দোয়া করলাম। আল্লাহ জিবরাঈলকে পাঠালেন, আর তাঁর মাধ্যমে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে ঈসা, বল, তুমি কী চাও?’
আমি বললাম, ‘হে আল্লাহ! তুমি তো জানই শয়তানের জন্য এ দুনিয়ায় এত পাপ। শয়তান তো তোমারই সৃষ্টি। তাকে মাফ করে দাও।’
আল্লাহ বললেন, ‘ঈসা, আমি তাকে মাফ করব, তাকে কেবল এতটুকু বলতে বল, হে আল্লাহ! আমি পাপ করেছি! আমাকে মাফ কর। তাহলেই আমি তাকে আগের মতো নিষ্পাপ বানিয়ে দিব।’
আমি তো শুনে অনেক খুশি হয়ে গেলাম। ভাবলাম, সমস্যা বুঝি প্রায় সমাধান করেই ফেলেছি। আমি শয়তানকে ডাকলাম। শয়তান এলো। বলল, ‘বল, ঈসা, আমি তোমার জন্য কী করতে পারি?’
আমি বললাম, ‘আমার জন্য না। বরং তোমার জন্য তুমি নিজেই করতে পার।’
শয়তান বলল, ‘আমার সেবা যদি তোমার না লাগে, তাহলে আমারও তোমার সেবা দরকার নেই। কারণ, আমি তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ। তুমি মাটি থেকে আর আমি আগুন থেকে।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা, বাদ দাও এ কথা। তুমি তোমার আগের গৌরব আর মর্যাদা ফিরে পাবে এমন একটা প্রস্তাব কি তোমার জন্য বেশ ভাল না ? তুমি তো জানই, শেষ বিচারের দিনে মিকাইল (Michael) ফেরেশতা তোমাকে কত শাস্তি দেবেন।’
শয়তান বলল, ‘দেখা যাবে কী হয়। আমার কত অনুসারী থাকবে জান না?? এত বেশি থাকবে, যে, আল্লাহ বুঝে যাবে ঐদিন, কত্ত বড় ভুল সে করেছে আমাকে বিতাড়িত করে। সামান্য এক কাদামাটির জন্য।’
আমি বললাম, ‘শয়তান! তুমি জান না তুমি কী বলছ!’
‘আচ্ছা বাদ দাও,’ শয়তান আমাকে বলল, ‘তুমি কি কাজের কথা বলছ যেটা করলে আমার আর আল্লাহর বিবাদ মিটে যাবে? শুনি তোমার প্রস্তাব।’
‘তোমাকে শুধু দুটো কথা বলতে হবে।’ আমি বললাম।
‘কী কী কথা?’
‘কথা দুটো হল, আমি ভুল করেছি। আমাকে মাফ কর। ’ আমি বললাম।
শয়তান বলল, ‘আমি সত্যি বিবাদ মিটিয়ে ফেলব, যদি আল্লাহ নিজের মুখে এ কথা দুটো আমাকে বলে। আল্লাহ যদি নিজের ভুল স্বীকার করে।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘দূর হয়ে যা পাপিষ্ঠ! তুই হলি সব পাপের মূল। আর আল্লাহ পাপশুন্য। ন্যায়বান।’
শয়তান চিতকার করে বলল, ‘তুমি কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটা মিথ্যা বললে !’ ... ”
(এরপর ঈসা শেষ বিচারের দিনের অবস্থা বললেন)
অধ্যায় ৯৭
জনতার মাঝে ঈসা কথা বলছেন।
“আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, আমি ইসরাইলের ত্রাণকর্তা মাত্র। সারা বিশ্বের ত্রাণকর্তা নই। আমাদের পিতা ইব্রাহিমকে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘তোমার বংশধারায় আমি একজনের মধ্য দিয়ে বিশ্বকে আশীর্বাদ করব।’ আল্লাহ যখন আমাকে তুলে নেবেন, তখন শয়তান বিভ্রান্তি ছড়াবে, কাফিরদের বিশ্বাস করাবে যে, আমি ঈসা আমি আল্লাহ আর আল্লাহর পুত্র, আমার কিতাব বিকৃত হবে। হয়ত ৩০ জন ঈমানদারও সেইদিন থাকবে না। তখন আল্লাহ তাঁর সেই রাসুলকে পাঠাবেন। তিনি আসবেন ইসরাইলের দক্ষিন দিক থেকে। তিনি মূর্তিপূজা রোহিত করবেন। তিনি আল্লাহর করুণা বয়ে আনবেন, তাঁর জীবন সার্থক যে তাঁর কথায় বিশ্বাস করবে। আমি তাঁর জুতোর ফিতে বাঁধারও যোগ্য নই। তবুও আল্লাহ আমাকে দয়া করেছেন যে, আমি তাঁকে জীবিত অবস্থাতেই দেখতে পাব।”
তখন একজন ইমাম বললেন, “হতাশ হবেন না, আল্লাহর বান্দা ঈসা। আমরা আদেশ জারি করব যেন কেউ আপনাকে খোদা বা খোদার পুত্র না বলে।”
ঈসা বললেন, “আপনার কথায় আমি সান্ত্বনা পাচ্ছি না। যেখানে আপনি আলো আশা করেন, সেখানে থাকবে অন্ধকার। কিন্তু, আমার খুশি এ কারণে যে, প্রতিশ্রুত সেই রাসুল এসে আমাকে নিয়ে প্রচলিত সব মিথ্যা ধ্বংস করবেন আর আমাকে মহিমান্বিত করবেন। তাঁর মধ্যে দিয়ে বিশ্ব আশীর্বাদ পাবে, যেমন আল্লাহ ইব্রাহিমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি সান্ত্বনা পাই এজন্য যে, আমাকে দেয়া কিতাব বিকৃত হয়ে যাবে, কিন্তু সেই রাসুলকে দেয়া কিতাব কখনও বিকৃত হবে না।”
ইমাম বললেন, “প্রতিশ্রুত সেই রাসুলের পর আর কোন নবী কি আসবেন?”
ঈসা বললেন, “তাঁর পর আল্লাহর প্রেরিত কোন নবী আসবেন না। কিন্তু অনেক ভণ্ড নবী আসবে। এর জন্য দায়ী শয়তান।”
রাজা হেরোদ বললেন, “এটা কি আল্লাহর ন্যায়বিচার যে এমন ভণ্ড নবী আসবে?”
ঈসা বললেন, “আল্লাহর ন্যায়বিচার হচ্ছে, কেবল অধার্মিকরাই তাদের বিশ্বাস করবে। বিশ্ব দেখেছে, ভণ্ড নবীদের অবস্থা কেমন হয়; যেমন ভণ্ড নবীদের পরিণতি দেখা গিয়েছে হযরত মিকাইয়া আর হযরত ইয়ারামিয়ার সময়। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, হবে।”
ইমাম তখন জিজ্ঞেস করলেন, “প্রতিশ্রুত রাসুলের নাম কী হবে? তাঁর আগমনের চিহ্ন কী?”
ঈসা বললেন, “তাঁর নাম প্রশংসিত। আল্লাহ নিজে তাঁকে এ নাম দিয়েছেন। আল্লাহ যখন তাঁর রূহ সৃষ্টি করে স্বর্গীয় আলোতে রাখলেন তখন বলেছিলেন, ‘যে তোমাকে প্রশংসা করে সে প্রশংসিত। আর যে তোমাকে অভিশাপ দেয় সে অভিশপ্ত। আমি তোমাকে দুনিয়ায় পাঠাব মানুষের পরিত্রাণের জন্য।’ তাঁর পবিত্র নাম হল... মুহাম্মাদ।”
তখন জনতা উঁচু গলায় বলল, “হে আল্লাহ! আপনার সেই রাসুলকে পাঠান! হে মুহাম্মাদ! আপনি তাড়াতাড়ি আসুন দুনিয়ার পরিত্রাণের জন্য।”
অধ্যায় ৯৮
ঈসা কথা বলা শেষ করলে, সবাই চলে যেতে লাগল। রাজা হেরোদ, গভর্নর আর ইমামেরা তুমুল তর্ক শুরু করে দিল ঈসার বাণী নিয়ে। অবশেষে, ইমামরা অনুরোধ করল, গভর্নর যেন রোমান সিনেটে পুরো ব্যাপারটি জানিয়ে চিঠি লিখেন। গভর্নর সেটা করলেন। ইসরাইলের প্রতি সিনেটের বিশেষ কারণে দরদ ছিল। আদেশ জারি করা হল, কেউ যেন কখনও এমনকি মৃত্যুমুখেও ইহুদী নবী ঈসা নাসারাকে খোদা বা খোদার পুত্র না বলে। নির্দেশনামা তামায় খোদাই করে বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজায় টানানো হল।
জনতার বিশাল একটা অংশ চলে যাবার পরেও প্রায় ৫০০০ লোক থাকল, নারী-শিশু গণনায় না এনেও। বেশিরভাগই ঈসার কথা শুনতে দূর থেকে এসেছেন। ২ দিন ধরে অনেকে না খেয়ে আছেন... ঈসা এটা বোঝার পর দয়া বোধ করলেন। তিনি ফিলিপকে বললেন, “আমরা এত রুটি কোথায় পাই যেন তারা ক্ষুধায় না মারা যায়?”
ফিলিপ বলল, “ এখানে যত মানুষ ২০০ স্বর্ণমুদ্রা দিয়েও এত রুটি কেনা যাবে না!”
আন্ড্রু বলল, “ঐ যে ঐ ছেলেটার কাছে ৫টা রুটি আর ২টা মাছ আছে। কিন্তু কী আর হবে এতটুকু দিয়ে...”
ঈসা বললেন, “সবাইকে ঘাসে বসাও। ৫০ আর ৪০ করে করে।”
এরপর ঈসা রুটি হাতে নিলেন আর বললেন, “বিসমিল্লাহ!” আর রুটি ভেঙে সাহাবীদের দিলেন, আর সাহাবীরা দিল জনতাকে। মাছের ক্ষেত্রেও একই কাজ করলেন। প্রত্যেকে খেল পেট ভরে!! এরপর সাহাবীরা খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করলেন, দেখা গেল ১২টা ঝুড়ি ভরে গেছে!
সবাই ভাবল, এটা কি স্বপ্ন?? পরের এক ঘণ্টা সবাই এ মুজেজা ছাড়া আর কিছু নিয়ে চিন্তা বা কথা বলতে পারল না। এরপর ঈসা আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে সবাইকে বিদায় দিলেন। কিন্তু, ৭২ জন ছিল যারা যেতেই চাচ্ছিল না। ঈসা তাদেরকে সাহাবী হিসেবে গ্রহণ করলেন।
অধ্যায় ১২৯
(জেরুজালেমে)
ঈসা বয়ান শেষ করলেন, যেখানে তিনি মিথ্যা দেবদেবীর সম্পর্কে বলেছেন। দোয়া শেষে সবাই “আমেন” রবে মুখরিত হয়ে উঠল।
ঈসা নেমে আসলেন মিম্বার থেকে, নিচে দাঁড়িয়ে ছিল অনেক অসুস্থ মানুষ, তিনি তাদেরকে আল্লাহর নামে সুস্থ করে তুললেন। তখন সদ্য-সুস্থ হওয়া এক কুষ্ঠরোগী সাইমন ঈসাকে রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ করল। ইমামেরা ততদিনে ঈসাকে ঘৃণা করা শুরু করে দিয়েছে। কারণ, ঈসা তাদের গোপন কথা বলে দিচ্ছেন। (তারা আল্লাহর ওয়াস্তে দেয়া জনগনের টাকা আত্মসাৎ করত।) ইমামেরা তাড়াতাড়ি রোমান সৈন্যদের গিয়ে বলে দিল, ঈসা তাদের দেবদেবীদের অপমান করেছেন।
ঈসা সাইমনের বাড়িতে ঢুকলেন। যখন তিনি বসে খাচ্ছিলেন, তখন একটা মেয়ে যে কিনা নাম মেরি, দৌড়ে ঘরে ঢুকল। সে ঈসার পায়ের কাছে পড়ে কাঁদতে লাগল। তার অশ্রুতে ভেসে গেল মাটি।
সাইমনের সাথে আরও কয়েকজন বসে খাচ্ছিল, একজন পাপী মেয়ে ওর ঘরে ঢুকেছে তারই আমন্ত্রিত একজনের কারণে, এটা ভেবেই সে অপমানিত বোধ করছিল। মনে মনে ভাবছে, “এ লোক যদি সত্যিই যদি নবী হত, তাহলে কি জানত না যে, এ মেয়ে কত খারাপ ?
ঈসা জানলেন সাইমন কী ভাবছে, তাই বললেন, “সাইমন, তোমাকে আমার একটা কথা বলার আছে।” সাইমন বলল, “জি, বলুন।”
অধ্যায় ১৩০
ঈসা বললেন, “দুজন ঋণীর গল্প বলি। একই লোকের কাছে তাদের ঋণ ছিল। একজন ৫০ টাকা, আরেকজন ৫০০ টাকা। একজনও ঋণ পরিশোধ করতে পারল না। দয়ালু মহাজন ২জনের ঋণই মাফ করে দিলেন। এখন বল তো, এ দুজনের মধ্যে কে মহাজনকে বেশি ভালবাসবে?”
সাইমন বলল, “অবশ্যই যার বেশি ঋণ মাফ করা হয়েছে সে।”
ঈসা বললেন, “ঠিক বলেছ; এখন শোন, এ মেয়েটি আর তোমার ব্যাপার খেয়াল করেছ ? তোমরা দুজনই আল্লাহর কাছে ঋণী। একজনের শরীরে কুস্থ, আরেকজনের আত্মায় কুষ্ঠ। আল্লাহ তোমাদের দুজনের কুষ্ঠতাই ভাল করে দিয়েছেন, দুজনের ঋণই মাফ। তুমি আমাকে কম ভালোবাসো। কারণ, তুমি ভাব, তুমি কম পেয়েছ আল্লাহর কাছ থেকে। আমি তোমার ঘরে ঢুকেছি, অথচ তুমি আমাকে হাত পা ধোয়ার পানি পর্যন্ত দাও নি। কিন্তু, এ মেয়েটিকে দেখ। সে এ ঘরে ঢুকেই নিজের চোখের পানিতে মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমি সত্যি বলছি, বেশি উপহার পেয়েছে এ মেয়েটাই, কারণ সে বেশি ভালবেসেছে। তাঁর গুনাহ মাফ।” এরপর মেরিকে বললেন, “যাও, তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, তোমার প্রতিপালক তোমার গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আর গুনাহ করো না। তোমার ঈমান তোমাকে বাঁচিয়েছে।”
(অনেকেই মেরিকে ঈসার মা মরিয়ম তথা মেরী মনে করতে পারেন আসলে এই মেরী হল মাগদালা শহরের বাসিন্দা তাই তাকে মেরিকে মেরি মাগদালিন বাইবেলে মেরী মেগডালিন বলা হয়। এরপর থেকে মেরি ঈসার সাহাবা হয়ে যায়।)
অধ্যায় ১৯২
(বেশ কিছু দিন পরের কথা)
... কথা শেষ করে ঈসা খেতে বসলেন ইমাম নিকোদিমার সাথে। ঠিক তখনই মেরি, যে কিনা ঈসার পায়ের কাছে কেঁদেছিল, নিকোদিমার বাড়িতে দৌড়ে ঢুকল এবং আবার কাঁদতে লাগল, “প্রভু, আমি আপনার সামান্য দাসী। আপনার মাধ্যমে আমি আল্লাহর করুনা পেয়েছি। আমার এক বোন আছে। আর আছে এক ভাই, যে কিনা এখন মৃত্যুশয্যায়।”
ঈসা বললেন, “তোমার বাড়ি কোথায়? বল। আমি সেখানে গিয়ে আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দোয়া করব।”
“আমার বাড়ি মাগদালা শহরে। কিন্তু, আমার ভাইবোন থাকে বেথানি শহরে।”
“যাও, আমি তোমার ভাইয়ের বাসায় আসব... ভয় করো না, সে বাঁচবে।”
তখন মেরি চলে গেল আর বেথানি শহরে এসে দেখল তাঁর ভাই সেইদিনই মারা গেছে!! তাঁকে কবর দেয়া হয়েছে তাঁর পূর্বসূরীদের সাথে পাথরের সমাধিতে।
অধ্যায় ১৯৩
ঈসা নিকোদিমার বাসায় থাকলেন ২ দিন। তৃতীয় দিন তিনি বেথানি গেলেন। বেথানির কাছাকাছি পৌঁছালে তিনি তাঁর ২ সাহাবীকে বললেন শহরে আগে আগে গিয়ে মেরিকে জানাতে যে ঈসা এসেছেন। খবর পেয়ে মেরি বেথানি থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “প্রভু, আপনি বলেছিলেন আমার ভাই বাঁচবে। কিন্তু, আজ ৪ দিন হল সে কবরে। আমি যদি আপনাকে একটু আগে জানাতে পারতাম!”
ঈসা বললেন, “মেরি! তোমার ভাই মরে নি, কেবল ঘুমাচ্ছে!
মেরি বলল, “হ্যাঁ, প্রভু। সে ঘুমাচ্ছে। তবে, এ ঘুম থেকে সে উঠবে সেদিনই যেদিন আল্লাহর ফেরেশতা শিঙ্গার আওয়াজ দেবে। কিয়ামতের দিন।”
ঈসা বললেন, “বিশ্বাস কর মেরি। সে এর আগেই জাগবে। আল্লাহ আমাকে এ ঘুমের উপর ক্ষমতা দিয়েছেন। বিশ্বাস কর, তোমার ভাই মৃত না। কারণ, মৃত তো কেবল সেই যে আল্লাহর করুনা না পেয়ে মরে।” মেরি দ্রুত ফিরে গিয়ে তাঁর বোন মারথা (Martha)কে জানালো ঈসার আসার কথা।
মেরীর ভাই লাসার (Lazarus) এর মৃত্যুর জন্য জেরুজালেম থেকে অনেকেই এসেছিলো। ইহুদী ইমাম আর ফারিসিরা সেখানে ছিল।
মারথা ঈসার আসার খবর শুনে ছুটে বেরিয়ে এলো। তাঁকে অনুসরণ করে ইহুদী জনতাও এলো, তারা অবশ্য ভেবেছিল সে বুঝি তাঁর ভাইয়ের সমাধিতে কাঁদতে যাচ্ছে। কিন্তু, দেখল সে ঈসা নাসারার কাছে গেল! মারথা বলল, “প্রভু, আল্লাহ যদি আপনাকে এখানে রাখত, তাহলে আমার ভাই মরত না!”
ঈসা চোখের পানি ফেলে বললেন, “কোথায় শুয়ে রেখেছ তাঁকে?”
তারা বলল, “এসে দেখুন।”
ইহুদী ফারিসিরা বলাবলি করতে লাগল, “এ লোকটিই না নাইন শহরে এক মেয়েকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিল? তাহলে, ও বলার পরেও কেন লাসার মারা গেল?” (ঈসা এর আগে এক ছোট মেয়েকে জীবিত করেছিলেন।)
ঈসা সমাধির কাছে গেলেন। সেখানে সবাই কাঁদছিল। ঈসা বললেন, “কেঁদো না। কারণ, সে ঘুমাচ্ছে। আমি তাঁকে জাগাবো।”
ফারিসিরা বলল, “আল্লাহে যেন তোমাকে এমন ঘুম পারিয়ে দেন।” তখন ঈসা বললেন, “আমার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু যখন আসবে, তখন আমি অন্যদের মতই মরব, আর খুব তাড়াতাড়িই জাগবো (কারণ, কিয়ামাত কাছেই থাকবে)।”
ঈসা বললেন, “সমাধির মখ থেকে পাথর সরাও।”
মারথা বলল, “প্রভু, লাশ ৪ দিনের পচা।”
ঈসা বললেন, “তবে আমি এখানে কেন? মারথা, তুমি কি বিশ্বাস করো না? যে, আমি তাঁকে জাগাবো?”
মারথা বলল, “আমি জানি, আপনি আল্লাহর নবী। আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন।”
তখন ঈসা আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ! ইব্রাহিম আর ইসমাইলের আল্লাহ! ইসহাকের প্রভু, তোমার নাম পবিত্র, মহিমান্বিত তুমি, এ মহিলাদের কষ্ট লাঘব করো।”
সবাই বলল, “আমিন।”
ঈসা জোরে বললেন, “লাসার, আস!!!”
লাসারের লাশ জ্যান্ত হয়ে কবর থেকে উঠে আসল। ঈসা সাহাবীদের বললেন, “খুলে দাও তাঁকে।” কারণ, তাঁর গায়ে কাফনের কাপড় ছিল।
অনেক ইহুদী আর ফারিসি ঈসার উপর সেখানেই ঈমান আনল। কারও, মুজেজাটি আসলেই খুব অবাক করা ছিল। যারা অবিশ্বাসী রইল তখনও, তারা জেরুজালেমে পৌঁছে প্রধান ইহুদী ইমাম কায়াফাকে জানালো লাসারের পুনর্জীবিত হবার ঘটনা; জানালো, কত জন লোক নতুন করে নাসারার উপর ঈমান এনেছে।
(লাসার ঈসার সাহাবী হয়ে গেল। তখন থেকে ইহুদী ইমামেরা মিলে ঈসাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা শুরু করল। যার ফল হল ঈসার তথাকথিত ক্রুশের ঘটনা।)
[to be continued...]
দ্যা লস্ট গস্পেল (The Lost Gospel) -৫
রেফারেন্স : গসপেল অফ বারনাবাস