নিতান্তই বাধ্য হয়ে চাকুরীটি করতে হয়। কাজের মধ্যে উদ্দীপক, উত্তেজক বিষয়বস্তু, কিংবা দুরন্তপনা না থাকলে সে কাজে আনন্দ নেই। ছাপোষা অর্থ উপার্জনের জীবন একঘেয়ে লাগে। কিন্তু এই অর্থ উপার্জনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে জীবন অর্থহীন করাটাই যেন ছাপোষা মানুষদের জীবনের একমাত্র গন্তব্য।
ডাইরি লেখা আমার ছোটবেলার অভ্যাস।মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যদি শুধুই লিখে যেতে পারতাম! সব কাজ বাদ দিয়ে শুধুই লিখে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কোথা থেকে যেন একটি বিরামচিহ্ন দ্বিধা নিয়ে দণ্ডায়মান হয় ঠিক নাক বরাবর। এটা সেটা চিন্তা হয়। ভবিষ্যৎ চিন্তা, রুটিরুজির চিন্তা, ইত্যাদি । আর সেই কারণেই একঘেয়ে কাজটি বাদ দেয়া আর হয়ে ওঠে না। রোজ সকালে সেই এক ঘেয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরতে হয়।
আমাকে উপর থেকে যতখানি শান্ত ও নীরব মনে হয় , আমি ঠিক ততটাই চঞ্চল এবং ছটফটে, আমার খুব ভেতরের আমিতে। হাইপার এনারজেটিকও বলা যেতে পারে। এতো এনার্জি থাকলে সেটিকে বার্ন করে স্থিরতা আনতে হয়। আর এই কারণেই প্রতিদিন কাজ থেকে ফিরে সন্ধ্যায় আমি দৌড়াতে যাই পার্কে। এতো দৌড়ঝাপ করে বাড়ি ফিরে তখনো অনেকটা এনার্জি অবশিষ্ট থাকে। সেটি দিয়ে আমি গল্প লিখি, কবিতা লিখি এবং ডাইরি লিখি।
আমি যে পার্কটিতে প্রতিদিন দৌড়াতে যাই, সে পার্কে একটি ছোট জলাধার রয়েছে, যেখানে মাছ সাঁতার কাটতে দেখা যায় । প্রতিবারই যখন আমি ঐ জলাধারের পাশ দিয়ে যাই, মাছ গুলো চির খোলা চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকায়। হয়তো মাছের ভাষায় চোখের ইঙ্গিতে হায় হ্যালোও বলে।
এক সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে আমি পার্কের ভিতর দৌড়াচ্ছিলাম। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় মাছের বদলে আমি হঠাৎ দেখতে পেলাম একটি মানুষ ডুবে যাচ্ছে জলাধারে । হাত নেড়ে প্রাণ পণে বাঁচতে চাইছে। সন্ধ্যায় পার্কটি একেবারেই জনশূন্য। আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। লোকটি কি আসলেই ডুবে যাচ্ছে, নাকি কোন ফাঁদ! কিন্তু বেশী সময় নেই, লোকটিকে এখনি না ওঠালে সে ডুবে মারা যেতে পারে। তখন ঐ লোকটির মৃত্যুর জন্য নিজেকে সারা জীবন দায়ী মনে হবে। সেই অপরাধ বোধের দংশন মৃত্যুর চেয়েও কম নয়। তাই আর বেশী চিন্তা না করে আমার বাম হাতটি দিয়ে জলাধারে ঝুঁকে পড়া একটি গাছের ডাল শক্ত করে ধরে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলাম লোকটির দিকে । কারণ আমার সন্দেহ হচ্ছিলো লোকটি যদি আমাকে টান দিয়ে জলাধারের ভেতরে নিয়ে যায়! তাই আত্মরক্ষার্থে গাছের ডালকে আঁকড়ে ধরে ডান হাত বাড়িয়ে দিলাম। হাত বাড়াতেই লোকটি আমার দিকে রহস্যময় ভঙ্গিতে তাকালো। তারপর সে আমার ডান হাতটি ধরে সত্যি সত্যিই পানির ভেতরে টেনে নিলো। তারপর নিজে উপরে উঠে দৌড়ে পালালো।
আর, এদিকে আমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি সাঁতার জানি। কিন্তু কেন যেন ঐ মুহূর্তে সাঁতরাতে পারছি না। কি একটি শক্তি যেন আমাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে ডুবিয়ে মারছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। মনে হলো আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আমি মারা গিয়েছি। চারকুল ছাপিয়ে তখন আঁধার আর নিস্তব্ধ। হঠাৎ একটি প্রবল গতিতে আমি কোথায় যেন চলে যাচ্ছি। আসলে আমার আত্মাটি শরীর থেকে তখন আলাদা হয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুটছে। মনে হলো ওয়ার্ম হোল ধরে এ জগত থেকে অন্য জগতে পারি দিচ্ছে । আমাকে ছেড়ে এবং এই পৃথিবী ছেড়ে আত্মাটি কোথায় যেন চলে যাচ্ছে । একটু পরেই মাথার উপরে এক বিন্দু আলো চিক চিক করছে। সব কিছু আবার স্থির মনে হচ্ছে। দ্রুতবেগী সেই অনুভূতিটি আর নেই । আমার বুকের খাঁচায় সেই দ্রুতবেগী আত্মাটিকে কে যেন পুরে দিলো। আত্মাটি শান্ত হয়ে বুকের খাঁচায় বন্ধী হয়ে রইল।আমার হৃদপিণ্ড আবার টিক টিক শুরু করলো। আমি জোড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম।
আমি আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম। আর এই স্বপ্নের ভেতরই আমার কয়েক সেকেন্ডের মৃত্যু হয়েছিলো। এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। কত কি যে লেখার আছে আমার। ভাবছি সব ছেড়েছুড়ে শুধুই লিখবো। কখন না জানি আবার আত্মটি ছুটে পালায়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১০:০০