লিখাটি কবির সুমনের বাংলাদেশের প্রতি অভিমানী সাক্ষাতকারের ভিডিও দেখে তাৎখনিক প্রতিক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ ব্যাক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক উপস্থাপনা (পুরনো লিখা)। কাকতালীয় ভাবে গৌতমের ৭০ তম জন্মদিবস সে মাসেই ছিল। জয় বাংলা গান!
.।.
স্মৃতি এক।
সম্ভবত ১৯৯২ সাল, সীমান্ত ঘেঁষা আমাদের বাসায় ডিডি মেট্রোতে এক লোককে দেখি কীবোর্ডে হেলে দুলে গাচ্ছে ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই’। তখন গানটা কানে ভালো লাগেনি কারন এতটা ভিন্নধারার সুর শুনে কান তখনও অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি কিন্তু কোন এক অজানা কারনে মনে গেঁথে ছিল বলেই আজ নিখুঁত ভাবে সেটার কথা লিখতে পারছি, কল্পনায় সে সময়টা ভীষণ নিখুঁত ভাবে দেখতেও পাচ্ছি। পরবর্তীতে সুমনের গান বাসায় এবং মনে গেঁথে যায় বড় বোনের কেনা অ্যালবাম থেকে। আরও অনেক পর এই কিংবদন্তির গান সরাসরি শোনার এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে। সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত ছিল। সুমন কোন বাণিজ্যিক দায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সে আয়োজনে আসেননি, এসেছিলেন আমাদের এক প্রিয় বড় ভাই, স্টুডেন্ট ফিল্ম সোসাইটির ফাকরুল আরিফিন এঁর আমন্ত্রণে। কবির সুমন তখন পুরো বাংলার সঙ্গিত/সংস্কৃতির মধ্যগগনে। কোন ধরনের অর্থযোগ ছাড়াই বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের আমন্ত্রণে কলিকাতা থেকে বাংলাদেশ আসাটা আসলে কল্পনাকেও হারমানায়। সেটা ছিল ঘরোয়া আড্ডায় বসে গান শোনার মতো। শুধু মাত্র একটা গীটারে আর গানের ফাঁকে কথার যাদু দিয়ে এতোগুলো মানুষকে কয়েক ঘণ্টা বুঁদ করে রাখা এটা এর আগে পরে আর কখনই দেখা হয়নি। মন্ত্রমুঘধতা বলে একটা শব্দের সঠিক প্রয়োগও এর আগে দেখার/বোঝার সুযোগ হয়নি। সেদিনের মুক্তমঞ্চে সে গানের আসরের প্রত্যক্ষদর্শীগণ, তোমাদেরও আমার মতোই বিমুগ্ধতা ছিল, নিশ্চিত। তোমাদের জীবনেও সে এক নিশ্চিত স্মরণীয় ঘটনাই বটে। ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ গানটা তার সঙ্গে সেদিন পুরো মুক্তমঞ্চবাসির সঙ্গে মনেহয় আকাশ-বাতাশ, গাছপালাও গেয়ে উঠেছিলো।
স্মৃতি দুই।
ষাটের দশকে বাংলা গানে এক বড় বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল চিন্তা ভাবনায় সময়েরচে ভীষণ রকমের এগিয়ে থাকা একজন ভয়ানক আধুনিক মানুষ আর তার দলের হাতধরে। তার আগের বাংলা গান যে ভাবে লালন-রবিন্দ্র-নজ্ররুল-দিজেন্দ্র-সচিন-সলিল হয়ে ধারাবাহিকভাবে এবং পরিমিতবোধ নিয়ে বিবর্তিত হয়ে আসছিলো ধীরে ধীরে, কিংবা পুরো ভারতবর্ষের সুর যে ধারায় বাহিত হচ্ছিলো গঙ্গার ধারার মতো অনন্তকাল থেকে অনন্তকালের দিকে, সেসব এক ধাক্কায় উড়িয়ে দিয়ে ২০১৮ কিংবা আরো ভবিষ্যতের বাংলার তরুন যে ধারায় বিমহিত হয়ে উদ্বেলিত হবে তার উপযুক্ত এক ধারার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু সময়টা এতোটাই অসময় আর বিপ্লবটা এতোটাই সময়ের আগে শুরু হয়ে গেছিলো যে সেটা সফলতার মুখ দেখলনা। বার্থ বিপ্লবী গৌতম চট্টোপাধ্যায় হতাশ হয়ে (হয় উনার রাজনৈতিক আদর্শের অসাফল্যে অথবা গানের অসফলতায় হতাশ হয়ে) লিখলেন
‘কঠিন এ সময়,
তোমারও কি কেউ নেই পাশে?
কত কি করার আছে বাকি’
৬০/৭০ দশকের তরুন সে কথা, সে সুর বুঝে উঠেনি। সে কথা সুরে বুদ হতে আরও প্রায় দুই যুগের বেশী সময় লাগে। ১৯৯৮ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভাষানী হলে ফারুক ওয়াসিফ ভায়ের রুমে ২/৩ দিন ছিলাম, সে সময় ওনার ফাঁকা রুমে (থাকার জন্য রুমটি ফাঁকা করে দেয়া হয়েছিল) একটা টেপ রেকর্ডার আর তিনটা গানের গানের অ্যালবাম (আবার বছর কুড়ি পরে, ঝরা সময়ের গান, মায়া) পড়ে থাকতে দেখে শুনতে থাকলাম। এমন অদ্ভুত কথা আর সুরের গান আগে শোনা হয়নি, কবির সুমনের গান শোনা অভস্ত কানেও ধাক্কা দিচ্ছিল। অদ্ভুতই বটে, ভালো লাগছিলো কিন্তু কেন লাগছিলো তা বুঝতে পারছিলাম না।
যে জীবনমুখী গানের ইন্দ্রিজাল (যদিও সুমন বরাবরই তার গানকে জীবনমুখী শব্দটি দিয়ে বন্দি করতে চাননি,তিনি তার গানকে আধুনিক গান বলেছেন) এখনও ওপার বাংলায় নানা ফর্মেটে ছড়িয়ে রয়েছে সেটার পথ প্রদর্শক নিশ্চিতভাবেই গৌতম-সুমন।কবির সুমন কলিকাতার জীবনমুখী/ আধুনিক গানের বিপ্লবের এক মহানয়ক। জীবিত সুমন হয়ত নানা রাজনীতির অলি গলির মারপ্যাঁচে কিছুটা ধুলোর আস্তরন জমা, আপাতত অনুজ্জল এক খ্যাপাটে তারা। কিন্তু এটাও ঠিক বাংলা গানে লালন-রবিন্দ্র-নজ্ররুল-দিজেন্দ্র-সচিন-সলিল এর পরে যদি কোন উল্লেখযোগ্য নাম আসে, তবে সেটা অবশ্যই গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং কবির সুমন। বাংলা গানে এরা যে নতুন ধারা নিয়ে তোলপাড় তোলা এক নতুন যুগের সুচনা করেছে, পুরো কলিকাতা এখনোও এই নতুন ধারার ঘোর থেকে বেরহতে পারেনি, খুব দ্রুত পারবে এমনটা ভাবাও যায়না। নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিত থেকে শুরু করে হালের চন্দ্রবিন্দু, অনুপম এরা সহ আনাচে-কানাচে, ডোবা-নালায়, ক্ষেত- খামারে আরও নানা উল্লেখ্য বা অনুল্লেখ্য দলগুলোও এ ধারাতেই স্বযত্নে বেড়ে উঠা গৌতম-সুমনের সন্তান। এরা এটা স্বীকার করুক বা না করুক। বাংলাদেশও সে প্রভাব মুক্ত নয় তবে সীমান্তের বেড়ার কারনে হোক কিংবা অন্য কোন কারনেই হোক আজম খানদের ব্যাপক প্রভাবের জাল ছিড়ে জীবনমুখী গান এখানে অতটা জাঁকিয়ে দাড়াতে পারেনি। বাংলা গানে গৌতম চাটুজ্জে যেমন একটি ভয়ানক আলোচিত যুগের ভুমিকা তেমনি সুমন নিজেই একটা যুগ এবং পরবর্তী অনেকগুলো যুগের ভীষণরকম প্রভাবক হিসেবে টিকে থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৪:১৬