“ইতিহাসের দিক হইতে পূর্ববঙ্গের ‘বাংলাদেশ’ নাম গ্রহনের কোন সমর্থন নাই। ‘বাংলা’র পূর্বরূপ ‘বাঙ্গালা’ নাম মুসলমানদের দেওয়া – নামটি বাংলার একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম ’বঙ্গাল’ শব্দের অপভ্রংশ, ইহা ‘বঙ্গ’ শব্দের মুসলমান রূপ নহে। মুসলমানেরা প্রথম হইতেই সমগ্র বঙ্গদেশকে মুলুক বাঙ্গালা বলিত। চতুর্দশ শতাব্দী হইতেই ‘বাঙ্গালা’ (Bangalah) শব্দটি গৌড় রাজ্য বা লখনৌতি রাজ্যের প্রতিশব্দরুপে বিভিন্ন সমসাময়িক মুসলিম গ্রন্থে ( যেমন ‘সিরাত- ই- ফিরোজ শাহী’ ) ব্যবহৃত হইয়াছে। পরে হিন্দুরাও দেশের এই নাম ব্যবহার করেন। পর্তুগীজরা যখন এদেশে আসেন তখন সমগ্র ( পূর্ব পশ্চিম- উত্তর- দক্ষিন) বঙ্গদেশের এই ‘বাঙ্গালা’ নাম গ্রহন করিয়া ইহাকে বলেন ‘Bengala’ পরে ইংরেজরা ইহার ঈষৎ পরিবর্তন করিয়া লেখেন Banglah । সুতরাং দেখাযাইতেছে যে ইংরেজের আমলে যে দেশ Bengal বলিয়া অভিহিত হইত, মুসলমান শাসনের প্রথম হইতেই সেই সমগ্র দেশের নাম ছিল বাঙ্গালা-বাংলা। সুতরাং বাংলাদেশ ইংরেজ আমলের Bengal প্রদেশের নাম- ইহার কোন এক অংশের নাম নয়। বঙ্গদেশের উত্তর-দক্ষিন-পূর্ব-পশ্চিম সকল অংশের লোকেরাই চিরকাল বাঙ্গালী বলিয়াই নিজেদের পরিচয় দিয়াছে, আজও দেয়। ইহাও সেই প্রাচীন বঙ্গাল ও মুসলমানদের মুলুক ‘বাঙ্গালা’ নামই স্মরণ করাইয়া দেয়। আজ পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাঙ্গালী বলিয়া পরিচয় দিতে পারিবে না ইহাও যেমন অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর, ‘বাংলাদেশ’ বলিলে কেবল পুরববঙ্গ বুঝাইবে ইহাও তদ্রুপ অদ্ভুত, অসঙ্গত ও হাস্যকর।
দীর্ঘকাল ধরিয়া বাঙ্গালা, বাংলাদেশ, বাঙ্গালী শব্দগুলি সমগ্র Bengal বা বাংলা অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার পর আজ হঠাৎ কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গকে ( যাহা আদিতে মুসলমানদের ‘বাঙ্গালা’ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলোনা – ‘বঙ্গ ওয়া বাঙ্গালাহ’ তার প্রমান ), বাংলাদেশ বলিতে হইবে এরূপ ব্যবস্থা বা ঘোষণা করার অধিকার কোন গভরমেনটের নাই। উপরে উল্লিখিত কারনগুলি ছাড়া আরও একটি কারনে ইহা অযৌক্তিক । অবিভক্ত বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতির গঠনে যাহারা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী অধিবাসী তাঁহাদের পূর্বপুরুষদের অবদানও যথেষ্ট ছিল। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়া ‘বাংলাদেশ’ ও ইহার অধিবাসীদের বাদ দিয়া ‘বাঙ্গালী জাতি’ কল্পনা করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য লর্ড কারজন যখন বাংলাকে দুই ভাগ করিয়াছিলেন, তখন পশ্চিম অংশেরই নাম রাখিয়াছিলেন Bengal অর্থাৎ ‘বাংলা’ । বর্তমান বাংলাদেশ তখন পুরববঙ্গ ( East Bengal) বলিয়া অভিহিত হইত।
বর্তমান পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রনায়কগণ ইতিহাস ও ভূগোলকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাঁহাদের দেশের ‘বাংলাদেশ’ নাম গ্রহন করিয়াছেন। ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইহার কোন প্রতিবাদ করেন নাই- ইহার কারন সম্ভবত রাজনৈতিক। সাধারণ লোকে কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ নামের অর্থ পরিবর্তনকে সম্পূর্ণ গ্রহন করিতে পারে নাই। তাহার প্রমান- এখনও পশ্চিমবঙ্গের লোকরা দৈনন্দিন কথাবার্তায় ও লেখায় পশ্চিমবঙ্গকে ‘ বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করে; ভারতের আন্তঃরাজ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী পশ্চিমবঙ্গের দলগুলি ‘বাংলা দল’ নামে আক্ষায়িত হয় এবং পশ্চিমবঙ্গে হরতাল পালিত হইলে তাহাকে ‘বাংলা বন্ধ’ বলা হয়। আমরাও বাংলা নামকে উৎখাত করার বিরোধী। সেইজন্য বর্তমান গ্রন্থের ‘ বাংলাদেশের ইতিহাস’ নাম অপরিবর্তিত রাখা হইল। শুধু পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নহে- ত্রিপুরা এবং বর্তমান বিহার ও আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বাংলা-ভাষী অঞ্চলগুলোকেও আমরা ‘বাংলাদেশ’ এর অন্তর্গত বলিয়া গণ্য করিয়াছি এবং এই সমস্ত অঞ্চলেরই ইতিহাস এই গ্রন্থে আছে।”
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫৭