আগে যখন গ্রামে বিজলির আলো আসেনি, সন্ধার পরে কোন হাটুরে যদি নিরিবিলি রাস্তা ধরে ইলিশ মাছ নিয়ে হেঁটে আসতো তবে নিশ্চিত হাওর/ বিলের মেছ ভুতেরা সুরু নাকি গলায় বলতো ‘এই মাছ দিয়ে যা’। গ্রামের রাস্তায় বিজলি বাতি চলে আসায় ওরা দূরে আরও দূরে, নির্জন কোন হাওর বা বিল বা নদীর নির্জনতম স্থানে মন মরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আগের মতো মানুষকে ভয় দেখাতে ইচ্ছে করে না। ভয় দেখিয়ে মাছের দখলও নিতে ইচ্ছে করে না। সেই মজা আর নেই। সব কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে এসেই বুকচেরা হুহু বাতাশে আর টিপটিপ বৃষ্টির ভেতরে বেশ কিছু মেছ ভুত আমি দেখেছি। এখানে যারা এসেছেন নিশ্চয়ই বলবেন এ এক অপার্থিব নিস্তব্ধ জগত।আমার কাছে নিস্তব্ধতার ব্যাপক হাহুতাশপূর্ণ সৌন্দর্য আছে। সব সৌন্দর্য শুধু দেখেই প্রান জুড়ায় না , চোখ বন্ধ করেও তার কিছু সুধা পান করতে ভালো লাগে। এটা সেই জগত। ঘন সাদা,কালো,নীল মেঘের ছায়ায় ধুধু জল আর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দু একটা করচ গাছ মনের ভেতরে সরাবের মতো ঘোর তৈরি করে দেয়। চোখের পর্দা খুলে নতুন কিছু সামনে টেনে আনে। মেছ ভুত আমি ঠিকই দেখেছি। যদিও তাদের বিষণ্ণ মুখ দেখে হাসি পায়। ভুতেরাও বিষণ্ণ হতে পারে!! সে রাতটা ছিল ভরা আমাবস্যা। নিজের হাতকেও দেখা যায়না। হাওরের নির্জনতম স্থানে ট্রলার রেখে ওদের গল্পের দাওয়াত দিয়েছিলাম । ওরা ওদের অপারগতার কথা জানিয়েছিল। পুরো ট্রলারের চারদিকে মোমবাতি জ্বালানোর ইচ্ছে ছিল ওদের সম্মানে। তাও আসেনি। ঠিক দুপুরে যে জায়গায় করচ গাছ গুলো পানির বুকে সারি সারি আধেক ডুবে দাড়িয়ে আছে , আসে পাশে ধুধু পানি আর পোকামাকড় ছাড়া কিছুই নেই , সেখানে আমরা গোছল করবো বলে হই হই করে নেমে পরলাম। সবাই যখন ঝাপা ঝাপিতে বাস্ত, আমি ভাসতে ভাসতে দূরের ঐ শেষ গাছটার কাছে গিয়ে এক ভুতকে পেলাম। এই প্রথম এতো কাছে সে এসেছে। ঠিক আমার পাশের ডালটাতে পা দুলিয়ে বসে সে বিষণ্ণ মুখে আমাকে দেখছে। আমার আবারও হাসি পাচ্ছে ওকে দেখে। এবার সে আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দূরে অনেক দূরে মরার মতো নিশ্চল চোখে তাকিয়ে নাকি সুরে বলে উঠল ‘সব কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে’।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৩৩