‘গল্প করার এইতো দিন
মেঘ কালো হোক মন রঙিন
সময় দিয়ে হৃদয়টাকে
বাঁধবো নাকো আর’
পুরো ময়মনসিংহ শহর জুড়ে পুরনো সব বিল্ডিং গুলো মনে করিয়ে দেয় অভিজাত/জমিদার আর বড় বড় মহাজনদের পদচারনায় এ শহর কতোটা জমজমাট ছিল একসময়। সরাকারি কর্ম কর্তাদের বাংলো গুলো দেখে ব্রিটিশদের ‘বিলাসী মন আর বাংলার ধন শোষণ’ ভালোই বুঝা যায়। শশী লজের পুকুর পাড়ের দোতলায় চিতপটাং হয়ে কতো অদ্ভুত কথাই না মনে আসছে । পিতার নাম সূর্য আর পুত্রের নাম শশী বা চন্দ্র । বাহ ! আসমানের চাঁদ সূর্য সব নেমে এসেছে। সূর্যকান্ত কেন নিঃসন্তান ছিলেন, কেন তাঁর দত্তকপুত্র শশীকান্তের জন্য এতো মনমুগ্ধকর একটি প্রাসাদ বানালেন? আচ্ছা আমি কেন তার দত্তক পুত্র হলাম না? কি যে সব আজগুবি ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করে মাঝেমাঝে। চমৎকার সব স্থাপত্য শৈলীর সমাহার হয়েছে এই শশী লজে। সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সেই সব নান্দনিকতার স্রস্টারা আজ কোথায়? এই পুকুর পাডে জমিদার কিন্নরিগনের জলকেলির সঙ্গে কতো সপ্ন কতো সুখ চিন্তা ভেসে বেড়াত সবই হারিয়ে গেছে,সব সৌন্দর্য জৌলুস আর রঙ ধুসর হয়ে গেছে। পুরনো আর ভাঙ্গা বিল্ডিং গুলোতে ঘাস-লতা পাতা গুলো নাদুস নুদুস দেহ নিয়ে টিটকারি করে যেন বলছে ‘পৃথিবীর সব মানুষ তাড়িয়ে এভাবেই সব দখল করবো একদিন’।
‘নয়া বাড়ী লইয়ার বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন,
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কাইন্দন গো জুড়িল কাইন্দন।।
কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর,
সেই বাইঙ্গন বেইচ্যা দিয়াম তোমার গলায় হার গো তোমার গলার হার।।
নয়া বাড়ী লইয়ার বাইদ্যা লাগাইলো কচু,
সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু গো তোমার হাতের বাজু।।
নয়া বাড়ী লইয়ার বাইদ্যা লাগাইলো কলা,
সেই কলা বেইচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা গো তোমার গলার মালা।।
নয়া বাড়ী লইয়ার বাইদ্যা বানলো চৌকারী,
চৌদিকে মালঞ্চের বেড়া আয়না সারি সারি গো আয়না সারি সারি।।
হাস মারলাম কইতর মারলাম মাইছ্যা মারলাম টিয়া।
ভালা কইরা রাইন্দো বেগুন কালাজিরা দিয়া গো কালাজিরা দিয়া।‘
ময়মনসিংহ গীতিকার কথা কতো শুনেছি। দেওয়ান ও মদিনা, সোনাই মাধব, সুন্দরী কমলা এ পালাগুলো স্কুলে থাকতেই পড়েছি। আরও অনেক পরে বুঝেছি এগুলো বাংলা সাহিত্যের কতোটা অমূল্য সম্পদ। এটা পুরোই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। বাঙ্গালী সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার অমূল্য ভাণ্ডার। কিন্তু ময়মনসিংহে এসে এই গীতিকা নিয়ে ময়মনসিংহবাসীর তেমন কোন মাতামাতি দেখলাম না। কোন একটা সাইনবোর্ডও নজরে পরলনা যেটাতে পালার কোন চরিত্রের নাম লিখা আছে। সিলেটে গেলে দেখা যায় হযরত শাহজালাল নামের ছড়া ছড়ি সারা শহর জুড়ে।
ব্রহ্মপুত্র নদে সওদাগরি জাহাজ পাল উড়িয়ে হাওার বেগে চলেছে একদিন। এটা মনে রাখতে হবে ব্রহ্মপুত্র একটি নদ। নদী নয় কেন? পুত্র হচ্ছে পুরুষ বাচক আর নদও পুরুষ বাচক। কাজেই ব্রহ্মার পুত্র একজন পুরুষ। কেদারনাথ মজুমদার তাঁর “ময়মনসিংহের বিবরণ” (১৯০৪) গ্রন্হে ব্রহ্মপুত্রের জন্ম ইতিহাস আলোচনায় বলেছেন 'পরশুরাম মাতৃহত্যা পাপে কলুষিত হয়ে পরশু মোচনের জন্য ঐ ব্রহ্মকুন্ডে অবগাহন করলে হস্তস্হিত পরশু (কুঠার) স্হালিত হয় ।পরশুরাম লোহিত্য বারির কলুষনাশন গুনে আকৃষ্ট হয়ে নরলোকের হিতার্থে তাঁকে গিরিকুন্ড হতে ভূতলে আনয়ন করেন । ভূতলে অবর্তীণ হয়ে ব্রহ্মপুত্র তীর্থরাজ লৌহিত্য নদ রুপে পরিচিত হয়’। সেই বিশাল নদ বয়ে কতো কিছু চলেছে। জমিদারি বজরা কতো আমদ প্রমোদ আর হৈ হুল্লোড় নিয়ে ছুটে বেড়াত এই ব্রহ্মপুত্র নদের এদিক সেদিক। জমিদার বাবুদের ক্ষমতার উৎস ব্রিটিশ কর্তারাও সেই আমদে যোগ দিয়ে মন রাঙ্গাত। আমরাও সেই ব্রহ্মপুত্রর বুকে দাপিয়ে বেড়িয়েছি । আগের সেই উতলে উঠা পানি তো আর নেই, সেই বজরাও নেই। কেবল আমাদের মতো শহুরে উত্তপ্ত কিছু মন আছে, যারা দূর থেকে ছুটে এসেছে হাঁটু পানিতে মন ভেজাতে। ব্রহ্মপুত্রর হাঁটু পানিতে দাপাদাপি করে এটাও বুঝলাম মন ভেজাতে অথৈ পানি লাগেনা, শুধু অনুভূতি প্রবন নরম ইন্দ্রিয় লাগে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সেই অসাধারণ দাপাদাপি অনেকদিন মনে থাকবে। গলাপানিতে শরীর ডুবিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে হারমনিকাতে কোন নরম আইরিশ সুর কিংবা রবীন্দ্র সুর সেটাও মনে রাখারই মতো ঘটনা। ধন্যবাদ আইডিয়াটার জন্য ।
সময়ের ফাঁদে হৃদয়কে আমরা কতো কাঁদিয়েছি। অর্থের ফাঁদের কথা না হয় বাদই দিলাম। পৃথিবীর সব ফাঁদ গুলোই আমাদের অনেককেই নিজের ভিতরে ঠেলে দিয়েছে। মন কে অন্ধকারে বেঁধে রেখেছে। ভিতরের উজ্জ্বল আলো অন্ধকারে পড়ে থেকে গভীর থেকে আরও গভীর কালো হয়েছে। গভীর সেই কালো থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বল করবো বলে যে অভিযান তারই একটি চেষ্টা এই ময়মনসিংহ শহর ঘুরতে যাওয়া।ভোর ৬ টায় এনা পরিবহনে যাত্রা শুরু আর শেষ রাত ৯. ২০ এ। এই প্রায় ১৫ ঘণ্টার ভ্রমনে ৫.৩০ ঘণ্টা কেটেছে এনা পরিবহনে । বাকি পুরো সময়টা আমরা ময়মনসিংহ দর্শন করেছি আমাদের মতো করে। শহরময় ব্যাক প্যাক নিয়ে ছুটে চলেছি। ভালো লাগার জন্য একটা মন দরকার সেটা আমাদের ছিল। আসলেই জীবনটা সুন্দর।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬