সেন বংশের রাজারা তাদের প্রবল প্রতাপের সঙ্গে চরম আতঙ্ক নিয়ে রাত দিন পার করছেন তখন। ভারতবর্ষে তুর্কি যোদ্ধারা ঢুকে পড়েছে এবং চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ তুর্কিদের যতই যবন বলে তাচ্ছিল্য করুকনা কেন একটা জায়গায় সবাইকে একমত হতেই হবে যে তারা ছিল ভীষণ সাহসী যোদ্ধা, দুর্ধর্ষ বীর । ওদের সঙ্গে কলিজা ছিলনা ছিল শুধু নিজ দেশের ক্ষুধা তৃষ্ণায় জর্জরিত জীবন যুদ্ধের কঠিন ইতিহাস আর শীর্ণ শরীরে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা।বখতিয়ার খলজির সামনে এগিয়ে যাওয়া, বাংলা জয় করা ছাড়া অন্যকোন কোন উপায় কি আর ছিল? হয় মরো নয়ত মারো।শক্তি দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে হবে তো।টিকে থাকার চিন্তাই তো হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে জীবন যুদ্ধে এই মুল্লুকে আসার প্রেরনা দিয়েছে।সেই চরম আতঙ্ক নিয়েই লক্ষন সেন বাংলার ইজ্জতের নাককেটে কাপুরুষের মতো নদিয়া থেকে পূর্ববাংলায় পালিয়ে কোনমতে জান বাঁচিয়ে প্রমান করেছেন মানুষ আসলে নিজেকেই বেশি ভালবাসে। পূর্ববঙ্গেও যবন আতঙ্ক তখন ভয়াবহ। এমনই কোন এক যবন আক্রমন আতঙ্কের যুগে আদম শাহ্ নামে এক ধর্মপ্রচারক বিক্রমপুরে আসে ধর্ম প্রচারে ।আতঙ্কে তখন কে ধর্ম প্রচারক আর কে আফগান/তুর্কি ডাকাত তার ভেদাভেদ করার সুযোগই থাকেনি। কিংবা হয়তো সেই ধর্মপ্রচারকও যুদ্ধের সকল প্রস্তুতি নিয়েই শান্তির বানী প্রচারে এসেছিলেন!কেউ কাউকে বিশ্বাসই তো করতে পারছেনা।কাজেই যুদ্ধ অনিবার্য।আর তাই আদম শাহ্র সঙ্গে হিন্দু কোন এক রাজার যুদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। হিন্দু রাজা যুদ্ধে যাবার আগে তার পরিবারবর্গ কে বাড়ির চত্বরে এক বিশাল আগুন জ্বালাতে বললেন। একটা পায়রা নিজের কোমরে বেঁধে সবাইকে বললেন ‘যুদ্ধে যাবার পর যদি পায়রাটা বন্ধন মুক্ত হয়ে উড়ে তোমাদের কাছে আসে তাহলে বুঝেনিও আমি আর বেঁচে নেই, যবনদের হাতে ধরা পরার চে তোমারা সবাই আগুনে আত্মহুতি দিও’। নাটকীয় ভাবে যুদ্ধে হিন্দু রাজারই জয় হয় কিন্তু পায়রাটা কিভাবে যেন বন্ধন মুক্ত হয়ে চলে যায় পরিবারের কাছে । তারপর যা হবার তাই হোল। রাজা বাড়িতে এসে পরিবারের শোকে নিজেও যা করার তাই করলেন। আদম শাহ মসজিদটি এখনও টিকে থেকে কি এই কাহিনিকেই সমর্থন করে যাচ্ছে? কতো সুন্দর একটা ফিকশন ঢাকা থেকে খুব সামান্য দূর মুনশিগঞ্জে লুকিয়ে আছে। কয়জনই বা এই কাহিনী জানে। আমিও জানতাম না যদি বিখ্যাত সেন বংশের কোন এক উত্তরসুরি যিশু সেন সেটা না বলতো।
মুনশিগঞ্জ ঢুকলেই পুরনো একটা গন্ধ ভেসে আসে। মনে হয় হুট করে ৪/৫ শ বছর আগের কোন এক শহরে এসে ঘুরে বেরাচ্ছি। আর কারও এমন হয়কিনা জানিনা কিন্তু আমার হয়। বারবার এসেছি এবং বারবারই এমনই অনুভূতি হয়েছে। মুনশিগঞ্জে আসলে প্রথমেই মনে হয় বজ্রযোগিনীর অতিশ দিপঙ্করের কথা। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়ে জেনেছি তিনি অনেক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন । আসলে কতো বড় জ্ঞানী ছিলেন সেটা বুঝতে বয়সে অনেক বড় হতে হয়েছে আর কিছুটা পড়াশোনাও করতে হয়েছে। তার একটা ছবিও দেয়া ছিল বইয়ে । দেখে গৌতম বুদ্ধের মতো মনে হতো। আর দুইজন লোকের কথা অনেক পড়েছি বইয়ে, একজন হচ্ছেন লক্ষন সেন আরএকজন বল্লাল সেন। বাংলার ইতিহাসে এই দুইজন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তখন সেটাও বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি। এখন এটাও বুঝি মুনশিগঞ্জও ঐতিহাসিক ভাবে কি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা থেকে মুনশিগঞ্জ খুবই কাছে তারও কাছে আরশি নগর। সে নগরে এক পরশি বসত করে,আমি একদিননা দেখিলাম তারে।শুনেছি সে পড়সি দেখতে বিশ্বাসী মন লাগে আর লাগে সাধনা। আমার কোনটাই নেই। আমার মনও সবসময় ‘বিশ্বাস’কে মিথ্যা আর কপটতার আশ্রয় কেন্দ্র বলে বিশ্বাস করতে চায়। মন যে আসলে কি চায়!
'যারে খুঁজি তারে পাইনা
চাইনা যারে তারে পাই,
যে জন ঘুরে আমার পাশে
তারে আমার দরকার নাই’
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ রাত ১২:৪৮