হাংরি আন্দোলনের 'হাংরি' শব্দটি ইংরেজি Hungry থেকেই নেয়া হয়েছে, যার মানে ক্ষুধার্ত। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর এই আন্দোলন হয়েছে। যার পুরোধা ছিলেন সে সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত কবি সমীর রায়চৌধুরী ও তাঁর ছোট ভাই মলয় রায়চৌধুরী। আবার মলয় রায়চৌধুরীর সাথে হারাধন ধাড়া'র ভালো বন্ধুত্বের কারণে হারাধন ধাড়াও এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই আন্দোলনের সুত্রপাত হয় পাটনাতে।
বাংলা সাহিত্যে স্থিতিবস্থা ভাঙ্গার আওয়াজ তুলে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে তার নাম'ই হচ্ছে হাংরি আন্দোলন। পরিষ্কার করে বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন। এই আন্দোলনকে Hungryalism বলা হয়ে থাকে। দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী করার জন্য এই আন্দোলনের শুরু হয়। হাংরি আন্দোলনের হাংরি শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা ইংরেজ ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের "ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম"- বাক্যটি থেকে। এই আন্দোলনকে অনেকে কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন বলে। কারণ, তাদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখে পরবে।
হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত এক পৃষ্ঠার বুলেটিন বের করতেন আর। আর পাটনা বাদে অন্যান্য জায়গা থেকে প্রকাশিত বুলেটিনগুলো ছিল বাংলা ভাষায় ছাপানো। কারণ, পাটনাতে তখন বাংলা প্রেস ছিল না। আর আন্দোলনের মাঝামাঝি সময়ে এসে তারা বিভিন্ন কবিতা, ব্যাঙ্গচিত্র, গল্প ছাপাতে শুরু করে। আর এই সময়টাতে তাদের সাথে যোগ দেয় লেখক ও চিত্রশিল্পী সুবিমল বসাক, কবি ও তৎকালীন সাংবাদিক ফালগুনী রায়, চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় সহ আরও অনেক কবি-লেখকেরা। মলয় রায়চৌধুরী, হারাধন ধাড়া ও সুবিমল বসাক তাদের কাজের মাধ্যমে কলকাতায় তারা তিনজন হাংরি ত্রিমূর্তি নামে অধিক পরিচিত হন। তারা একের পর এক বুলেটিন ছাপাতে থাকে, লিখতে থাকে কবিতা, আর শ্লীল-অশ্লীল নানা ধরণের ব্যাঙ্গচিত্র। আর এগুলো তারা হ্যান্ডবিলের মত প্রকাশ করত। এতে করে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কারণ, ঐ সব বুলেটিন তারা নিজেদের সংগ্রহে রাখতে পারে নি। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র বহু চেষ্টায় গোটা দশেক সংগ্রহ করতে পেরেছেন। ঢাকা বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সংগ্রহ করতে পেরেছেন। ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলো হলঃ মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, হারাধন ধাড়া সম্পাদিত চিহ্ন, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদেব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, সুভাষ ঘোষ সম্পাদিত আর্তনাদ ইত্যাদি। আরেদিকে বিট আন্দোলনের অন্যতম কবি ও "সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড"-কবিতার লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় থাকাকালীন ইংরেজি বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করে স্ট্যনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে গেছেন, বিদেশী গবেষকদের সৌজন্যে এগুলো জানা যায়।
১৯৬৪ সালে হাংরি আন্দোলনের সাথে জড়িত সকল কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিকদের নামে মামলা করা হয় আর ৬-৭ জনকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না পাওাতে আবার ছেড়ে দিতে হয়েছে অনেক জনকে। আর তারপরে ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে এই আন্দোলন একদম থেমে যায়। এর পরেও কয়েকজন চেষ্টা করেছিলেন আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখার জন্য কিন্তু তারা আর পেরে উঠতে পারে নি। ফলে ১৯৬৬ সালের গোঁড়ার দিকে এই আন্দোলন ইতিহাস হয়ে যায়।
ভারতীয় বাংলা সিনামা সৃজিত মুখোপাধ্যায়'এর "বাইশে শ্রাবণ"-এখানে আমরা হাংরি আন্দোলনকারীকে দেখতে পারি। নিবারণ চক্রবর্তী(গৌতম ঘোষ) ছিলেন একজন হাংরি আন্দোলনকারী। গৌতম ঘোষ প্রায় ২৯ বছর পর অভিনয়ে ফিরে আসেন এই চরিত্রটির(নিবারণ চক্রবর্তী) মাধ্যমে।
এই হাংরি আন্দোলনের ফলে বাংলা সাহিত্যে তেমন প্রভাব পরে নি। শুধু ১৯৬১-১৯৬৬ সাল পর্যন্তই এর যা একটু প্রভাব ছিল। তবে এই আন্দোলন অনেক সমালচিত আন্দোলন, জানি প্রতিটি আন্দোলনই সমালচিত কিন্তু এই আন্দোলনের সমালচনার দিক অনেক ছিল। বিশেষত এই আন্দোলন সম্পর্কিত ব্যাঙ্গচিত্রগুলো অশ্লীলই বেশী ছিল আর আন্দোলনকারীরা অনেক বেশী আসক্ত ছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৩৫