আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু মাত্র ১৭ বছর আগে। কিন্তু বাঙ্গালীর কাছে মাতৃভাষা দিবস ৬৪ বছরের একটি ইতিহাস। প্রথমে এই ইতিহাসের সারমর্ম বলে নিচ্ছি, "১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ-ভারত ভাগ হয় তখন জন্ম নেয় দু'টি দেশ, ভারত সাম্রাজ্য ও পাকিস্তান সাম্রাজ্য। আর পাকিস্তানে দু'টি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি হয় পূর্ব পাকিস্তান ও অন্যটি হয় পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেক মৌলিক পার্থক্য বিরাজ করছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আর এই ঘোষণার পরে বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যতঃ পূর্ব পাকিস্তান অংশের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আর এর পরে খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে এই ভাষাকে কেন্দ্র করে। আর ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এসে আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে উঠে জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। কিন্তু ছাত্ররা এই ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করে বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুখের ভাষা করতে। মিছিলটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। আর এতে অনেক ছাত্র প্রাণ হারায়, কিন্তু তাঁদের প্রাণ হারানো বৃথা ছিল না, তাঁদের এই প্রাণের জন্য আজ বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলছি, কবিতা লিখছি, গান গাইছি। আজ ঐ আন্দোলনের জন্য আমি-আমরা বলতে পারছি বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা। আর ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়।"
কিন্তু এই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে আমরা বাঙ্গালী এই দিনটি পালন করি নিজের ফেসবুক প্রফাইলে শহীদ মিনারের ছবি কিংবা শোকের কালো পতাকা দিয়ে। আর অনেকে তো পোস্ট দিয়ে দিল Celebrating 21th February. অর্থাৎ আপনি শোক দিবস উদযাপন করছেন! হাহাহাহা! শোক আবার উদযাপন করা যায় কিভাবে? আপনার বাবা মারা গেছেন ৫ বছর হল আর আজ ৫ বছর পরে আপনি যখন তার জন্য দোয়া করছেন তার কবরের সামনে গিয়ে তখন কি আপনি বলতে পারবেন যে আপনি আপনার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করছেন? বা আপনি ফেসবুকে কি পোস্ট দিচ্ছেন যে সেলিব্রেটিং অমুক তারিখ(আপনার বাবা যেদিন মারা গেছেন) আর সাথে সাথে আপনার বাবার কবরের সাথে বিভিন্ন রং-ঢং করে সেলফি তুলে আপলোড দিচ্ছেন। দিতে পারবেন? পারবেন না তো? তাহলে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কিভাবে পারলেন শহীদ মিনারে, প্রভাত ফেরিতে সেলফি তুলতে? আবার অনেকে দেখলাম কালো শাড়ি পরে, কপালে কালো টিপ দিয়ে বা কালো পাঞ্জাবী পরে সেলফি তুলছে আর সেলফি তুলার সময় মুখের পোজটা দেখার মতো যেন বিবাহ করতে যাচ্ছে! আর আপনি যখন তাদের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারির মাহাত্ম্য জানতে চাইবেন তখন তারা বলবে, ঐ দিন যুদ্ধ হয়েছিল, ব্লা ব্লা ব্লা! সবাই হয়তো বলবে না কিন্তু ৬০ শতাংশ আমজনতা একই কথা বলবে। তবে বাঙ্গালীর সার্থকতা কোথায়? তারা জানেই না দিনটির মাহাত্ম্য আর তাদের শোকটাও একদিনের জন্য মনে হয়। কারণ অন্যান্য দিন তারা স্যান্ডেল পা'য়েই শহীদ মিনারের বেদীতে উঠছে। আরে ভাই ২১এর চেতনা আপনার মনে, সেটা আপনার ফেসবুক ওয়ালে নয়। আপনি ২১এর মাহাত্ম্য জানুন, বাংলা ভাষা কেন আমাদের হল তা জানুন। আর আজাইরা ঢং দেখানোর জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করে কি হবে? আর এখনকার স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা তো জানেই না ২১শে ফেব্রুয়ারি কি? তারা জানেই না কেন তারা বাংলা ভাষায় কথা বলছে। তারা জানে না কারণ তাদের জানানোর মত কেও নেই। তাদের বাবা-মা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, সময় নেই নিজের সন্তানকে বাংলার ইতিহাস জানানোর। আর তাদের শিক্ষকরা তাহলে কি করছে? এই শিক্ষকদের জায়গায় কয়েকটা দল আছে। এক দল শিক্ষক জানাতে চায় কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে সে শিক্ষক ভালো না, আর এক দল নিজের বিষয় বাদে অন্য কোন বিষয় ক্লাসে পড়াতে চায় না, আর এক দল যারা ক্লাসে বাঙ্গালীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করাকে সময় নষ্ট করা হয় বলে ধরে নেয়! আর যে সব ছেলে-মেয়েদের জানতে ইচ্ছা করে বাঙ্গালীর ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস তারা বিভিন্ন লেখকের লেখা পড়েই যা জানতে পারে।
তাহলে কি আস্তে আস্তে ইতিহাস মুছে যাবে? না যাবে না কারণ আমাদের মতো কিছু পাবলিক আছে যারা বাংলাকে, বাঙ্গালীর ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। আর তাদের জন্য এই ইতিহাস টিকে থাকবে।
সবশেষে আমি একটা কথাই বলতে চাই, আধুনিকতায় গা না ভাসিয়ে একটু জানুন বাংলা কি, বাংলা ভাষা কি, কেন আপনি বাংলায় কথা বলছেন, কেন আজ এই বাংলা, অন্য কোন ভাষায় আমরা কেন কথা বলছি না, কেন এই একুশ, কি হয়েছিল সেদিন? প্রশ্নের হয়তোবা শেষ হবে না আপনি যদি জানতে চান তবে এরকম অনেক প্রশ্ন আপনি করবেন আর তার উত্তর জানতে চাইবেন। বাংলাদেশে এই ২১এর মাহাত্ম্য নিয়ে অনেক বই আছে, ইন্টারনেট আছে, অনেক শিক্ষক আছে যারা আপনাকে জানাতে চায় বাঙ্গালীর ইতিহাস কিন্তু আপনার জন্য জানাতে লজ্জা পায়। আপনি জানুন আর বাঁচিয়ে রাখুন বাঙ্গালীর ইতিহাস কে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১২